এনায়েতপুর সিপিএম পার্টি অফিসে দূরপাল্লার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালাল মাওবাদীরা, গুলিবিদ্ধ হল আমাদের ২ কমরেড
২০০৯ লোকসভা ভোটের পর দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার গঠন হয়ে গেছে, তার কিছুদিন পর একদিন দিল্লিতে গিয়েছি। তখন নতুন মন্ত্রিসভায় প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাঁকে টেলিফোন করলাম, দেখা করব বলে। সাথে সাথেই উনি বললেন, ‘সন্ধ্যায় বাড়ির অফিসে (১৩ নম্বর তালকোটরা রোড) চলে এসো।’ নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে ওনার সচিব প্রদ্যুত গুহের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি বললেন, ‘তোমার আসার কথা দাদা আমাকে আগেই বলে রেখেছেন। আমি খবর পাঠাচ্ছি।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ওনার ঘরে যেতে বললেন। আমি যাওয়ার পর, শারীরিক বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার পর উনি বললেন, ‘কাজের চাপ আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেছে।’ এরপর আমাকে বললেন, ‘লোকসভা নির্বাচনে তোমাদের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলায় ফলাফল ভালো হলেও, অন্যান্য জেলায় কী করে এরকম খারাপ ফল হল?’ আমি বললাম, সবই তো আপনি জানেন। জঙ্গলমহল এলাকার এই ফলাফল আমরা কতদিন ধরে রাখতে পারব জানি না। যেভাবে জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী তৎপরতা বাড়ছে, যেভাবে জনসাধারণের কমিটি বিরোধীদের মদত পাচ্ছে, আর পুলিশের একটা অংশের ভূমিকাও ভালো নয়। কতদিন আমাদের পক্ষে এই অবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হবে জানি না। উনি একটু থেমে আক্ষেপের সুরে সেদিন অনেকগুলি কথা বলেছিলেন। তাঁর কিছু কথা এই লেখার মধ্যে উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘তোমাদের নেতৃত্বের কিছু ভুল পদক্ষেপ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসুর মতো একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের পরামর্শও তোমাদের নেতারা গ্রহণ করলেন না। এরপর এর চেয়ে ভালো আর কীই বা হতে পারে! ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে সরকার ফেলার প্রচেষ্টা না নিলে রাজ্যে আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হোত না।’ তিনি আরও বললেন, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বামপন্থীরা দুর্বল হলে সে জায়গাটা অন্য শক্তি দখল করে নেবে। ভারতবর্ষে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে পথ, সেখানে বামশক্তির উপস্থিতি খুবই আবশ্যিক। বামপন্থীরা দুর্বল হলে, যখন কংগ্রেস থেকে মানুষ কোনও কারণে দূরে সরে যাবে, তখন তারা অন্য ভয়ঙ্কর শক্তি বিজেপির কাছে গিয়ে ভিড়বে। তা গোটা দেশের ক্ষেত্রে আগামী দিনে খুবই সমস্যার হবে। আর এও বললেন, রাজ্যজুড়ে যে সব ঘটনা ঘটছে, প্রশাসনের তা আরও শক্ত হাতে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এরপর তিনি সিঙ্গুরের অবরোধ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একটি মজার ঘটনা বলেন।
অতীতে কোনও এক নগরের প্রশাসক কীভাবে তাঁর শহরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার বিরোধীদের পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিয়েছিলেন সেই ঘটনা। সেই প্রশাসকের বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধী পক্ষ শহরকে স্তব্ধ করে দিতে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। যখন বিরোধীরা মিছিল করে শহরে আসছেন, তখন প্রশাসকের পক্ষের লোকজন মিছিলের সমর্থনকারী সেজে, মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রাস্তার ধারে পানীয় জল ও ক্লান্তি দূর করতে সরবতের ব্যবস্থা করেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদেরই সমর্থনকারীদের দ্বারা এই আয়োজন করা হয়েছে ভেবে জুলাপ মেশানো সরবত পান করার কয়েক ঘন্টা পর পেটের সমস্যায় পড়ে যান। মিছিলে হাঁটা তাঁদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। গোটা শহরকে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নোংরা করে দিয়েছে এই অজুহাতে ওই প্রশাসক তাঁর বিরোধীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করে বসেন। শহর স্তব্ধ করার করার আন্দোলন একদিনের মধ্যে ভেস্তে যায়। আসলে প্রশাসন পরিচালনা করতে গেলে সর্বদা বল বা শক্তির প্রয়োজন হয় না। বুদ্ধি বা কৌশল থাকলে ও দৃঢ়তা থাকলে অনেকভাবে পরিকল্পনা করা যায়। এটাই বলেছিলেন তিনি। এও বলেছিলেন, একবার যদি প্রশাসনের রাশ শিথিল হয়ে যায় তাকে পুনরায় পুরানো জায়গায় ফেরানো খুবই কঠিন কাজ। তখন সংগঠনকেই মানুষের কাছে প্রশাসন সম্পর্কে আস্থা অর্জনের জন্য কিছু কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। সেটা সংগঠনের সম্পূর্ণ নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে আরও অনেক কথা সেদিন হয়, তা লেখার আকারে প্রকাশ না করাই ভাল। এবিষয়ে তাই বিস্তারিত কিছু লিখব না। আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাদের সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অনেকের সঙ্গেই তো আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভাল। ভারতবর্ষের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে, আপনি তাঁদের সাথে কথা বললে ভালো হয়। তিনি বলেছিলেন, কথা বলবেন। এনিয়ে পরবর্তী সময়ে আর বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আর উনি কারও সাথে কথা বলেছিলেন কিনা, সেভাবে জিজ্ঞেস করাটাও আমার পক্ষে শোভনীয় হবে না বলে আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। সেদিন দীর্ঘ সময় ওনার বাড়িতে ছিলাম।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে পরেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষেত্রে আইনি লড়াইয়ে একটা বড় সাফল্য আমরা পাই। ছোট আঙারিয়ার ঘটনা ইতিমধ্যেই আমার লেখায় উল্লেখ করেছি। যা নতুন করে ঘটল তা আমাদের জেলার ক্ষেত্রে তো বটেই রাজ্য পার্টির ক্ষেত্রেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক। এর পূর্বে আমাদের পার্টির কোনও স্তরেই সিবিআই-এর মতো এতো প্রবল ক্ষমতাশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। যখন ছোট আঙারিয়ার ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার সিবিআইকে দেওয়া হল, তখন প্রথম প্রথম আমাদের দিশেহারা অবস্থা। সিবিআই এই মামলা অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। সেখানে তাদের আটকানোর জন্য অনেকটাই আইনি লড়াই চালাতে হয় আমাদের। সেই সময় আমাদের জেলা পার্টির দুই সদস্য শুকুর আলি ও তপন ঘোষসহ মোট সাত জন প্রায় দু’বছর জেলে থাকার পরে, দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে মেদিনীপুর আদালতের নির্দেশে বেকসুর খালাস পান। যা আমাদের গড়বেতা এলাকা তো বটেই, সারা জেলা ও গোটা রাজ্যে ইতিবাচক সাফল্য হিসাবে চিহ্নিত হয়। মানুষের মনে সিবিআই সম্পর্কে যে ভয়ঙ্কর ধারণা ছিল তাতেও পরিবর্তন হয়। আদালতের রায়ে জেল থেকে কমরেডরা মুক্ত হওয়ার পর, সেদিনই জেলা শহর থেকে শুরু করে গড়বেতা পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কমরেডদের একবার চোখে দেখার জন্য। সেদিন মেদিনীপুর থেকে আমি ওই কমরেডদের সঙ্গী হই। জেলা শহর থেকে গড়বেতার রাস্তা অতিক্রম করতে সাধারণত এক ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিন সময় লেগেছিল প্রায় চার ঘণ্টা। সারা রাস্তায় অপেক্ষারত অসংখ্য সাধারণ মানুষের অনুরোধ মেনে জায়গায় জায়গায় গাড়ি থামাতে হয়। অনেক রাতে যখন গড়বেতায় পৌঁছাই তখন প্রায় গোটা এলাকার মানুষ প্রায় শহরে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই দিনটা গড়বেতা এলাকার পার্টির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকব।
এর কিছুদিন পরে ৩ রা অগাস্ট ২০০৯, সুভাষদার (সুভাষ চক্রবর্তীর) মৃত্যু হল। অনেকদিন ধরেই তিনি দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘শরীরের অবস্থা একেবারেই ভালো যাচ্ছে না, আর কতদিন বয়ে যেতে পারব জানি না।’ অনেকদিন ধরেই চিকিৎসা চলছিল, হঠাৎ করেই চলে গেলেন। এই খবর প্রচার হওয়ার পরে রাজ্যজুড়ে একটা শোকের পরিবেশ। আপনজন চলে যাওয়ার পরিস্থিতি। পরদিন সকালে মরদেহ নিয়ে শোকযাত্রা শুরু হল। সেদিন সারা কলকাতা ও শহরতলিতে অলিখিত বনধের পরিবেশ। সর্বত্রই মানুষ প্রয়াত নেতার প্রতি শোক প্রকাশ করছেন। যে রাস্তা দিয়ে মরদেহ যাবে, সেই রাস্তার ধারে শুধু মানুষ আর মানুষ। কর্মস্থলে যাওয়ার পথে, অফিস বা বাজারে যাওয়ার পথে যে যেখানে পেরেছেন, দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কখন সেখানে আসবে তাঁদের আপনজনের মরদেহ। একবার শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখার জন্য সেকি আকুলতা। কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের চোখে জল। সারা কলকাতার রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। একথা লেখায় উল্লেখ করলাম এই জন্যই যে, সুভাষদা কোনও রাষ্ট্র নায়ক ছিলেন না, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পদাধিকারীও কখনও ছিলেন না। তবুও সেদিন কলকাতাজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা রাজ্যের মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মানুষের মনে ভালোবাসার কোন জায়গায় তিনি ছিলেন এই ঘটনা তা অনেককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বড় উদাহরণ। সেদিন বিধানসভা ঘুরে মরদেহ যখন মহাকরণের সামনে এল তখন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। গোটা লালদিঘি চত্বর থেকে মহাকরণের সামনের রাস্তা, পাশের রাস্তা, সবটাই জন সমুদ্রে পরিণত তখন। পুলিশ কোনওমতে রাস্তা করে শববাহী গাড়ি নিয়ে আসছে। মহাকরণের সামনে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যে, আমার নিজেরই পদপিষ্ট হয়ে যাওয়ার দশা। ভালো করে মালা দেওয়াও সম্ভব হয়নি। প্রতি মুহূর্তে মনে আসছিল, ওনার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরের সব কথা। সে অনেক বড় বিষয়। আজকের লেখায় সে বিষয়ে যাব না। শুধু যে কথা বলে সুভাষদার প্রসঙ্গ এই পর্বে শেষ করব তা হল, যখন সংগঠনের দ্রুত ক্ষয় শুরু হয়েছে, নানা কারণে তখন সুভাষদার মতো মানুষের বেঁচে থাকার খুবই প্রয়োজন ছিল। ২০০৮ সালে জীবনের শেষ প্রান্তে তাঁর রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পার্টিকে অনেক কিছুই তাঁর দেওয়ার ছিল। কিন্তু তা আর হল না।
এর প্রায় দেড় মাস পরে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ, দিনটা ছিল ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় মাওবাদীরা আমাদের ওপর একটা বড় আক্রমণ সংগঠিত করে। এর পূর্বেও মাওবাদীদের হঠাৎ আক্রমণ, আমাদের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষকে খুন করা, তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেদিনের ঘটনা ছিল তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। মেদিনীপুর শহর থেকে ধেড়ূয়া হয়ে ঝাড়গ্রাম যাওয়ার যে রাস্তা, তাতে মেদিনীপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এনায়েতপুরে আমাদের পার্টির লোকাল কমিটির কার্যালয়। কিছুদিন ধরেই নানা সূত্রে খবর আসছিল, মাওবাদীরা জেলা শহর আক্রমণের জন্য বড় পরিকল্পনা নিচ্ছে। মেদিনীপুর সদর ব্লকের এসব এলাকায় আমাদের সংগঠনের জনভিত্তিও ভালোই বলা যায়। পার্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আমাদের কর্মীরা এই এনায়েতপুর পার্টি অফিসকে কেন্দ্র করে নজরদারি চালাবে ও সতর্ক থাকবে। যাতে অতর্কিতে মাওবাদীরা কোনও ঘটনা না ঘটাতে পারে। ২২ সেপ্টেম্বর বিকালে পার্টি অফিসে উক্ত বিষয়গুলি নিয়ে পার্টির স্বেচ্ছাসেবকদের একটি জরুরি সভা ডাকা হয়। এই সভা যখন চলছে সেই সময়ে ঠিক সন্ধ্যার মুখে দূরপাল্লার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাওবাদীরা হঠাৎ করেই এনায়েতপুর পার্টি অফিস আক্রমণ করে। প্রথম অবস্থায় আমাদের দু’জন কমরেড গুলির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়ে। এমন অবস্থা হয় যে, সেই মুহূর্তে তাঁদের সেখান থেকে বের করে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে পার্টির অফিস লক্ষ্য করে দূর পাল্লার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুটে আসছে। এরকম পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হলে, পাশাপাশি সব গ্রামের মানুষকে কী করতে হবে তার পরামর্শ দেওয়া ছিল। গ্রাম থেকেও নানা কায়দায় মানুষজন মাওবাদীদের জানান দিচ্ছে যে, গ্রামের মানুষও তৈরি। এনায়েতপুর লাগোয়া কংসাবতী নদী পার হয়ে মাওবাদীরা পার্টি কেন্দ্র আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, পার্টির লোকাল কমিটির অফিসটা দখল করে নেওয়া, কারণ তা করতে পারলে ওটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসাবে মাওবাদীরা ব্যবহার করবে। যার ফলে ওদের পক্ষে মেদিনীপুর জেলা শহর কব্জা করে নেওয়া সহজ হবে। আমাদের পার্টির কৌশল ও পাশাপাশি গ্রামের মানুষের ভূমিকার জন্য সেদিন তাদের সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
যাতে মেদিনীপুর শহর থেকে পুলিশ, প্রশাসন এনায়েতপুরে পৌঁছতে না পারে, সে জন্য সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মাওবাদীরা গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে দেয়। গভীর রাত্রে রাস্তার গাছ সরিয়ে পুলিশ ওখানে পৌঁছোয়। আমাদের গুরুতর আহত দু’জনকে মেদিনীপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। একজনের চিকিৎসা ওখানে করা গেলেও, আর একজনের চিকিৎসা সেখানে করা সম্ভব নয় বলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সকাল ৫টা নাগাদ কলকাতার হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসকরা তাঁকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটরে যান। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে চলে অপারেশন। দূরপাল্লার আগ্নেয়াস্ত্রর গুলিতে তাঁর ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল। যে কোনও মুহূর্তেই অঘটন ঘটে যেতে পারতো। চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন, এই অবস্থায় গুলি বের করার চেষ্টা করলে তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। ততক্ষণে তাঁর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। অপারেশনের সময় রক্ত দিয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছিল না। আমরা সকলেই টানা প্রায় সাত দিন তাঁকে নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। যে কোনও সময় অঘটন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা। এক কথায় যাকে বলে যমে-মানুষে টানাটানি। সাত দিন পর চিকিৎসকরা বললেন, সামান্য কিছু উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এরপর প্রায় দু’মাস কলকাতার ওই হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি থাকতে হয়। হাসপাতালজুড়ে সে সময় বিরোধীদের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এমনও কথা কানে আসে যে, হাসপাতালের মধ্যেই আহত কমরেডের উপর চড়াও হতে পারে বিরোধীরা। কলকাতা পার্টির সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। টালিগঞ্জের পরিচিত এক নেতাকে এব্যাপারে সাহায্যের অনুরোধ করলে, তিনি ওই এলাকার কিছু কমরেডকে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তাতেও ভরসা হচ্ছিল না। তখন ওই হাসপাতালের একজন সিনিয়র চিকিৎসককে অনুরোধ করলে তিনিও উদ্যোগী হন। কমরেডের অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় তাঁকে আইসিইউ’তে রাখা হয়। ওই চিকিৎসকের উদ্যোগে আইসিইউ এর বাইরে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়। সকলের প্রচেষ্টায় ছ’মাস বাদে ওই কমরেড হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।
পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে সরকার বদলের পর ওই দুই কমরেডের বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা দেওয়া হয়। বহু বছর ধরে এদের আত্মগোপন করে থাকতে হয়। একজন চাকুরি করতেন, তিনি চাকুরি থেকে বরখাস্ত হয়ে যান। আর একজন এখনও আত্মগোপনে। দুঃখজনক হলো এটাই, যে জন্য এই ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি তা হল, আজ এদের খোঁজখবর রাখার কর্তব্য যাঁদের সবচেয়ে বেশি তাঁরা তা রাখেননি। আবার গর্বের হল, এই আক্রান্ত কমরেডরা এত যন্ত্রণা, এত নির্যাতন সহ্য করেও আজও সিপিআইএম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেননি। তাই মনে হয় শত্রুরা যতই চেষ্টা করুক, আদর্শকে কখনও শেষ করতে পারবে না। মানুষ ওই আদর্শকে সামনে রেখেই একদিন ঘুরে দাঁড়াবে, সেটা সময়ের অপেক্ষা।
এনায়েতপুরের এই ঘটনার মাধ্যমেই জঙ্গলমহলের মাওবাদীরা প্রথম গণ-প্রতিরোধের সামনে পিছু হটে। তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। জেলা শহর মেদিনীপুরকে তারা কব্জা করে নিতে পারেনি। এনায়েতপুরের এই ঘটনা নিয়ে মাওবাদীরা পরে তাঁদের দলিলে আত্মমূল্যায়ন করতে গিয়ে যা উল্লেখ করেছিল তা সংবাদমাধ্যমেই জানা যায়। সিপিআইএমের গণপ্রতিরোধের লাইন সম্পর্কে তাঁদের অতীত মূল্যায়ন সঠিক ছিল না। এনায়েতপুরের সেদিনের সেই ঘটনাতে তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয় যথেষ্ট। এর বিস্তারিত বিবরণ অবশ্য দলিলে উল্লেখ ছিল না। অন্যদিকে, এই ধরনের ভয়ঙ্কর আক্রমণ গণপ্রতিরোধের দ্বারা প্রতিহত করতে পারার ফলে আমাদের কর্মীদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে মাওবাদীদের মোকাবিলার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা খুবই সাহায্য করে। আমাদের কর্মীরা লড়াই করে আদর্শের জন্য, আদর্শকে রক্ষা করার জন্য, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করার জন্য। আর মাওবাদীরা লড়াই করে ভাড়াটিয়া বাহিনীর মতো। এরপর ২০০৯ সাল ও তার পরবর্তী সময়ে মাওবাদীদের আক্রমণ এবং গণপ্রতিরোধের এমন আরও অনেক ঘটনাই আছে।
(চলবে)
Comments are closed.