পুজোতে ঢাক বাজে না, ৩০০ বছর আগেই যেন থমকে রয়েছে সময়; জানুন, সুরুল জমিদার বাড়ির পুজোর অজানা কথা  

কাগজে কলমে পুজোর বয়স ২৮৮ বছর। ধর্ম হারিয়ে সময় যেন এখানে থমকে দাঁড়িয়েছে। সেই শুরুর দিনগুলোতে যে রীতি মেনে পুজো হত, দীর্ঘ ২৮৮ বছর ধরে তার পরিবর্তন ঘটেনি। সাবেকিয়ানায়, অভিজাত্যে রাজ্যের বনেদী বাড়ির পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম সরুল জমিদার বাড়ির পুজো। কলকাতার চৌহদ্দি পেরিয়ে, নির্মল প্রকৃতির মাঝে যদি আপনি পুজো কাটাতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে বোলপুরের সুরুল জমিদার বাড়িতে একবার ঢুঁ মারতে হবে। জেলার প্রাচীন এই পুজো নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন সরকার বাড়িরই সদস্য অভিনব সরকার। 

প্রাচীন পুজো নিয়ে একগুচ্ছ চমকপ্রদ তথ্য দিলেন অভিনব। জানান, তাঁদের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, পুজোতে ঢাক বাজানোর রীতি নেই। পুজোর ক’দিন ঢোল, কাঁসি, সানাই। সানাইয়ের সুরেই পঞ্চমীতে দেবীর আগমণ আর সানাইয়ের সুরেই দশমীতে দেবীর বিসর্জন। সেই সাথে অভিনবর থেকে এও জানা গেল, পাঁচ খিলানের ঠাকুর দালান, থাম যুক্ত নাট মন্দিরে, কোনও স্থানেই পুজোর চার দিন বৈদ্যুতিন আলো ব্যবহার করা হয়না। পুজোর কদিন ঠাকুর দালান সেজে ওঠে নানান রঙের কাঁচের ফানুস আর বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতিতে। ঝাড়বাতি এবং রঙিন ফানুসে রেড়ির তেলের কুপি ব্যবহার করা হয়। প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকেই চলে আসছে এই প্রথা। তাঁর কথায়, “সময়ের সাথে গ্রাম বাংলার একাধিক পুজোয় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও, সরকার বাড়ির সদস্যরা অতীতের সেই ঐতিহ্য, রাজকীয় জৌলুষ ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটাই আমাদের বাড়ির পুজোর প্রধান আকর্ষণ।”

সুরুল জমিদার বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, এই পরিবারের আদি নিবাস বর্ধমান জেলার নীলপুর অঞ্চলে। অষ্টাদশ শতকের গড়ার দিকে সুরুলে চলে আসেন পরিবারের আদি পুরুষ ভারতচন্দ্র ঘোষ। ভরতচন্দ্রের কোনও সন্তান ছিল না। সুরুলে গুরুদেবের বাড়ি আসার পর ভরতচন্দ্রের এক পুত্র সন্তান হয়। তখন থেকেই সুরুলে স্থায়ী বসবাস শুরু। 

১৭৮২ খ্রী: সুরুলে ব্যবসা করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম রেসিডেন্ট জন চিফ। ভরতচন্দ্র জন সাহেবের সঙ্গেই ব্যবসা শুরু করেন। সরকার পরিবারের মূল আয় ছিল নীল চাষ থেকে। এছাড়াও জাহাজের পাল তৈরির কাপড়, চিনির ব্যবসাও ছিল সরকার পরিবারের। পরে এই পরিবারের আরেক কর্তা ব্রজবল্লভের পুত্র শ্রীনিবাস সরকারের আমলে সরকার পরিবার ফুলে ফেঁপে ওঠে। ওঁর আমলেই প্রাচীন এই পুজোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। 

পুরোনো প্রথা মেনেই পুজোর সপ্তমীতে চালকুমড়ো, অষ্টমীতে পাঁঠা এবং নবমীর দিন আখ বলি হয়। তবে প্রাসাদে অন্ন ভোগ থাকে না। পুজোর চার দিনই চাল ও ফলের নৈবেদ্য এবং লুচি ও হরেক রকমের মিঠাই ভোগ থাকে। কাছারি বাড়ির রন্ধন শালায় ভিয়েন বসে। সেখানেই ভোগ রান্না হয়। সরকার পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। প্রত্যেকেই পুজোর কদিন একত্রিত হন। দশমীতে সুরুল জমিদার বাড়ির বিসর্জনের শোভাযাত্রাও হয় দেখার মতো। বিসর্জনের শেষে জমিদার বাড়ির সদস্যরা শাঁখ বাজিয়ে শঙ্খ চিলের আহ্বান করেন। আজও পরিবারের সদস্যরা মনে করেন শঙ্খ চিলের দেখা পাওয়া শুভ লক্ষণ। 

শহরের ভীড় থেকে দূরে লাল মাটির রাস্তা, কাশ বন সহযোগে নির্মল গ্রাম্য প্রকৃতির মাঝে প্রাচীন পুজো। ইতিহাস ও উৎসবের এক অভিনব মেলবন্ধন। একটু অন্যরকম পুজোর আমেজ পেতে চাইলে সুরুল জমিদার বাড়ির পুজো আপনার আদর্শ ঠিকানা হতে পারে। কলকাতা থেকে যাওয়াও খুব সহজ। শান্তিনিকেতনের খুব কাছেই সুরুল জমিদার বাড়ি। এছাড়াও বোলপুর স্টেশনে নেমে যে কোনও টোটো চালককে বললেই আপনাকেই পৌঁছে দেবে গন্তব্য। ৩০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে টাইম মেশিনে চাপবেন নাকি? 

ছবি- অভিনব সরকার

 

Comments are closed.