কিষেণজি মৃত্যুর নেপথ্যে

তখন আমি ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলে। অক্টোবর মাসের সেই দিনটায় সকালে যথারীতি কাজে এসেছিলাম। এসে দেখলাম অফিসে একটা চাপা উত্তেজনা। ভাবলাম, হয়তো কোনও পলিটিক্যাল ডেভলপমেন্ট হয়েছে। কিন্তু দেখলাম সে সব কিছু নয়। ভারতের হয়ে ব্যাট করতে নেমেছেন স্বয়ং শচিন তেন্ডুলকর। আর শচিন যেহেতু তখন রেকর্ডের মুখে দাঁড়িয়ে ফলে সবার চোখ টিভির দিকে। আমিও বসে পড়লাম টিভির সামনে। মাত্র কয়েকঘণ্টা। তারপরেই হঠাৎ করেই সে দিন আউট হয়ে গেল শচিন। সবার সামনে প্রকাশ করতে না পারলেও আমার আনন্দ কম হচ্ছিল না। বুঝে গেলাম আর যাই হোক সেদিনের খেলার খবর আর তেমন গুরুত্ব পাবে না।

সাহস সঞ্চয় করে এডিটর অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাতে গেলাম সেই তথ্য। ‘মাওবাদীরা রাজ্য সরকারের গঠিত মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়ে দিয়েছে, তারা শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসছে।’ আসলে সরকার পরিবর্তনের পর জঙ্গলমহলের শান্তি প্রতিষ্ঠা ছিল মেজর ইস্যু। ফলে অঞ্জনদার প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গেই। নির্দেশ এল এখনই যত দ্রুত সম্ভব এই খবর ‘ব্রেক’ করতে হবে। সেটা নিয়ে প্রাইম টাইমে শো হবে চ্যানেলে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ২৪ ঘণ্টায় সেই খবর দেখনো শুরু হল ব্রেকিং নিউজ হিসাবে। হইচই শুরু হয়ে গেল সর্বত্র। খোদ সরকারি কর্তাদেরই জানা ছিল না মাওবাদীরা শান্তি আলোচনা ভেস্তে দিয়েছে। আধঘণ্টার মধ্যে তোলপাড় শুরু হল রাজনৈতিক মহলে। আমরা মাওবাদীদের রাজ্য সম্পাদক আকাশের দেওয়া সেই চিঠিটাও একসময় দেখানো শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যানেলগুলিও ঢুকে পড়ল সেই খবরে। কোনও খবর দেখানোর পর তার বিশ্লেষণ করার জন্য যে বক্তব্য ক্যামেরার সামনে দেখানো হয়, তাকে ‘চ্যাট’ বলে। আমার চ্যাট নেওয়ার পর সরাসরি ফোন করলাম সেই মধ্যস্থতাকারী দলের অন্যতম সদস্য সুজাত ভদ্রকে। তিনি জবাব দিলেন, ‘মাওবাদীরা তো দেখছি আমাদের কাছে দেওয়ার আগে চিঠিটা আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ফলে এটা নিয়ে আরও কোনও বক্তব্য থাকতে পারে না। আমাদের যা জানানোর তা পরে জানানো হবে। ‘

 

আসলে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিষেণজির ধারণা হয়েছিল এ বার তাদের দাপট খাটানোর পালা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। তাঁর এটা মনে হওয়ার কারণ পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার যে অংশ নিয়ে জঙ্গলমহল, সেখানকার অধিকাংশ এলাকায় বিরোধীরা দীর্ঘদিন দাঁত ফোটাতে পারত না। কিন্তু মাওবাদীদের দাপটে প্রায় তিনশোজন সিপিএম কর্মী খুনের পর পুরো পরিস্থিতিটাই পাল্টে যায়। কিষেণজি ভাবতে শুরু করেন, তিনিই আসলে ‘কিং মেকার’। আর নিজে যেহেতু চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হন, ফলে তাঁর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল তৃণমূল ক্ষমতায় এসে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে না। অথচ তিনি যা ভেবছিলেন, তার ঠিক উল্টোটাই ঘটল। তবে সেই প্রেক্ষিতটা ছিল একদম আলাদা।

সরকার বদলের পর বুদ্ধিজীবীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের তরফে একটি কমিটি তৈরি করা হয়। তাদের কাজ ছিল মাওবাদীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার জন্য কথাবার্তা চালানো। প্রায় তিন মাস ধরে দু’পক্ষের চিঠি চালাচালি চলছিল। কিষেণজি প্রথম দিকে দলের লাইনের বাইরে গিয়ে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আসলে তিনি চাইছিলেন, সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর পাশাপাশি এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সংগঠনটা বাড়িয়ে নেওয়া। অথচ সব হিসাব পাল্টে যায় পুরুলিয়াতে পর পর দু’জন তৃণমূল নেতা মাওবাদীদের হাতে খুন হওয়ার পর। তা-ও বিষয়টি সামাল দেওয়ার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছিল ঝাড়গ্রামে। এলাকার জনপ্রিয় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা বাবু বোসকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিল তৃণমূল নেতৃত্ব। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, জঙ্গলমহলের সিপিএম নেতা সুশান্ত ঘোষকে কাউন্টার করার মতো একজন নেতাকে সামনে তুলে আনা। এমনিতে মাওবাদী আন্দোলন পর্বে বাবু বোসের সঙ্গে কিষেণজির নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং তাদের মধ্যে সখ্যও ছিল। ফলে দহিজুড়িতে অন্য কোনও দলের নেতারা টিকতে না পারলেও বাবু বোস দিব্যি থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই এলাকায় বিকল্প নেতা তৈরির এই প্যাঁচ কিষেণজিকে চটিয়ে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাবু বোসকে সরিয়ে দিতে হবে। যা ভাবা তাই কাজ। নিজের পার্টি অফিসে মাওবাদী স্কোয়াড সদস্যদের গুলিতে মৃত্যু হয় বাবুর। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগতে থাকা কিষেণজি এরই পাশাপাশি আরও সাহসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

তারপর কী হল? সে সময়ের এক সকালে খবর এল মাওবাদী নেতারা উত্তর কলকাতার উন্টোডাঙ্গা এলাকার একটি জায়গায় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। একা যাব, নাকি অন্য কাউকে নেব? এ সব ভাবতে ভাবতেই ফোন এল টেলিগ্রাফের সাংবাদিক, বন্ধু প্রণব মণ্ডলের। ‘কিরে? যেতে বলেছে তো? আমি বাইরে আছি তুই চলে যাস। ওরা যেটা দেবে আমার জন্যও নিয়ে আসবি। আর একসঙ্গে খবর করব।’ এবার উল্টো চিন্তা। তাহলে সবাই কি জেনে গেল? ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলে সে সময় আমার সহকর্মী সপ্তর্ষির মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। ফলে টেনশন আরও বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যা হওয়ার হবে। গিয়ে তো দেখি। ও সব জায়গায় অফিসের গাড়িতে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কারণ কোনও সাক্ষী রাখা চলবে না। একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার গলির মধ্যে যেতে বলা হয়েছিল আমাকে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম দুপুরবেলা প্রায় জনমানবহীন রাস্তা। কেউ নিই কোত্থাও। তাহলে কি ভুল খবর পেলাম? পকেট থেকে বন্ধ করে রাখা মোবাইল ফোনটি বের করে অন করতে যাচ্ছি। দেখলাম, হঠাৎ করে একটি অটো ঢুকল ওই রাস্তায়। আমার সামনে অটোটি থামতেই ভতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন, যাঁকে আমি চিনি। হাতে একটি দু’পাতার চিঠি তুলে দিয়ে বললেন ‘এটা পড়ে নেবেন। এতেই সব বলা আছে। আমরা আজই কমিটির মেম্বারদের এটা পাঠিয়েছি।’ আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কে কে পেয়েছে এই ছিঠির কপি?’ ওই প্রতিনিধির জবাব এল,’শুধু আপনাকেই দিয়েছি। দাদা (কিষেণজি) তাই বলেছেন। আর একটা কপি দিচ্ছি, এটা প্রণবদার জন্য। তবে খবরটা দু’একদিন বাদে করাই ভালো। নাহলে সবাই ভাববে আমরা দিয়েছি।’ ডিল ফাইনাল হয়ে গেল। ফিরে এলাম অফিসে। সেই চিঠি তালাবন্ধ করে রেখেও দিলাম অফিসে, নিজের ড্রয়ারে। তারপর থেকে সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি।

শচিন খেলছেন, ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। রোজই মনে হচ্ছে, অন্য কেউ পেয়ে যাবে না তো? যাঁরা চিঠি দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও সম্ভবনা নেই। কাজেই একরাশ টেনশন চেপে রেখে বাড়ি ফেরা। ওই সমায় অবশ্য বন্ধুসুলভ আচরণ দেখালো প্রণব। চাইলে ও কাগজে খবরটা করে দিতেই পারত। কিন্তু স্রেফ আমার কথা চিন্তা করে আগে খবরটা করল না।

শেষ পর্যন্ত বহু অপেক্ষার পর এল সেই দিন। সারা ভারতবাসীকে আশা জাগিয়ে শুরু করলেও শচিন আউট হয়ে গেলেন ভালো খেলেও। এক মিনিটও অপেক্ষা না করে এবার ড্রয়ার থেকে বার করে আনলাম সেই চিঠি। আধঘণ্টার মধ্যেই সেই চিঠি নিয়ে শুরু হল তুমুল হই-চই। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকারি তরফে বিবৃতি দেওয়া হল। সরকারও জানাল, শান্তি আলোচনা ভঙ্গ করে দেওয়ায় এ বার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযান করবে তারা। কয়েক মিনিটের মধ্যে দেশের সবক’টি নিউজ চ্যানেল ঢুকে পড়ল ওই একটি খবরে। পরের দিন এরাজ্য থেকে প্রকাশিত সব কাগজেও সেটাই লিড নিউজ।

ঠিক একমাস পর ২৪ নভেম্বর ২০১১। যৌথ বাহিনী দাবি করল, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গিয়েছেন এ রাজ্যের মাওবাদীদের শীর্ষনেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি!

ব্রেকিং নিউজ
এক ক্রাইম রিপোর্টারের নোটবুক

চিত্রদীপ চক্রবর্তী

বুক ফার্ম

১৭৫ টাকা

(প্রকাশকের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশিত)

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.