গঠিত হল সিপিএমের নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী। নতুন কোন কোন নেতা সেখানে জায়গা পেয়েছেন তা এখন রাজনীতির খবর রাখা সবাই জানেন। কিন্তু যোগ্যতার কোন মাপকাঠিতে তাঁরা সিপিএমের সম্পাদকমণ্ডলীতে জায়গা পেলেন, তা নিয়েই এই লেখা।
এই লেখা পড়ার আগে সিপিএম নেতা, কর্মী এবং কট্টর সমর্থকদের জন্য একটা সতর্কবার্তা, ‘কাউকে ব্যক্তিগত আঘাত করার জন্য এই লেখা নয়’।
এবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে জায়গা পেয়েছেন কলকাতার মানব মুখার্জি, সিটু নেতা অনাদি সাহু, নদীয়ার জেলা সম্পাদক সুমিত দে এবং বর্ধমানের আভাস রায়চৌধুরী।
২০০৬ সাল। বিধানসভা ভোট তখনও কয়েক মাস বাকি। তখনও বেঁচে অনিল বিশ্বাস। দলের রাজ্য সম্পাদক তিনি। ২০০১ সালে রাজ্যের তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী হয়েছিলেন মানব মুখার্জি। সেই সময়েই তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে রাজ্যে বড় বড় বিনিয়োগের আসা শুরু। সূত্রের খবর, ২০০৪-০৫ থেকেই পার্টিতে একাধিক অভিযোগ জমা হতে শুরু করে মানব মুখার্জির বিরুদ্ধে। বলাই বাহুল্য, কোনও অভিযোগই কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শিল্প গোষ্ঠীর করা আদর্শগত বিষয় নিয়ে নয়। অভিযোগ, স্বজন-পোষণ এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত। সিপিএম পার্টির নিয়ম অনুযায়ী বাইরে জানাজানি না করে অনিল বিশ্বাস নিজের মতো সব অভিযোগ তদন্ত করলেন। তদন্তে কী পাওয়া গেল তা আর এত বছর বাদে লিখে কাউকে বিড়ম্বনায় ফেলার মানে হয় না। কিন্তু সিপিএম রাজ্য সম্পাদক দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন, মানব মুখার্জিকে আর মন্ত্রী করা তো দূরের কথা, বিধানসভার টিকিটই দেওয়া হবে না। মানব মুখার্জি বুঝলেন, পরিস্থিতি জটিল। অনিল বিশ্বাসের ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তখন দলে দুটো লোকের নেই। জানা যায়, একদিন সকালে মানব মুখার্জি সোজা চলে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়ি। অনুরোধ করলেন, বিধানসভার টিকিট যেন অন্তত দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনুরোধে কিছুটা নরম হলেন অনিল বিশ্বাস, টিকিট দিলেন ২০০৬ সালে। কিন্তু বলে দিলেন, তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী হবেন দেবেশ দাস। ভোটের আগেই অনিল বিশ্বাস মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কথা ফেলার হিম্মত হয়নি কারও। প্রায় গুরুত্বহীণ পর্যটন দফতরের মন্ত্রী করা হয়েছিল মানব মুখার্জিকে। ২০১১ সালে গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা ভোটে তাঁকে আর প্রার্থী করেনি সিপিএম। তারও বড় কারণ, বেলেঘাটা এলাকায় তাঁর ভাবমূর্তি সংক্রান্ত অভিযোগ।
তো সেই মানব মুখার্জি হঠাৎ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে কোন যোগ্যতায়?
কয়েক মাস আগে কলকাতা জেলা কমিটির সম্মেলন চলছে। রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র আঁচ পেয়ে গেছেন, সম্পাদক নির্বাচনে ভোটাভুটি হবে। একদিকে মানব মুখার্জি গোষ্ঠী, অন্যদিকে কল্লোল মজুমদার গোষ্ঠী। দুই দলের নেতাদের মধ্যে বিরোধিতার আর পাঁচটা বিষয়ের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে ভিন্ন মত। মানব মুখার্জি সরাসরি কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পক্ষে। কল্লোল মজুমদাররা বিরুদ্ধে। ২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই কলকাতা জেলা কমিটিতে জোট নিয়ে টানা বিতর্ক চলছে। ঘটনাচক্রে মানব মুখার্জি সেখানে সংখ্যালঘু। আর সবাই জানেন, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আবার জোট করতে কেন্দ্রীয় কমিটিকেও অমান্য করার লাইসেন্স নিয়ে বসে আছে। সেদিন রাত ১২টা পর্যন্ত রাজ্য সম্পাদকসহ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কলকাতার জেলা সম্পাদক নির্বাচনে ভোট ঠেকাতে জোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ভোট হল এবং মানব মুখার্জি হেরে গেলেন। কল্লোল মজুমদারের মতো জোট বিরোধীর কাছে হেরে যাওয়া সেদিনই শাপে বর হয়েছিল মানব মুখার্জির। জোটপন্থী নেতাকে হারিয়ে দেওয়া মানতে পারল না আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কারণ, মানবের হার তখন আলিমুদ্দিনের হার। সামনে ২০১৯ লোকসভা ভোট আসছে। জোটপন্থী নেতা বেশি করে দরকার বিভিন্ন কমিটিতে। ২০১৬ সালের মতো দলের অন্দরে বিতর্ক হলে কাজে লাগবে।
আসলে এবার সম্পাদকমণ্ডলীতে নতুন যে চার জন এসেছেন, সবারই একটা কমন যোগ্যতা আছে। তা হল, সকলেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পক্ষে। রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণে বিরোধী মত যত কম থাকে তত ভাল, ততই কম বিতর্ক। ততই ঐক্যমত্য। আর আলিমুদ্দিন জানে, ঐক্যমত্য মানেই সর্বসম্মতিতে দলের রাজনৈতিক লাইন পাস হয়ে যাওয়া।
সিপিএমের অনেক নেতাই এখন বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় আলিমুদ্দিনকেও টেক্কা দিতে পারেন নদীয়ার জেলা সম্পাদক সুমিত দে? কেন? কারণ, আলিমুদ্দিন তো তৃণমূলকে হারাতে শুধু কংগ্রেসের হাত ধরার পক্ষপাতী। সুমিত দে’র নাকি আবার বিজেপি নিয়েও কোনও ছুঁতমার্গ নেই। তৃণমূলকে টাইট দিতে সদ্য হওয়া পঞ্চায়েত ভোটে নদীয়া জেলায় একাধিক জায়গায় কার্যত প্রকাশ্যেই বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে সিপিএম। নদীয়ার এক সিপিএম বিধায়ক এবং রাজ্য কমিটি সদস্য নিজে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। জেলা সম্পাদকের পরোক্ষ অনুমোদনেই নদীয়া জেলায় বিভিন্ন স্তরে সিপিএম কর্মীরা বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করেছেন বলে রিপোর্ট পৌঁছেছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেও।
এখন প্রশ্ন, অনাদি সাহু এবং আভাস রায় চৌধুরীকে নিয়ে। এখানে অবশ্য সিপিএমের একটা কোটা সিস্টেম আছে। শ্রমিক নেতা শ্যামল চক্রবর্তী বাদ গেলেন, তার বদলে কমিটিতে আর এক শ্রমিক নেতা অনাদি এলেন। এটা সিটুর কোটা। তার সঙ্গে আবার রাজযোটক হয়েছে অনাদি সাহুর আলিমুদ্দিনের মতোই জোটপন্থী হওয়া। কিন্তু দু’দিন ধরে সিপিএমের মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে, শ্রমিক ফ্রন্টের নেতা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে যেতে পারেন, তবে কৃষক সভার নেতা বর্ধমানের অমল হালদার কেন সুযোগ পান না এই কমিটিতে? এর উত্তরও নিহিত আছে ২০১৬ থেকে জোট ইস্যুতে দলীয় বিতর্কে অমল হালদারের ভূমিকার মধ্যে। তীব্র জোট বিরোধী অমল হালদার স্বাভাবিক কারণেই আলিমুদ্দিনের প্রিয় পাত্র নন। তাছাড়া কৃষক সভার নেতা অমল হালদারকে একটা স্পষ্ট বার্তাও দেওয়া আছে এই সম্পাদকমণ্ডলী গঠনে, ‘দেখ তোমাকে নিলাম না, কিন্তু তোমার জেলারই জোটপন্থী আভাসকে সম্পাদকমণ্ডলীতে নিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, ‘হয় তুমি আমাদের সঙ্গে আছো, নয়তো শত্রু পক্ষের সঙ্গে’।