কুলতলি হিন্দু বিদ্যালয়ের ঘটনা অসাংবিধানিক, অস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঘৃণার প্রসার শিশুমনকে বিপর্যস্ত করে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুলতলিতে ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ এ যা চলছে তা এক কথায় অসাংবিধানিক। ভারতের সংবিধান অত্যন্ত নির্দিষ্টভাবে বেআইনি অস্ত্র ব্যবহার ও প্রদর্শনের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছে। শুধুমাত্র শিখ সম্প্রদায় কৃপাণ ব্যবহার করতে পারেন (সংবিধানের 25 নং ধারা)। কিন্তু হিংসা উদ্রেককারী কোন সমাবেশ করা যাবে না। খবরে প্রকাশ, কুলতলির ওই বিদ্যালয়ে ছাত্রদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরিচালিত ওই বিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটির কিছু সদস্য এই বিষয়ে এতটাই বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন যে দুজন শিক্ষক চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন । প্রধান শিক্ষককে সবার সামনে অসম্মান করা হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। তিনি জানিয়েছেন যে তাঁকে নানা রকমভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে । বাধ্য হয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর সাহায্য চেয়েছেন তিনি ।
কুলতলির ওই বিদ্যালয়ে এর আগে ছাত্রদের বাধ্যতামূলক যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল তার খবর আমরা পেয়েছিলাম । ছাত্রদের মধ্যে হিংসার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে এই উদ্যোগ দেখে চিন্তান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু অসহিষ্ণুতা এতদূর পর্যন্ত ব্যাপ্তিলাভ করেছে দেখে আশ্চর্য হতে হয়। সংবিধান মেনে বিদ্যালয় পরিচালনা করার জন্য প্রধান শিক্ষক হুমকির মুখে পড়ছেন, দুজন শিক্ষককে চাকরি ছাড়তে হচ্ছে। তাঁদের অপরাধ, শিক্ষার মূল লক্ষ্যে অবিচল থাকা। ছাত্ররা পড়াশোনার মাঝে শরীর চর্চা করবেন, তাতে কোন অসুবিধা নেই কিন্তু অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আসলে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁদের রাজনৈতিক মতামত অনুযায়ী সামাজিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য একেবারে ঘরের মধ্যেই ঢুকতে চাইছেন । সেই লক্ষ্যে প্রথমেই যদি শিশুমনকে কব্জা করা সম্ভব হয় তাহলে অতি সহজেই কাজ হাসিল হবে। আমরা কে না জানি যে শৈশবে যে সামাজিক শিক্ষা একবার তৈরি হয়ে যায় তা আর পাল্টায় না। মনের ভিত সবচেয়ে কাঁচা অবস্থাতেই তৈরি করতে হয়। তবেই তার কাঠামো মজবুত হয়। হিন্দুত্ববাদীরা এই বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেই তাঁরা বিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে হাতিয়ার করে এগিয়েছেন। আজ নয়, সঙ্ঘ পরিবারের জন্মলগ্ন থেকেই। কিন্তু এখন তো যা করবেন সংবিধান মেনে করতে হবে। ছাত্রদের দেশপ্রেম শেখানোর মধ্যে কোন অন্যায় নেই। বরঞ্চ প্রকৃত দেশপ্রেমের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন । কিন্তু অস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঘৃণার প্রসার ঘটানো শিশুমনকে বিপর্যস্ত করে।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক দল বা কোন অনুপ্রবেশ একেবারেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু সেখানে প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমের ধাঁচে শিক্ষা ব্যবস্থা তিনি চালু করেছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে উপনিষদের ভাবনা তিনি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। উপনিষদের ভাবনায় মানুষ অমৃতের সন্তান। সেখানে জাত, ধর্মের কোন ব্যবধান নেই। শান্তিনিকেতনের ভাবধারা এবং রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে যেসব ছাত্র শৈশব কাটিয়েছেন তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণ ভাবে লিপ্ত থেকেই মুক্তমনা হতে পেরেছেন। সেটাই আমাদের প্রকৃত পরিচয়।
শান্তিনিকেতনের ভাবধারায় গড়ে উঠেছিল কলকাতার পাঠভবন স্কুল। গড়ে তুলেছিলেন উমা সেহানবিশের মতো শিক্ষাবিদ । তাঁর একটি রাজনৈতিক পরিচিতি অবশ্যই ছিল। সিপিআইয়ের সমর্থক এবং ওই পার্টির বিশিষ্ট নেতা চিন্মোহন সেহানবিশের স্ত্রী ছিলেন তিনি । সেটা বড় কথা নয়। একদিকে বামপন্থী রাজনৈতিক ভাবনা, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তিনি । ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেম এবং তার সাথে বিশ্ব ভাবনার মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়েছিলেন। ঘৃণা নয়, ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন উমাদি। আমাদের অনেক সৌভাগ্য তাঁর সংস্পর্শে আসতে পারা। ওই স্কুলের ছাত্র হিসেবে আমরা শিখেছিলাম, দেশ মানে যেমন ভূখণ্ড তেমনি দেশের মানুষ। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ভালবাসতে পারার নামই দেশপ্রেম । শিখেছিলাম বামপন্থার উচ্চ আদর্শ । সবকিছু দখলদারির কৌশল নয়।
মনে পড়ে, 1984 র নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ইন্দিরা হত্যার পর সারাদেশে আগুন জ্বলছে। দিল্লিতে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনেকে নিহত হয়েছেন। কলকাতার পরিস্থিতি আপাত শান্ত হলেও শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন। এর মধ্যেই একদিন সকালের প্রার্থনা সঙ্গীতের পর আমাদের গণিতের শিক্ষক দীপঙ্করদা নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে বোঝালেন যে প্রধানমন্ত্রীর হত্যা যতটা দুঃখের, তেমনই দুঃখবহ দেশের পরিস্থিতি। আমাদের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সমভাব, সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
আজ এত বছর পরেও ওই শিক্ষাটি মনের মধ্যে ধরা আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির প্রভাব।