কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোট বা আসন সমঝোতার রাস্তা খুলে গেল হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে। বুধবার পার্টি কংগ্রেসের প্রথম দিন ব্যাকফুটে শুরু করেও শুক্রবার দলের মধ্যেই জয় ছিনিয়ে আনলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে, এই বিতর্কে শুক্রবার পার্টি কংগ্রেসের ডেলিগেটদের মুড বুঝে পিছু হঠলেন প্রকাশ কারাট। ইয়েচুরির এই জয়কে আগামী দিনে বাংলার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ডেভেলপমেন্ট হিসেবেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কারণ, গোটা দেশে সিপিএমের শক্তি সেভাবে না থাকলেও, বাংলায় ফের কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের জোটের রাস্তা খুলে যাওয়ায় ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের অনেক সমীকরণই বদলে যেতে পারে।
বুধবার দলের পক্ষে থেকে রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশ করেছিলেন প্রকাশ কারাট। সেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোট কিংবা আসন সমঝোতা করা যাবে না। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে সংখ্যালঘু একটি প্রস্তাব রাখেন ইয়েচুরি। নজিরবিহীনভাবে এই ইস্যুতে প্রায় ৭০০ সংশোধনী জমা পড়ে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত এই বিষয়ে আলোচনা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রকাশ কারাট গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, হায়দরাবাদে দুদিনের আলোচনায় অধিকাংশ সদস্যই ২০১৯ লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে কংগ্রেসের সঙ্গেই সমঝোতার পক্ষে সওয়াল করেন। বিশেষ করে ত্রিপুরায় বিজেপির হাতে সিপিএম আত্মসমর্পণ করার পর, কংগ্রেস ইস্যুতে ইয়েচুরির হাত আরও শক্ত হয়। এদিন দুপুরের পর পলিটব্যুরোর বৈঠক বসে। এবং ১৭টি রাজ্যের প্রতিনিধি কংগ্রেস ইস্যুতে গোপন ভোটাভুটির দাবি জানান। ১৭টি রাজ্যের কমরেডদের এই মনোভাব দেখেই প্রকাশ কারাট বুঝে যান, ভোটাভুটি হলে তাঁর লাইনের পরাজয় অনিবার্য। তাই ভোটাভুটি এড়িয়ে সিদ্ধান্ত হয়, কংগ্রেসের সঙ্গে ‘জোট’ কিংবা ‘সমঝোতা’ নয়, এই শব্দ দুটো রাজনৈতিক কৌশলগত দলিল থেকে বাদ দেওয়া হবে। এরপর ডেলিগেটদের সামনে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট এবং সীতারাম ইয়েচুরি দুজনেই ঘোষণা করেন, বিজেপির বিপদ রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে সংসদের ভিতরে এবং বাইরে সমঝোতা রক্ষা করেই চলা হবে।
শুক্রবার পার্টি কংগ্রেসের এই যুগান্তকারী ডেভেলপমেন্টের পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এর কী প্রভাব পড়বে বাংলার রাজনীতিতে। কারণ, যে তিন রাজ্যে সিপিএমের ভিত রয়েছে তার মধ্যে একমাত্র বাংলাতেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বা সমঝোতার ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ, কেরলে সিপিএম এখন শাসক দল। বিজেপি দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি করলেও এখনও কেরলে কংগ্রেসই মূল বিরোধী দল। ফলে সেখানে সরাসরি জোট বা সমঝোতা সম্ভব নয়। ত্রিপুরায় কংগ্রেসের শক্তি এই মুহূর্তে খুবই নগন্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস এবং সিপিএম দু’দলই বিরোধী শিবিরে। এবং দুই দলই এখানকার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধী। এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং কংগ্রেসের জোট বা সমঝোতা অনেক সহজ। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও আমাদের এমনই জোটের অভিজ্ঞতা হয়েছে। যদিও সেই জোটকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ২১১ টি আসন নিয়ে সরকার গড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধীরা সেই সময় তৃণমূলের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ করলেও, রাজ্যজুড়ে উন্নয়নকে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিপুল জয় পেয়েছেন। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের পর এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটাই পালটে গিয়েছে। ক্রমশই পায়ের তলায় মাটি হারাচ্ছে সিপিএম। সেই জায়গায় বিরোধী শক্তি হিসেব উঠে আসছে বিজেপি। সিপিএমের নিচুতলার কর্মীরাও চলে যাচ্ছেন বিজেপিতে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কাছে বাড়তি মনোবল যোগাবে শুক্রবার পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত। কারণ, বাংলার সিপিএম নেতারা মনেপ্রাণে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চাইছিলেন নিজেদের স্বার্থে। সামনের পঞ্চায়েত ভোটেও হয়তো খানিকটা বাড়তি মনোবল নিয়ে লড়তে পারবেন সিপিএম-কংগ্রেস নেতারা।
কিন্তু ফের কংগ্রেস-সিপিএম জোটের রাস্তা খুলে যাওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের সুবিধে হবে না অসুবিধে হবে, এটাই এখন বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার ধারণা, হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত আখেরে তৃণমূলের সুবিধেই হবে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা দিন-দিন তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির মধ্যে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। সিপিএম-কংগ্রেস জোট একটা যৌথ শক্তি হিসেবে উঠে এলে, বিরোধী ভোট ভাগাভাগির সুবিধে পুরোপুরি পাবে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। আর সেক্ষেত্রে ২০১৯ সালে ত্রিমূখী লড়াই হলে, কে বলতে পারে, হয়তো লোকসভা ভোটের ইতিহাসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সর্বকালীন রেকর্ড সংখ্যক আসন যাবে তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে! তাছাড়া রাজ্যেজুড়ে উন্নয়নের যে কর্মসূচি মমতা বন্দ্যোপাধায় নিয়েছেন, তাতে কে মূল বিরোধী দল তাতে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু এসে যায় না। এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতা।