ডায়াবেটিস ও ওবেসিটি – Diabetic রোগীর ওজন নিয়ন্ত্রণ কতটা জরুরি?

সারা বিশ্বেই বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিস ও স্থূলতার সমস্যা। বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ৩০ বছরে চার গুণ বেড়েছে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা, জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)।

ডায়াবেটিসে ভোগা রোগীর সংখ্যা বেড়ে চললেও এই রোগটি সম্পর্কে মানুষ তেমন সচেতন নন বলে মত চিকিৎসকদের। শরীরের দিকে খেয়াল না করা, স্থূলত্ব, জীবন-যাপনে রুটিনের অভাব খুব অল্প বয়সিদেরও ডায়াবেটিসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেখান থেকে শুরু হয় আরও কিছু শারীরিক সমস্যা ও রোগ।

কিন্তু জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম ও বিধি মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রেই Diabetes প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আগে আসা যাক কেন হয় ডায়াবেটিস, এই প্রশ্নে।

 

ডায়াবেটিসের কারণ (Cause for Diabetes)

কোনও খাবার খেলে আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে (গ্লুকোজ) রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হয় ইনসুলিন হরমোন যা, আমাদের শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ পাঠায় এই গ্লুকোজ গ্রহণের জন্য। এই গ্লুকোজ বা চিনি শরীরের শক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যখন শরীরে ইনসুলিন তৈরি হতে পারে না তখনই Diabetes দেখা দেয়। এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনির পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।

 

ডায়াবেটিস কত ধরনের? (Types of Diabetes)

ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের। যেমন, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে।

টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের পিছনে জিনগত কারণকে বেশি ধরা হয়। তাছাড়া অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণ হলে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়, তার ফলেও এই প্রকারের ডায়াবেটিস হয়। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের প্রায় ১০ শতাংশ টাইপ ওয়ানে ভুগছেন।

এছাড়া টাইপ টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে আক্রান্তের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না। কিংবা ইনসুলিন হরমোন ঠিক মতো কাজ করে না। সাধারণত মাঝবয়সী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। কিন্তু বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি তাঁদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এছাড়া এলাকা ভিত্তিক ডায়াবেটিসের প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। আবার, সন্তানসম্ভবা হলেও ডায়াবেটিসের শিকার হতে পারেন।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছয় থেকে ১৬ শতাংশ গর্ভবতী মহিলার ডায়াবেটিস আশঙ্কা থাকে। তাই সঠিক ডায়েট, শরীর চর্চা, ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে শরীরে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

 

ডায়াবেটিস ওজন (Diabetes and Obesity)

diabetes and obesity

 

ওজন বেশি হলে সেই ডায়াবেটিস রোগীর সমস্যা হতে পারে মারাত্মক।

তাই উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা, ব্যায়াম করা জরুরি। হাঁটতে যাওয়ার আগে জল খেয়ে নেওয়া উচিত। শরীরে অতিরিক্ত মেদ থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এই দুই সমস্যাকে একত্রে ‘ডায়াবেসিটি’ (diabesity) বলা হয়। এর প্রধান কারণ, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। এছাড়াও ইনসু‌লিন রেজিস্ট্যান্সের কারণে ফ্যাটি লিভার, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি, পলিসিস্টিক ওভারি থেকে বন্ধ্যাত্বের সমস‌্যা দেখা দিতে পারে। এই সব কিছুর পিছনেই রয়েছে ওবেসিটি। তাই ব্যায়াম, খাবার-দাবার নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা করে যদি ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাহলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আয়ত্তে আসে। ফলে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

 

ডায়াবেটিসের উপসর্গ (Symptoms of Diabetes)

ডায়াবেটিসের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। যেমন, সময়ে সময়ে খুব ক্লান্ত বোধ করা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, তেষ্টা পাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া বারবার প্রস্রাব পায়, বিশেষ করে রাতের ঘুমের সময়। কোনও কারণ ছাড়াই ওজন কমে যায় অনেক সময়, যা হতে পারে ডায়াবেটিসের লক্ষণ। তাছাড়া হঠাৎ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, শরীরের কোথাও কেটে গেলে তা শুকাতে দেরি হওয়া ইত্যাদি ডায়াবেটিসসের উপসর্গ হতে পারে।

চিকিৎসকদের মত, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের লক্ষণ শৈশব থেকেই দেখা দিতে পারে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে তা জটিল হয়।

আর বয়স ৪০ বছর পার করলেই টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাবা-মা, ভাই-বোনের ডায়াবেটিস থাকলে পরিবারের অন্যান্যদের ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া অতিরিক্ত ওজন হলেও ঝুঁকি থাকে।

 

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব? (How to Battle Diabetes)

how obesity increases diabetes

 

ডায়াবেটিস জেনেটিক এবং লাইফ স্টাইলের ওপর নির্ভর করলেও সতর্ক হলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে তার জন্য খাবারের দিকে  সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রথমেই প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় একেবারে বর্জন করতে হবে।

 

Diabetic Diet

খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, পেস্ট্রি, শর্করা জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি। শাক-সবজি, ফল, মোটা দানার খাদ্য শস্য, বাদাম ইত্যাদি বেশি করে রাখতে হবে খাদ্য তালিকায়। ওমেগা থ্রি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকারেল মাছ ইত্যাদি খেতে হবে।

একবার ভরপুর না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খাবার খাওয়া উচিত। তাছাড়া শরীর সক্রিয় রাখতে ব্যায়াম করা দরকার। তার দ্রুত হাঁটা, লিফটে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মতো কাজগুলি করতে পারেন। ওজন কম রাখলে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই যদি ওজন কমাতে হয় সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে করতে হবে। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়ে।

 

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

ডায়াবেটিস রোগীরা অবশ্যই নিয়মিত কিডনি, রক্তের চর্বি এবং হৃদরোগের পরীক্ষাগুলো করবেন। প্রতি ৬ মাস পর পর চোখ পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাবেন। পরিবারের মধ্যে ডায়াবেটিসের রোগী থাকলে অন্যদেরও সতর্ক হতে হবে। তাঁদেরও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন।

 

নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা

ডায়াবেটিস রোগীরা সম্ভব হলে বাড়িতে গ্লুকোমিটার কিনে রাখবেন। সপ্তাহে অন্তত একদিন রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা এই যন্ত্রে দেখে নেবেন। নিয়মিত ব্যায়াম, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং ওষুধ খাওয়ার পরও যদি রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে তাহলে বুঝতে হবে শরীরে ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক ইনসুলিন শুরু করতে হবে। তবে ইনসুলিন নিতে প্রায় প্রত্যেক রোগীই ভয় পান। কিন্তু শরীর ভাল রাখতে গেলে ইনসুলিন নিয়েই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

 

ডায়াবেটিসের কারণে আরও কোন জটিল রোগ হতে পারে?

diabetic diet

 

রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শরীরে যদি রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হয়, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে পায়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পিছনে বড় হাত ডায়াবেটিসের। এছাড়া হার্ট অ্যাটাকের একটি বড় কারণ রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।

আপনার জীবনে যতটা শৃঙ্খলা থাকবে ততই Diabetes নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। শুধুমাত্র ওষুধ খেলে হবে না। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সঠিক লাইফস্টাইল। যেমন প্রত্যেকদিন ঠিক সময়ে খাওয়া, অনেকক্ষণ খালি পেটে না থাকা, খুব বেশি পরিমাণে না খাওয়া। আবার ছয় ঘন্টার কম এবং নয় ঘন্টার বেশি ঘুমালেও ডায়াবেটিসের পক্ষে তা ক্ষতিকর। ধূমপান ও যে কোনও ধরনের তামাক সেবন বর্জন করা উচিত। নিয়মিত অ্যালকোহল পান ডায়াবেটিসের পক্ষে ভাল নয়। অযথা দুশ্চিন্তা করলে ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে থেকে। তাই বেশি উদ্বেগপ্রবণ হলে যোগ-ব্যায়াম, ধ‌্যান, করতে পারেন। বই পড়া, গান শোনা বা অন্য যে কোনও ধরনের শখ থাকলে নিজেকে রিল্যাক্স রাখতে তা অবশ্যই করুন। টেনশন আসবেই, কিন্তু তা কমানোর উপায় তো আপনাকেই বের করতে হবে।

Comments are closed.