হঠাৎই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্য়ালয় উত্তাল হয়ে উঠেছে। ঝামেলা সৃষ্টি করার প্রধান মুখ বিজেপির ছাত্র শাখা। ছাত্র ইউনিয়ন হলে মহম্মদ আলি জিন্নাহ’র ছবি টাঙানো আছে। কেন তা থাকবে এই নিয়ে ঝামেলা। দাবি, অবিলম্বে ছবি খুলতে হবে। বুধবার ক্য়াম্পাসে জিন্নাহ’র ছবি পুড়িয়েছে এবিভিপি। উত্তরপ্রদেশের সরকার ও তার পুলিশের ভূমিকা ন্য়ক্করজনক। দাঁড়িয়ে দেখছে। বিশ্ববিদ্য়ালয়ের অভ্যন্তরে ও বাইরে এই প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বিজেপি যে অসভ্য়দের দল এবং ফ্যাসিবাদী তা প্রমাণিত।
প্রথমে বলি মহম্মদ আলি জিন্নাহ’র ছবি কেন টাঙানো আছে? একা তাঁর নয়,আরও অনেকের আছে। মহম্মদ আলি জিন্নাহ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য়ে অন্যতম। স্য়র সৈয়দ আহমেদ খানের সঙ্গে তাঁর অনেক ব্য়াপারে মত পার্থক্য় ছিল, কিন্তু মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষা প্রসঙ্গে একমত ছিলেন দুজনে। ১৯৩৮ সালে জিন্নাহকে লাইফ টাইম সম্মান দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে। তিনি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দেশ ভাগ পর্যন্ত কোর্টের সংস্থাপক ছিলেন। এই ছবি স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে টাঙানো। নতুন করে লাগানো হয়নি। তাহলে হঠাৎ করে এ প্রশ্ন আসছে কেন? জিন্নাহ যে স্বাধীনতা সংগ্রামী তাতে কি কারও সন্দেহ আছে? তাঁর মত কারও পছন্দ না হতে পারে, তবে তাঁর অবদান অস্বীকার করা যায় না। আর স্বাধীনতার পরই যদি সব পাল্টে ফেলতে হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্য়ালয় চত্বরে আছে ভিক্টোরিয়া গেট, সেটাও কি ভেঙে ফেলতে হবে?
অতীতের কথা নয়, এই তো কয়েক বছর আগে, লালকৃষ্ণ আদবাণী পাকিস্তানে গিয়ে বললেন, জিন্নাহ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। যশবন্ত সিংহ যে বই লিখলেন তাঁর ফলে তাঁকে পার্টি থেকে তাড়ানো হলো। আসলে এর ফলে দু’জনেই বিজেপি’র নেতা হয়েও আরএসএসের কোপে পড়েছিলেন। এখন তো আরএসএসই দেশ চালাচ্ছে। সুতরাং জিন্নাহ’র ছবি পুড়িয়ে উত্তেজনা তৈরি করাটা তাদের কাজ হয়ে গেছে। এসব সত্ত্বেও উত্তর প্রদেশ সরকারের বিজেপি মন্ত্রী স্বামী প্রসাদ মৌর্য কানপুরের এক সভায় মন্তব্য় করেছেন, জিন্নাহ ছিলেন এক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী।
এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্য়ালয়। ১৮৭৫ সালে মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ সালে বিশ্ববিদ্য়ালয়ে রুপান্তরিত হয়। ৩০০ রকমের কোর্স পড়ানো হয় চিরাচরিত ও আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে। পৃথিবীর বড়সড় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্য়ে অন্য়তম। ৭৮টা লাইব্রেরি আছে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী মওলানা আব্দুল আজাদের নামে। ২৪ ঘন্টা খোলা। সারা পৃথিবী থেকে ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসছে এবং গবেষণার কাজে যুক্ত থেকেছে। ১৯০৬ সালে বিশ্ববিদ্য়ালয়ে মহিলাদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। দাবি উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়কে সংখ্য়ালঘু শিক্ষালয়ের তকমা দেওয়ার। এলাহাবাদ হাইকোর্ট কেস ঝুলে আছে। একটা বড় আন্দোলন আছে, এই বিশ্ববিদ্য়ালয়কে তার মতো থাকতে দেওয়া হোক। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জড়িয়ে আছে। মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্য়ালয়ে গেছেন এবং ভাষণ দিয়েছেন। তাঁকে সাম্মানিক ‘ওল্ড বয়েজ’ সম্মান দেওয়া হয়েছিল।
এই বিশ্ববিদ্য়ালয়ে কারা পড়েছেন তার তালিকার দিকে তাকালে দেশের নক্ষত্রদের দেখা যাবে। সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফর খান, রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন, উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, ফরাসি অঙ্কবিদ আদ্রে ওয়েল, আলোয়ার তাইমূর, শেখ আবদুল্লাহ, মুফতি মহম্মদ সঈদ, সবাই কোনও না কোনও রাজ্য়ের মুখ্য়মন্ত্রী ছিলেন। সাহিত্যিক কৃষণ চন্দর, সাদাত হোসেন মান্টো, ইসমত ছগবা, রাজিন্দর সিংহ বেদী, খেলোয়াড় ধ্যানচাঁদ, লালা অমরনাথ, জাফর ইকবাল, ঐতিহাসিক মহম্মদ হাবিব, সতীশ চন্দ্র, ইরফান হাবিব। ভারতের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত দেশপ্রেমিক ও সুসন্তানরা বেরিয়েছেন সহজে মনে করা যাবে না। আজ বিজেপি তথা আরএসএস এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের কানাকড়ি অবদান নেই, যাদের নেতারা মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়েছে, তারা বিচার করতে বসেছে মহম্মদ আলি জিন্নাহ অথবা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় দেশপ্রেমিক কিনা? পরিহাস একেই বলে!
আমার সুযোগ হয়েছিল দীর্ঘদিন এই প্রতিষ্ঠানের কোর্ট সদস্য় ও স্ট্যাটিউট কমিটির সদস্য় হিসেবে কাজ করার। এই সময়েই বহু বিতর্কের শেষে সিদ্ধান্ত হয় দেশের পাঁচটা প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র হবে। বিশ্ববিদ্য়ালয়ের রেক্টর তথা রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী প্রতিভা পাটিলজী অনুমতি দেন। পশ্চিমবাংলায় একটি হবে বলে ঠিক হয়। আমি তৎকালীন মুখ্য়মন্ত্রীকে জানাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন। মুখ্য়মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্য়ায়কে জানাতে বলেন। তিনি সাগ্রহে এগিয়ে আসেন। সবাই মিলে ঠিক হয় মুর্শিদাবাদের আহিরনে ক্য়াম্পাস হবে। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্য়ায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়। পরিকাঠামোগত উন্নয়নে তিনি সাহায্য় করেন। পরে জমি নিয়ে সঙ্কট হলে তিনি সাহায্য় করেন।
ভাড়া বাড়িতে নতুন ক্য়াম্পাস চালু হয়। এরাজ্য়ের সব বিশ্ববিদ্য়ালয়ের উপাচার্যরা সভা করে এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। একমাত্র বিজেপি প্রথম থেকে এই উদ্যোগে বাধা দিয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে যে আলিগড়ে মুসলিম বিশ্ববিদ্য়ালয়ের শাখা মুর্শিদাবাদে হবে কেন, আর ‘মুসলিম’ শব্দটি যুক্ত থাকবে কেন?
দেশের ঐতিহ্য়পূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের গায়ে সাম্প্রদায়িক তকমা এঁটে দিতে সব সময় তৎপর ছিল বিজেপি। আজ তাদের এই ঘৃণ্য় কাজটি আরও গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। আমার মনে পড়ছে আহিরনে বিশ্ববিদ্য়ালয় শুরু হওয়ার আগে একটা সাধারণ মানুষের সভায় উপস্থিত ছিলাম। বি জে পি আক্রমণ করেছিল। এত হিংস্র তারা।
সেই কারণে মূল আলিগড় ক্য়াম্পাসে তারা জিন্নাহ’র ছবি পুড়িয়ে অশান্তি চালু রাখতে চায়। একথা বলা যায় যে, বিজেপি সরকার আসার পর মুর্শিদাবাদ ক্য়াম্পাসের কোন উন্নতি হয়নি। নতুন বরাদ্দ নেই। অথচ ২০১৬ সালের মধ্য়ে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্য়ালয় হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাই নয়, মূল ক্য়াম্পাসকেও বিজেপি সরকারের অসহযোগিতার মধ্য়ে বাড়তে হয়েছে। সেখানে বরাদ্দ ছাঁটাই হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অযথা হস্তক্ষেপ বাড়ছে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার সামনে যে বড় বিপদ বিজেপি তা বারবার প্রমাণ হচ্ছে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)