রাঁধুনি থেকে দলিত অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান, অনন্য স্বীকৃতিতে মুখ্যমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা মনোরঞ্জন ব্যাপারীর, বললেন, ‘দলিত সাহিত্যকে তুলে ধরাই লক্ষ্য’
সংগ্রাম তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়, বরং সংগ্রামকেই জীবন বলে চেনেন তিনি। তিনি মুটে-মজুরি করেছেন, ছাগল চরিয়েছেন, দীর্ঘ সময় যাদবপুর অঞ্চলে রিকশ চালিয়েছেন। এমনকী চায়ের দোকানে টেবিল বয়ের কাজ করেছেন, মেথরের কাজও করেছেন। ছত্তিসগঢ়ের জঙ্গলে কাঠ কেটে তা সাইকেলে করে গ্রামে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছেন পেট ও সংসার চালাতে। তিনি মনোরঞ্জন ব্যাপারী।
রান্নার করতেন একটি স্বুলে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, এই বয়সে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে রান্নার কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে, তাঁকে যদি অন্য কাজ দেওয়া যায়! সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগ নেন মমতা ব্যানার্জি। লাইব্রেরির কাজে নিযুক্ত করা হয় মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে। আর তার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে রাজ্যের দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
বাংলায় এবার দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি হচ্ছে। নিম্নবর্গের জীবনযুদ্ধকে গ্রন্থিত করা এবং নিম্নবর্গের সাহিত্যকে পুঁথিবদ্ধ করাই হবে এই অ্যাকাডেমির উদ্দেশ্য। গত সপ্তাহে নবান্ন থেকে এমনটাই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে ‘লেখোয়াড়’ মনোরঞ্জন ব্যাপারীর নাম ঘোষণা করেন তিনি।
কিছুদিন আগে যাঁকে স্কুলের রান্নার কাজ থেকে লাইব্রেরি দেখাশোনার কাজে বহাল করেন তিনি, ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ এর লেখক কী বললেন এই দায়িত্ব পেয়ে?
মনোরঞ্জন ব্যাপারীর কথায়, রাঁধুনির কাজে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু ব্লাড প্রেশার, সুগার, হাঁটুর অসুস্থতায় জেরবার দলিত লেখক চেয়েছিলেন একটু হালকা কাজ পেতে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁকে লাইব্রেরির কাজে নিযুক্ত করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তিনি কৃতজ্ঞ বলে জানান লেখক। তাঁর কথায়, বয়সজনিত কারণে একটা হালকা কাজ চেয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী চাইলে রান্নার কাজ থেকে তাঁকে সরিয়ে তরকারি কাটার কাজ দিতে পারতেন। কিন্তু লেখককে সম্মান জানিয়ে পাঠাগারের কাজে নিযুক্ত করেছেন তিনি। এটাই মুখ্যমন্ত্রীর মাহাত্ম্য।
এবার তাঁর কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে পালন করা। বাংলায় দলিত সাহিত্যের ধারা একই সঙ্গে সমৃদ্ধ এবং পুরনো। কিন্তু এতদিন সেই সাহিত্যকে আলাদা করে তুলে ধরার কোনও আয়োজন হয়নি। এই ধারাকে বদলে দিতে পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি চান প্রান্তজনের কথা উঠে এসেছে যে সাহিত্যে, যে সাহিত্যের বিকাশ প্রান্তজনের কলমেই, তা আরও আলোয় আসুক। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ওপর যে আস্থা রেখেছেন, তার মর্যাদা দেওয়াই এই বয়সে নতুন চ্যালেঞ্জ, জানাচ্ছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী।
জীবনের একটা অধ্যায়ে তিনি নকশাল আন্দোলন করেছেন। জেল খেটেছেন। পরবর্তীতে তিনিই হয়ে উঠেছেন সাহিত্যিক। একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে অর্থের জন্য এখনও পরিশ্রম করে যেতে হয়েছে সত্তরোর্ধ্ব মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে হাড়ভাঙা খাটুনি থেকে মুক্তি মিলেছে, এবার দলিত সাহিত্যের বিকাশ গঠিত অ্যাকাডেমির কাজে যুক্ত হতে পেরে খুশি তিনি।
মনোরঞ্জনের কথায়, আমি এমন জীবন যাপন করেছি যা কোনও মানুষের যাপন করা উচিত ছিল না। তখন অক্ষরজ্ঞান ছিল না তাই এই সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল অন্যরকম। কিন্তু এখন কলমই আমার অস্ত্র। নিজের বই দিয়েই তিনি সাম্যের কথা বলে যেতে চান। এক শ্রেণি সব সুবিধা পাবে আর এক শ্রেণি কিছুই পাবে না, এ আর হতে দেওয়া যায় না।
বর্তমান রাজনীতি প্রসঙ্গও আসে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর কথায়। তিনি বলেন, কেন্দ্রে যে দলটি ক্ষমতাসীন তার আমলে সংখ্যালঘু, দলিত ও নারীদের প্রতি অত্যাচার বেড়ে গিয়েছে। যে যে রাজ্যে এই দল ক্ষমতায় এসেছে কিছুদিন পরেই সেখানকার মানুষের আস্থা হারিয়েছে দলটি। বাংলায় এই দল ক্ষমতায় এলে তা বড়সড় বিপদ হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, রাজ্যে শাসক দল হিসেবে তৃণমূলের ভালো, খারাপ দুইই হয়তো আছে। খারাপ কাজের অবশ্যই সমালোচনা করা উচিত। কিন্তু এই রাজনৈতিক দলটি বাংলা ও বাঙালি বিরোধী নয়।
Comments are closed.