রাজ্য রাজনীতি কীভাবে চলবে, তা কি একটা কাগজ ঠিক করে দেবে? অমোঘ জিজ্ঞাসা। সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাৎকারে উদ্দিষ্ট সংবাদগোষ্ঠীর নাম করে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনীতিক আর সংবাদমাধ্যমের এই ঠোকাঠুকি নতুন নয়। বিধান রায় থেকে জ্যোতি বসু, মায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত-পরম্পরা অব্যাহত। তির্যক মন্তব্য, চোখ পাকানো। শাসকের শাসনের হরেক কিসিম। উল্টোটাও বাস্তব। নিজের গোষ্ঠীর স্বার্থে রাজনীতি তথা শাসককে নিয়ন্ত্রণ করার রেওয়াজও আনকোরা নয়। এমনকী হালফিলের ফেক নিউজ -তারও ঐতিহ্য বাংলা সংবাদ জগতে বিরল নয়।
স্বাধীনতা-বংলাভাগ উত্তরকালের সেই সব আখ্যান সংকলন ‘খবরের অন্তরালের খবর’। লেখক শংকর ঘোষ। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, অমৃতবাজার, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পরিক্রমার শেষে সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। তাঁর সাংবাদিক জীবনের পাঁচ দশক ব্যাপৃত এই আত্মজীবনীমূলক বইটি বাংলার রাজনীতি ও মিডিয়ার ইতিহাস চর্চার অন্যতম উপাদান হয়ে থাকবে। সাংবাদিক সুলভ নৈব্যক্তিকতা আপোষহীন শংকরবাবু তাই অকপটে বলতে পারেন, ‘কংগ্রেস যতদিন নেহরু নেতৃত্বাধীন ছিল, আনন্দবাজার কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সমর্থন করেনি’। স্বাধীনতার আগেই আনন্দবাজার ও তার সহযোগী হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড সুভাষপন্থী। গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল-এর বিরোধী ছিল। সুভাষের অন্তর্ধানের পর বাঙালি মানসে তাঁর স্থান শূন্যই ছিল বলে শংকরবাবু মনে করেন। তিনি বলছেন, বিধান রায়কে মুখ্যমন্ত্রী করার ব্যাপারে আনন্দবাজারের কর্ণধার কংগ্রেসি সুরেশ মজুমদারের ভূমিকা ছিল। তা সত্ত্বেও প্রথম দিকে তিনিও আনন্দবাজারের আনুকূল্য পাননি। সুরেশবাবুর প্রয়াণের পর সংস্থার রাশ ধরেন অশোক কুমার সরকার। তিনি কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী নীতি নেন। শংকরবাবুর দাবি, কমিউনিস্ট বিরোধিতার সুবাদে বিধান রায়-অতুল্য ঘোষদের পক্ষ নেয় আনন্দবাজার।
কংগ্রেস কর্মী হিসেবে কারাবরণ করেছিলেন অশোকবাবু। কিন্তু ‘তাঁর অভিমত সম্পাদকীয়তে, বার্তা সম্পাদক বা সংবাদদাতাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকতো। (পৃষ্ঠা ১৮৯)
তথ্যকে গৌণ করে মনের মাধুরীর মিশেলে খবর করার চল তখনও ছিল। মালিকের প্রশ্রয়ও ছিল। অন্তত শংকরবাবুর অভিজ্ঞতা তেমনই। অসমে ‘বাঙ্গাল খেদাও’-পর্বে কলকাতার কাগজে বাঙালি নির্যাতনের অশ্রুঝরা কাহিনীর ঘনঘটা। বিশেষ করে নারী অপহরণ জাতীয় খবর গুরুত্ব সহকারে ছাপার প্রতিযোগিতা ছিল বাংলা কাগজে। দিল্লিতে ‘এক মন্ত্রী আমায় বললেন, নেহরু চোটে গিয়ে বলেছেন ওই কাগজের নামও যেন আমার কাছে না করা হয়। আই won’t touch that paper…(পৃষ্ঠা ৭১)। আনন্দবাজারে দুটি মেয়ের অপহরণের খবর ছাপা হয়। তা নিয়ে সংসদ তোলপাড়। অস্বস্তি কাটাতে নেহরু নিজ উদ্যোগে খোঁজ নেন। জানতে পারেন, তারা দিন কয়েকের জন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। পরে ফিরেও আসে। পড়শির কাছ থেকে পাওয়া মেয়ে দুটির বাড়িতে না থাকার খবরকে রসিয়ে অপহরণ বলে লেখা হয়েছিল। বিলক্ষণ, পাঠক গোগ্রাসে গিলেছিলো। শংকরবাবু বলছেন, ‘পরে নেহরুর প্রতিক্রিয়া অশোকবাবুকে বলেছিলাম। তিনি জবাবে বলেন, এসব তাঁর অজানা নয়। তবে কাগজের প্রচার সংখ্যা বাড়াতে এরকম কিছু খবর ছাপতে হয়’।
এযুগে ‘এরকম কিছু খবরের পোশাকি নাম ‘ফেক নিউজ’ বা ঝুটা খবর। হয় ফেক নয় নিউজ। দুটো খাপ খাওয়ার কথা নয়। তবে সেই ফেক নিউজ-এর চারিত্রিক ফারাক স্পষ্ট। অসমের খবরটিতে রাজনীতি নয়, বাণিজ্য মুখ্য। উল্টো ছবি ছেচল্লিশের দাঙ্গায়। মুসলিম লীগের direct action day র সৌজন্যে great calcutta killings। ‘রাজাবাজার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন। মহিলাদের হোস্টেলসহ স্কুল ও কলেজ। দাঙ্গার সময় কলেজ হস্টেলে হানা দেয় কিছু মুসলমান এলাকাবাসী। পরেরদিন রাজাবাজার ট্রাম ডিপোর তারে আবাসিক পড়ুয়াদের স্তন কেটে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।’
প্রত্যহ নামে এক স্বল্পায়ু দৈনিকে ওই খবর ছাপা হয়। হিন্দু মহল্লায় সারা ফেলে। দাঙ্গার বাজারে হট কেক। রিপোর্টটি যে ভিত্তিহীন, মনে হয়নি (পৃষ্ঠা ১১০)।
আসল ঘটনা ঠিক উল্টো। রাজাবাজারের কিছু মুসলমান ভিক্টোরিয়া হস্টেল আক্রমণের ছক করেছিল। কিন্তু অপর অংশ তা ভেস্তে দেয়। এলাকার মুসলমান যুবকেরা চব্বিশ ঘন্টা পালা করে হস্টেল পাহারা দেয়। দাঙ্গার তদন্তে গঠিত calcutta disturbances enquiry commission এ দেওয়া ওই কলেজের অধ্যক্ষার সাক্ষ্যে প্রকৃত ঘটনার বিবরণ মেলে। শুধু হিন্দু পক্ষ নয়, মুসলমান মালিকের আজাদ দৈনিকও হিন্দুদের অত্যাচারের কল্পিত কাহিনী ছাপত। দাঙ্গাবাজদের রাজনৈতিক স্বার্থে ওই ধরণের বীভৎস কষ্টকল্পনা। যা মোটেই নিউজ পদবাচ্য নয়। নির্ভেজাল ফেক।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সমাজ, মানুষকে আচ্ছন্ন করার নয়া ফিকির। খবরের কাগজ, চ্যানেলের দরকার নেই। স্যোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ফেক ভিডিও কীভাবে দাঙ্গার জাল বুনেছিল ধূলাগর, বসিরহাট, বাদুরিয়াতে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণার পক্ষে জনসম্মতি নির্মাণের উত্তর আধুনিক ফন্দি। শংকরবাবুদের তা দেখে যেতে হয়নি। যেমন দেখতে হয়নি, রাষ্ট্র-কর্পোরেট-মিডিয়ার এহ্যস্পর্শে কীভাবে বদলে যাচ্ছে সাংবাদিকতার সংজ্ঞা।
খবরের অন্তরালে খবর (সাংবাদিকতায় পঞ্চাশ বছর)
শংকর ঘোষ
দে’জ পাবলিশিং
দাম ২৫০ টাকা