সিপিএমের জন্ম থেকে দুটো লাইনের কথা চলে আসছে-বেঙ্গল লাইন আর কেরালা লাইন। একেই বোধহয় বলে জন্ম-জড়ুল। সেই কেরালা কিন্তু এখন সারা দেশে আলোচ্য। যাকে বলা হয় টক অফ দ্য স্টেট। ঠিক যেমন ২০০৭’এ বাংলার ওপর ছিল গোটা দেশের নজর। দ্বিধা থর থর চিত্তে তখন সচেতন ভারতীয় একে অপরকে জিজ্ঞাসা করছিল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পারবেন তো? নাকি…! এখন সেই ভারতীয়ই বলছেন, হিম্মত দেখাচ্ছেন বটে পিনারই বিজয়ন। ইতিহাস নতুন করে লেখা হল সাবরীমালা মন্দিরের গর্ভগৃহে। গত সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের গর্ভে সেই ইতিহাসের জন্ম হয়েছিল, কেরালা বাম সরকারের ভূমিকায় সেই ইতিহাসে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। ঋতুমতী বিন্দু ও কনকদুর্গা সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন।
সুপ্রিম কোর্ট সাবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী মহিলাদের প্রবেশাধিকার পুনঃস্থাপিত করার পর এই প্রথম দুই নারী পা দিলেন মন্দিরের গর্ভগৃহে। পুরুষতস্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের কফিনে প্রথম পেরেক পুঁতলেও তার পিছনে রয়েছে বিপুল জনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। তবু এটা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ হবে যে, পুরুষতন্ত্র পরাজয় স্বীকার করে নেয়নি। কেননা, ওই দুই মহিলা আয়াপ্পা দর্শন সেরে বেরিয়ে আসার পরই গর্ভগৃহের দরজা এক ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। মন্দিরের শুদ্ধিকরণ করেন পুরোহিতরা। ফের শশীকলা মন্দিরে পুজো দিয়েছেন ১৮ সিঁড়ি ভেঙেই। একেই বলে মানবতার জয়। জয় বামপন্থার। কেননা এক দুর্মর দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন কেরালার প্রশাসনিক প্রধান পিনারই বিজয়ন। তিনি আয়াপ্পার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আদালত অবমাননার। এমনকী, চাইলে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। বিজয়নের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন প্রধান পুরোহিত। আদালত তাঁর বক্তব্য শুনেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের বিরোধী হতেই পারেন। কিন্তু সাবরীমালার প্রধান পুরোহিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আদালত অবমাননা করতে পারেন না। যেখানে শীর্ষ আদালত মন্দিরের ভেতর মহিলাদের প্রবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন, তিনি চাইলে তাঁর পদ ছাড়তে পারেন।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না, মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন কোনও মহৎ কাজ করেছেন। তিনি রাজধর্ম পালন করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত আদেশ করেছিল, সব বয়সী মহিলাকে সাবরীমালা মন্দিরে প্রবেশ করতে দিতে হবে। আর প্রশাসনকে বিবিক্ষু মহিলাদের মদত করতে হবে। বিজয়ন প্রশাসন সেই কাজটিই করেছে। আর এই কাজটি করতে গিয়ে কেরালার বাম সরকার যা করেছে, তাকে বলে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাজ। মাঠে নামিয়েছে সবকটি বাম দলকে এবং তার শাখা সংগঠনগুলোকে। নামিয়েছে ‘হাওয়াই চটি পরিয়ে হাতে বন্দুক ধরিয়ে’ নয়, পাল্টা গণ আন্দোলনে।
কেরালাজুড়ে যখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ও তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপি সাবরীমালা মন্দির নিয়ে হুমকি দিচ্ছে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে, কংগ্রেস যখন নিজের
রাজনৈতিক অস্তিত্ব আরও দৃঢ় করতে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছে, ঠিক তখনই লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমানাধিকারের লক্ষ্যে তিরুবনন্তপুরমে কেরালার প্রায় ৫০ লক্ষ মহিলা ১৪ টি জেলায় ৬২৫ কিলোমিটার পথজুড়ে ইতিহাস নির্মাণ করে গড়ে তুললেন নারী প্রাচীর। সম্মিলিত স্বরে তাঁরা বিশ্ববাসীকে জানালেন, ‘আজকের নারী আর অবলা নয়। অসূর্যস্পশ্যা নয়, এমনকী, পুরুষের থেকে কোনও অংশে কম নয়, তাই তাঁকে কোনও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ সেই প্রবল ও স্বতস্ফূর্ত জমায়েত ও প্রতিবাদের পর বিন্দু ও কনকদুর্গা অচলায়তন ভেঙেছেন। তাঁরা দেখিয়ে দিলেন, পুরুষতন্ত্রের দুর্গ আপাত দৃষ্টিতে যতই দুর্ভেদ্য বলে মনে হোক না কেন, তা অজেয় নয়। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম জারি রাখলে, নিজের প্রতিজ্ঞা অটুট রাখলে বসন্তের সব সম্ভাবনাই থাকে পত্রহীন বিষুষ্ক শাখায় আর ক্রমাগত আঘাতে দুর্গের গায়ে ফাটল ধরেই। আর রক্ষণশীল চিন্তার উগ্র সমর্থক ও পাণ্ডাদের কাছে মাথা নোয়ায়নি পিনারই বিজয়নের নেতৃত্ব বাম সরকার ও বিজয়নের দল সিপিএম। সেই সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারকে উৎখাতের ডাক দিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ স্বয়ং। এই পরিস্থিতিতে সাবরীমালা ইস্যুই সেই রাজ্যে বিজেপির অন্যতম ভরসা। একদিকে ধর্মীয় ভাবাবেগ, অন্যদিকে শাসক বাম সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে খর্ব করার অভিযোগকে সামনে রেখে রাজ্যজুড়ে অল আউট আন্দোলনে নেমেছে বিজেপি। এমনকী, কংগ্রেসের ভাবুক নেতা তথা সাংসদ শশী থারুর মন্তব্য করেছেন, সাবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ অপ্রয়োজনীয় এবং প্ররোচনামূলক।
এই অবস্থায় নিজের সরকারকে বাজি রেখে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় নেমেছেন বিজয়ন। কেউ কেউ বলছেন, কোনও একটি মন্দিরে সব বয়সী মেয়ের প্রবেশাধিকারের লড়াই কী এমন গুরুতর বিষয়। রাজ্যে কি এর চেয়ে জরুরি কিছু বিষয় সেই? অবশ্যই আছে কমরেড। কিন্তু, মনে রাখবেন, সমাজ প্রগতির ভাবনা কোনও পরিসরকেই অকিঞ্চিৎকর বলে মনে করে না। বিশেষ করে সমাজ পরিবর্তনের পূজারিরা মনে করেন, কোনও ক্ষেত্র মেয়েদের জন্য অবরুদ্ধ থাকলে সেই বাধাকে চূর্ণ করা অন্যান্য ক্ষেত্রে সংগ্রামগুলোর সাফল্যের জন্যও জরুরি। নইলে সামাজিক লড়াইটাই দুর্বল হয়ে যায়। এই সার বোঝাটা বুঝেছেন বিজয়নরা। তাই ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের মাত্র তিন-চার মাস আগে এমন একটি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে হ্যান্ডেল করা রীতিমতো ট্রাজেডি হতে পারে বামদের কাছে জেনেও পিছিয়ে যাননি। সাবরীমালা ইস্যুতে কেরালা আড়আড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। পাঠক মনে রাখবেন, ১৯৫৭ সালে এই কেরালাতেই ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বে এদেশে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার তৈরি হয়েছিল, আর সেই সরকার পূর্ণমেয়াদ থাকতে পারেনি, ১৯৫৯ সালেই পতন হয় এই রকমই এক সামাজিক কারণে। সেদিন বিশ্বে প্রথম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা কমিউনিস্ট সরকারের এডুকেশন বিলের বিরুদ্ধে একদিকে ক্যাথলিক সম্প্রদায়, অন্যদিকে, নায়ার সম্প্রদায় পথে নেমেছিল। তার ওপর ছিল ই এম এস সরকারের কৃষি বিলের বিরোধিতায় বড় জমির মালিকরা। পেছন থেকে মদত করেছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। শেষে মেয়াদ ফুরোবার তিন বছর আগেই আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলে দেশের প্রথম কমিউনিস্ট সরকারকে খারিজ করল জওহরলাল নেহরুর সরকার। বিজয়নদের ঝুলিতে সেই অভিজ্ঞতা আছে। ফলে বিজয়ন খুব ভাল জানেন, কুরবানি দিতে হতে পারে তাঁর সরকারকে। তবু রাজধর্মে অবিচল বিজয়ন। নিষ্ঠা এরে বলে।
আর এখানেই, ভিন্ন পরিসরে আমাদের রাজ্যে বিজয়নের সতীর্থদের লবেজান চেহারা দেখেছি এক দশক আগে। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’, এমন স্বপ্ন জাগানিয়া স্লোগান তুলেও কয়েক বছরের মধ্যে আত্মসমর্পণ করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর সহকর্মীরা! বিধানসভায় ২৩৫ টা আসন জিতে আসা বুদ্ধদেবদের ২০০৬’এর ভোটের আগে দাপুটে কণ্ঠস্বর, ‘আমরা ছাড়া সরকার হয় না’। অথচ তার দু’বছরের মধ্যে না পারলেন টাটাকে রাখতে, না পারলেন সরকারকে বাঁচাতে। স্রেফ প্রশাসনিক দৃঢ়তার অভাবে আর কর্তব্যে অনড় থাকার অভাবে আমাদের এই পাণ্ডববর্জিত রাজ্যে যে শিল্পসম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছিল, তা নিভে গেল। যখন উচিত ছিল গোটা দলটাকে মাঠে নামিয়ে জনতার শৃঙ্খলে শিল্পবিরোধী শক্তিকে আবদ্ধ করে রাখা, তখন তা না করে বড় বেশি কথায় আস্থা রাখতে চাইলেন। মূলত সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানা করার কাজ যে স্তর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে গুটিয়ে নিতে হয়েছে, তা কোনও প্রশাসনের পক্ষেই সম্মানের নয়। মানছি যে তীব্র আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছিল, আন্তর্জাতিক স্তরেও চাপ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু রাজ্য সরকারের শিল্প ভাবনার পাশেও ছিল রাজ্যবাসীর বিরাট অংশের সমর্থন, সর্বোপরি বুদ্ধদেব-নিরুপমদের হাতে ছিল একটি শক্তিশালী পার্টি। ট্রাজেডি এটাই, সেই পার্টি শুধু বিরোধী দলগুলোকে কটাক্ষ আর ব্যঙ্গ করেই কাটালো। ইস্যুটাকে যথাযথ অ্যাড্রেস করতে পারল না। আজও বুঝে উঠতে পারি না, সিঙ্গুর-বিরোধী আন্দোলনের কর্মী-নেতারা যখন দুর্গাপুর হাইওয়ে জুড়ে বিক্ষোভ অবস্থান করছিলেন তখন তা দমন করার দৃঢ়তা কেন দেখাতে পারল না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরিচালিত রাজ্য প্রশাসন। কেন পারল না কেরালা যেমন পারল ৬২৫ কিলোমিটার নারী-প্রাচীর তুলে দাঁড়াতে, তেমন কোনও মানব-প্রাচীর তুলতে! এমনকী, আদালত যখন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানায় যাওয়ার অবরুদ্ধ পথ মুক্ত করার আদেশ দিল, তখনও তা কার্যকর করার মতো তৎপরতা দেখাতে পারল না বুদ্ধদেবের একচ্ছত্র প্রশাসন। যদিও তার আগেই নন্দীগ্রামে এস ই জেড করতে গিয়ে জবর ধাক্কা খেয়েছে সিপিএম। ১৪ মার্চের পর দিশেহারা আলিমুদ্দিনের কর্তারা। সূর্যোদয় ঘটাবার পাল্টা ধিক্কার মিছিলে নড়ে গিয়েছে সিপিএমের ভিত। পাল্টা মিছিল করেও সামাল দিতে না পেরে বুদ্ধদেব ফের ‘নোটিশ ছিঁড়ে’ ফেলার মতো ছেলেমানুষির পরিচয় দিয়েছেন। আসলে কবির মন নিয়ে মার্কোয়েজ অনুবাদ করা যায়, চাণক্য বুদ্ধি ও স্তালিনীয় দৃঢ়তা দেখানো যায় না। সংবেদনশীল মন নিয়েও প্রশাসককে প্রয়োজনে রূঢ় হতে হয়। বুদ্ধদেব তা না দেখিয়ে ফিরে এলেন রাজভবনে আলোচনার টেবিলে। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর অতিসক্রিয়তায় রাজি হয়ে সিঙ্গুর সমস্যা সমাধানের জন্য বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক ও চুক্তিপত্র তৈরি করাই বুদ্ধদেবের দৃঢ়তাকে লঘু করে দিল।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়যাত্রার সেটাই প্রারম্ভিক বিন্দু। বুদ্ধদেব বনাম মমতা চর্চার টার্নিং পয়েন্ট। ওখান থেকেই মমতা বাংলার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণের লাগাম নিজের হাতে তুলে নিলেন। তারপর থেকে যে তিন বছর বাম সরকার ছিল, সেই সময়ের বাংলার ঘটমান বর্তমানের ওপর আর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না বুদ্ধদেব বা তাঁর দলের। আর টানা ক্ষমতায় থাকার মধ্যে দিয়ে দলেরও ডিএনএ পাল্টে গিয়েছিল। তাই মসনদে না থাকা সিপিএম অতীতের কঙ্কালসার মাত্র। রাজনৈতিক নৈপুণ্যের অভাবে সম্ভবত দলটির ওপর তখন কারও কর্তৃত্বই আর নেই।
আজ তাই কেরলের বাম সরকারকে দেখে মনে হয়, বাংলা সিপিএমে যদি একজন পিনারাই বিজয়ন থাকতেন!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.