ঐতিহাসিক সংকট! বাঙালির জাতীয় সংকট! রাষ্ট্রের কলমের খোঁচায় রাষ্ট্রহীন প্রায় ৪০ লাখ বাঙালি। কি হিন্দু, কি মুসলিম-ফের বিপন্ন বাঙালি। অসমের পরিস্থিতি ভয়াবহ, আরও একবার উদ্বাস্তু হবে বাঙালি। শুধু এনআরসি থেকে নাম বাদ পড়া না, ডি-ভোটার সন্দেহে ডিটেনশন ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনেককে। রেহাই নেই বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কারওরই। ১০২ বছরের বৃদ্ধ চন্দ্রধর দাসকে অমানবিকভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে ভয়ে আতঙ্কে আত্মহত্যা করছেন অনেকে, অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এমনকী মহিলাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চলছে। ২০১৮ তে দাঁড়িয়ে এই ডিটেনশন ক্যাম্প ১৯৩০-১৯৪০ এর নাৎসি জার্মানির স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
গত ৩০ শে জুলাই অসমে নাগরিকপঞ্জি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এই এনআরসি বৈধ ভারতীয়ের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া, সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হচ্ছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে এবং ইতিহাসের দিকে নজর দিলেই সব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজ সালটা ২০১৮, চলুন ফিরে যাই ১৮৭৪ এ। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভেঙে অসমের জন্ম দেয় ব্রিটিশ সরকার। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার একটা অংশও চলে যায় অসমে। অর্থাৎ, অসমের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি সেখানকার ভূমিপুত্র। ১৯৪৭ দেশভাগ, একমাত্র সিলেটে গণভোট হয়। অসমীয়া নেতা গোপীনাথ বড়দলৈ চেয়েছিলেন, পুরো বাঙালি এলাকাই পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাক। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয় চা বাগানের শ্রমিকদের। তারপরও সিলেটের একটা অংশ ভারতে আসে, যা অসম রাজ্যের অংশ হয়। তখন থেকেই বাঙালি বিদ্বেষ শুরু!
তারপর পাঁচের দশকে ‘বঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন। ১৯৬১ তে বরাকে রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন হয়। ১১ জন বাঙালির প্রাণ যায়। তারপর সে জিনিস থামেনি, বাঙালি বিরোধী শক্তি আজও নখ-দাঁত বের করেছে। ১৯৮৪ তে জাতি দাঙ্গা হয়, বাঙালিদের ধ্বংস করার জন্য। আসু (All Assam Student Union) অসমজুড়ে বাঙালি বিরোধী আন্দোলন করে, আটের দশকে সে আন্দোলন ছিল মারাত্মক। সেই আসুর নেতা, সর্বানন্দ সোনওয়াল আজ অসমে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী। বাঙালি বিরোধী অসম গণ পরিষদের (আসু থেকেই জন্ম গণ পরিষদের) সাথে জোট করে ক্ষমতায় বিজেপি। দীর্ঘদীন খেলাটা ছিল অসমিয়া বনাম বাঙালি। এখন আরও একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বিজেপি-আরএসএসের কল্যাণে, হিন্দু বনাম মুসলিম। আসলে বাঙালির মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে অসমীয়াদের স্বার্থসিদ্ধি এবং সে লক্ষ্যে হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্বের লোভ দেখানো, যার নাম ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল’।
সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে, কিন্তু অসমে এনআরসি’র কর্মী কারা? ডি ভোটারের নোটিশ দিচ্ছে কারা? ঠিকা কর্মী, অস্থায়ী কর্মী ও স্থানীয় প্রশাসন। তারা তো বাঙালি বিদ্বেষি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তো তীব্র বাঙালি বিদ্বেষি, বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের নেতা। এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, সুপ্রিম কোর্টে ২২ জন বিচারকের মধ্যে একজন অসমীয়া। তিনি রঞ্জন গগৈ। তিনি কীভাবে অসম সংক্রান্ত সব কেসের দায়িত্ব পান? এটা কি কাকতালীয়? এছাড়া, আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যে ডকুমেন্টস চাওয়া হয়েছিল বৈধ নাগরিকত্বের জন্য, তা ছিল না লাখ লাখ অসমীয়ার কাছেও। তাই অসমীয়াদের বাঁচাতে নতুন কোটা আসে, ওরিজিনাল ইনহ্যাবিট্যান্ট (OI)। খিলঞ্জীয়া বলে অসমীয়াদের এমনিই নাগরিক তালিকায় নাম নথিভুক্ত হয়, কিন্তু বাঙালিদের জন্য সে নিয়ম প্রয়োজ্য নয়।
লাখ লাখ মুসলমান বাঙালির যেমন নাম নেই, তেমনি লাখ লাখ হিন্দু বাঙালিরও নাম নেই নাগরিকপঞ্জিতে। অর্থাৎ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির নাম নেই। নাম বাদ পড়েছে বোড়ো, কোচ, নেপালি, রাজবংশী, মনিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া এবং মনিপুরী জাতিভুক্ত মানুষদেরও। তবে জনসংখ্যার বিচারে তাদের সংখ্যা অনেকটাই কম। ১৯৭১ এর আগের বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও নাম নেই অসংখ্য হিন্দু বাঙালির। নাম বাদ গেছে ৩০ বছর দেশের জন্য গুলির সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করা সেনা জওয়ানের। নাম নেই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পরিবারের, নাম নেই বর্তমান বিধায়কেরও। আবার একই পরিবারের কারওর নাম আছে, কারওর নেই। কীভাবে সম্ভব? একটাই কারণ, বাঙালি বিদ্বেষ, বাঙালিকে অত্যাচার করা, বিপদে ফেলা। বাঙালিকে উদ্বাস্তু করতে চায় ওরা। গত ৩০ তারিখ তালিকা প্রকাশের দিন আসুর নেতাদের মিষ্টিমুখ করে আনন্দোৎসব আমরা দেখেছি। একদিকে মিষ্টিমুখ, অন্যদিকে ভয়ে-আতঙ্কে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য প্রহর গোনা রাষ্ট্রহীন নাগরিকদের উৎকন্ঠা। গতকালই খবরে দেখেছি, তালিকায় নাম না থাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক বাঙালি রিক্সা চালকের।
বাংলার বাঙালির জাতীয় কর্তব্য অসমের বাঙালির জন্য পথে নামা। এ রাজ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ উঠছে, বাঙালি সংগঠিত হচ্ছে। বাঙালি বিরোধী অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে মানুষ জাগছে। দাবি স্পষ্ট, অসমের বাঙালিকে উদ্বাস্তু করা যাবে না, অন্যান্য রাজ্যেও বাঙালি নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। অসমেই বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এবং ডিটেনশন ক্যাম্প বন্ধের দাবিও জোরালো হচ্ছে।
বাঙালি ১৯৪৬-১৯৪৭ এ হেরে গেছে সাম্প্রদায়িকতার কাছে, বাঙালি বারবার হেরেছে। আজ ভারতের বাঙালির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। গোটা উত্তরপূর্ব ভারতে বাঙালিদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, বিজেপি সরকারে আসার পর এই সব রাজ্যে বাঙালি আতঙ্কে। এবার আর হেরে যাওয়া নয়। প্রয়োজন সমবেত প্রতিবাদ, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের। বাঙালি জাতির জাতীয় সংকটের সময় নতুন এক ইতিহাস রচনার সময় আজ!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)