রোবটকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেওয়া, আজ নেহাতই সাধারণ ঘটনা। অত্যন্ত দ্রুত সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা artificial intelligence (এ আই)। এ আই কমপ্যাটিবল ডিভাইসের সাহায্যে কথা বলা, গান শোনা, কাজের তালিকা বানানো থেকে অ্যালার্ম সেট, গল্পের বই পড়ে শোনানো, ট্র্যাফিকের হাল জানা কিংবা সাম্প্রতিক খবরাখবর, এখন আমার আপনার হাতের মুঠোয়। এমনকী ঘরের আলো বন্ধ করা কিংবা পাখা চালানোর জন্যেও এখন আর সুইচ বোর্ডের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। এ আই কমপ্যাটিবল ডিভাইসে একবার হুকুম করলেই, অদৃশ্য আলাদিনের জিনি, সব কাজ করে দেবে নিখুঁতভাবে। কিন্তু জানেন কি, এই একটি ছোট্ট যন্ত্রকেই ভবিষ্যতে লাখ লাখ মানুষের চাকরি হারানোর মূল কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে? এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ আরবিআইয়ের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী ভাষণে কর্মসংস্থান নিয়ে কংগ্রেস সরকারের তুমুল সমালোচনার পাশাপাশি নিয়ম করে থাকত, ক্ষমতায় এলে বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি। পাঁচ বছর পর আর একটা নির্বাচনেও হট টপিক সেই বেকারত্বই।
এই অবস্থায় এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কার কথা শোনা গেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের গলায়। তাঁর আশঙ্কা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ আইয়ের বহুল ব্যবহার, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে ডেকে আনতে পারে এক অভূতপূর্ব কর্মসংস্থানের সঙ্কট। এবছর নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরে আয়োজিত ইসিওএসওসি ফোরাম অন ফিনান্সিং ফর ডেভলপমেন্ট শীর্ষক আলোচনায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অফ বিজনেসের ফিনান্সের অধ্যাপক রঘুরাম রাজন, এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বলতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসেন ভারতের প্রসঙ্গ। ভারতের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারে প্রশিক্ষিত কর্মীদের প্রয়োজন ফুরোবে, বলে আশঙ্কা তাঁর। ইতিমধ্যেই বেকারত্বের ভারে নুব্জ ভারতের পক্ষে যা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ আই ব্যবহার করে এমন বেশ কয়েকটি ডিভাইসে বর্তমানে দেশের বাজার ছেয়ে গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি চোখে পড়লেও, এই বিশেষ টেকনোলজিকে মানবতার শত্রু বলে বর্ণনা করছেন টেসলা ও স্পেসএক্স সিইও এলোন মাস্ক। তাঁর মতে, মানব জাতির কাছে পরমাণু বোমার চেয়েও বেশি মারাত্মক এ আইয়ের প্রভাব। এ আইয়ের প্রবল সমালোচকদের মধ্যে রয়েছেন ইনফোসিস কর্ণধার নারায়ণমূর্তিও।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এ আইয়ের সাহায্যে করা যায় না এমন কোনও কাজ নেই। ফলে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শিল্পগুলিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার একবার শুরু হলে, সরাসরি প্রভাব পড়বে সেই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের উপর। মেশিনের সাহায্যে মানুষের কাজ করানো সম্ভব হলে, স্বভাবতই মেশিন ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকবে সংস্থাগুলি। ফলে রাতারাতি বেকার হয়ে যাবেন লক্ষ লক্ষ প্রশিক্ষিত কর্মী। একেই বেকারত্ব নিয়ে নাজেহাল অবস্থা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের। তার উপর প্রযুক্তি কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত করলে, পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, আশঙ্কা রঘুরাম রাজনের।
রাজনের মতে, সমস্ত ধরনের রুটিন কাজে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ব্যবহার শুরু হলেই, সেই কাজ আগে যাঁরা করতেন, তাঁদের প্রয়োজন ফুরোবে। একমাত্র সৃজনশীল কাজ করতে মানুষের প্রয়োজন পড়বে। বাকি সমস্ত কাজই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে করে দেবে এ আই। এমন কোনও কাজ বা পেশা নেই, যা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে, আশঙ্কা আরবিআইয়ের ২৩ তম গভর্নরের।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করার কথা বলছেন রঘুরাম রাজন। মন কি বাত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদী ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারে যে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান কমে যাবে, তা নিয়ে কোনও ইঙ্গিত তিনি দেননি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এ আই অভিশাপ, আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রাণপুরুষ মহম্মদ ইউনুসও। রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে এবিষয়ে গাইডলাইন তৈরিরও দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের এই নোবেলজয়ী।
Comments are closed.