অসীমানন্দের বেকসুর খালাস হয়ে গেল। ১১ বছর আগে মক্কা মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রধান নায়ক তথা চক্রান্তকারীকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারল না দেশের আইন। সেদিন ছিল জুম্মাবার, দুপুবেলা হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান মিলিত হয়েছিলেন নামাজ আদায় করতে। মসজিদের সামনেটা ছিল লোকে লোকারন্য। সন্ত্রাসবাদী হামলাটা তখনই হয়। ১৪-১৫ জন মারা যান। আহত হন শতাধিক। একটি মুসলিম জেহাদি সংগঠনের নামে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এক হাজার নিরীহ মানুষ গ্রেপ্তার হল। শুরু হয় অনুসন্ধান।
ক্রমেই প্রকাশ হয়, অভিনব ভারত নামে আরএসএসের একটি অল্প খ্যাত সংগঠন বদলা নিতে, মুসলিম সন্ত্রাবাদীদের শিক্ষা দিতে, সর্বোপরি ভারতের কোটি কোটি মুসলমানকে সমঝে দিতে এই কান্ড করেছে। তার নেতা অসীমানন্দ। তিনি এবং তার সঙ্গীরা গ্রেফতার হলেন। এবার বেকসুর ছাড়া পেলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণই নাকি পাওয়া যায়নি। পুত্রহারা মাতার আর্ত কন্ঠস্বর আমাদের সবার কানে পৌঁছেছে কিনা তা বলতে পারবো? যিনি বলছেন ১১ বছর আগে আমার ছেলে শহিদ হয়েছে, এবার আইনটাও গেল। সেদিনের সন্ত্রাসবাদী হামলায় শহিদ মহম্মদ সেলিমের মা জাহানাহ বেগমের আর্তস্বর আজ সারা ভারত জুড়ে ধ্বনিত।
এটা নতুন কিছু নয়। সমঝোতা এক্সপ্রেস ,আজমেঢ় শরিফের নাশকতামূলক কাজে যারা যুক্ত তারাও ছাড়া পেয়ে গেছে। সবাই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মী ও নেতা। সম্প্রতিকালেও একই ঘটনা ঘটেছে। মুজফরনগরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে কয়েশ আরএসএস কর্মীর সাজা হয়, তারা জেলে ছিলেন । নতুন করে বিচার শুরু করে বেশিরভাগকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দাঙ্গা কার্যত হয়েছিল একতরফা । মুসলমানরা হিন্দুত্ববাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল। এখনও বহু মানুষ ক্যাম্প থেকে ফিরে আসেনি। উনাতে দলিতদের উপর পাশবিক আক্রমণ করে যারা অন্তত জেললাভ করেছিল, তারাও ছাড়া পেয়ে গেল।
মুল প্রশ্নটি হলো ধর্মের পরিচয় বা রাজনীতির পরিচয় দেখে অপরাধের বিচার হবে কিনা? এ ব্যাপারে অন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল কিনা? হিন্দুত্ববাদের গেরুয়া পতাকা যারা কাঁধে নিয়ে চলেছে তারা যাই করুক না কেন, যত ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদী হোক না কেন, কোনও আইনের জালে ধরা পড়বে কিনা। ২০০৬-২০০৮ সালের মধ্যে অন্তত পাঁচটি সন্ত্রাসবাদী হামলায় যুক্ত অভিনব ভারত। তাদের নেতা সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং, কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত, দেবেশ গুপ্তা, লোকেশ শর্মা কোনও না কোনও মামলায় অভিযুক্ত। অথচ দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আজকের বিজেপি হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা। বিশেষত যা আরএসএসের কাছ থেকে প্রাপ্ত। এই আগ্রাসী রাজনীতি একদিকে ভর করেছে উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর, অন্যদিকে অসহিষ্ণুতা, হিংসা ও বিদ্বেষের ওপর। অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর, বিশেষ করে মুসলমানদের উপর হিংসা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে, এমনকি সশস্ত্র হামলা ও দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। মুসলমান ভীতি তৈরি করতে চায়। ফ্যাসিবাদী কৌশল ছাড়া এটা আর কিছুই নয়। অনেকে এটাকে কর্তৃত্ববাদ বলে আত্মতপ্তি পেতে পারেন। কিন্ত তাদের মুখ মরুভূমির বালিতে গুঁজে রেখেও ঝড় আটকাতে পারবে না।
মক্কা মসজিদ মামলাতে আবার ফিরে আসলে চাই। এনআইএ নতুন আইনে গর্বিত সংস্থা। বিজেপি ফ্যাসিবাদ কায়েম করার স্বার্থে তাকে ব্যবহার করছে। এই মামলায় যে উকিল লাগিয়েছে তিনি একজন বহু পুরাতন সংঘ কর্মী। মামলা সম্পর্কে জ্ঞাত নন। যিনি বিচারক তিনি রায় ঘোষণার পরেই পদত্যাগ করলেন । পদত্যাগ পরবর্তী প্রতিটা বাক্যে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, কতখানি চাপ তিনি সহ্য করেছেন। ফ্যাসিবাদের অন্য সংজ্ঞার কী দরকার?
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পালটে যাবে ,সমস্ত স্থাপত্যের গেরুয়াকরণ হবে। সংখ্যালঘু মুসলমানসহ দলিতদের চূড়ান্ত প্রান্তিক করে দেওয়া হবে। সংবিধান পাল্টানোর খসড়া হবে। আইন আদালতকে মুড়ে দেওয়া হবে গেরুয়া রঙে আর আমরা তত্ত্ব আলোচনায় ব্যস্ত থাকবো ফ্যাসিবাদ আসবে বলে। তারপর লড়াই শুরু করার বন্ধু জোটানো হবে।
সামান্য ক্ষমতাটুকু থাকবে না, সেটা বোঝার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন বহু প্রজ্ঞাবান। তাঁদের প্রতি করুণা ছাড়া কিছু করার নেই। মক্কা মসজিদের মামলার রায় আমাদের সেই চেতাবনী দিচ্ছে, যে চেতাবনী অতীতে একবার পেয়েছিল জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি হিটলারের উত্থানের আগে। সারা পৃথিবীকে তার মূল্য দিতে হয়েছে। ভারত এখন সে দিকেই তাকিয়ে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)