দেশে প্রতি দিন গড়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন ৩৫-৩৮ জন কৃষক, ২০১৫ সালের পর কৃষক আত্মহত্যার তথ্যই প্রকাশ করেনি মোদী সরকার
১৯ শে মার্চ, ১৯৮৬। মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে খরা প্রবণ জেলা ইয়াবৎমালে স্ত্রী এবং ৪ সন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন সাহেবরাও কার্পে। সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘কৃষক হয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব।’ তদন্তে উঠে আসে, ইঁদুর মারার জিঙ্ক ফসফেট খাবারে মিশিয়ে প্রথমে স্ত্রী, ৪ সন্তান, তারপর সেই খাবার খেয়ে আত্মঘাতী হন নিজেও।
সাহেবরাওয়ের ঘটনাটি উল্লেখ করার কারণ, তিন দশকেরও বেশি আগের এই ঘটনাটিকে মহারাষ্ট্রে প্রথম কৃষক আত্মহত্যা হিসেবে ধরা হয়। সাহেবরাওয়ের মৃ্ত্যুর পর ৩৩ বছর কেটে গেছে। অবিজেপি-অকংগ্রেসি, এনডিএ, ইউপিএ, বিজেপি-বিভিন্ন সরকার এসেছে দেশে, কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে কৃষকের জীবন। মহারাষ্ট্রের সীমানা টপকে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা এখন জাতীয় সমস্যা। সরকার আসে সরকার যায়, কৃষকের দিন বদলায় না। ছেদ পড়ে না আত্মহত্যার ট্র্যাডিশনে। সাহেবরাওয়ের সুইসাইড নোট, ‘কৃষক হয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব’, সারা দেশে আজও একইরকম সত্যি।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে সারা দেশে ১১,৭৭২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৪ সালে সেই সংখ্যাটাই বেড়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১২,৩৬০। সে বছর ৫,৬৫০ জন কৃষক এবং ৬,৭১০ জন কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৫ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ১২,৬০২ (৮,০০৭ জন কৃষক এবং ৪,৫৯৫ জন কৃষি শ্রমিক)। প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ২০১৫ সালের পর থেকে এনসিআরবি কৃষক আত্মহত্যার আর কোনও রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। আর তার একমাত্র কারণ, কৃষকের দুর্দশার এই করুণ ছবি ‘আচ্ছে দিনে’র প্রচারের আড়ালে চেপে রাখতে চায় দেশের সরকার।
২০১৬ সালে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণের মুখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংসদের বাজেট অধিবেশনে জানায়, সমস্ত তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়নি। কিন্তু তার ক’দিন বাদেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংসদে একটি রিপোর্ট পেশ করে জানায়, ২০১৬ সালে ৬,৩৫১ জন কৃষক এবং ৫,০১৯ জন কৃষি শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। তারপর থেকে এবিষয়ে আর কোনও সরকারি রিপোর্ট দিনের আলো দেখেনি।
সরকার কৃষক আত্মহত্যার রিপোর্ট প্রকাশ না করলেও, বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে। তেমনই একটির রিপোর্ট বলছে, কেবল মহারাষ্ট্রেই শেষ পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) ১৪,০৩৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিদিন ৮ জন করে কৃষক আত্মঘাতী হচ্ছেন শুধু মহারাষ্ট্রে। ২০১৭ সালের জুন মাসে কৃষকদের দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে সেই রাজ্যের সরকার ৩৪ হাজার কোটি টাকার কৃষি ঋণ মকুবের পরও মহারাষ্ট্রে অন্তত ৪,৫০০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। সরকার রিপোর্ট প্রকাশ না করলেও, বিভিন্ন সংগঠনের হিসেব, দেশে প্রতি বছর ১৩-১৪ হাজার কৃষক আত্মঘাতী হচ্ছেন। দিনে গড়ে ৩৫-৩৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন দেশে।
কৃষক আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র একে থাকলে দু’নম্বর তেলঙ্গানা। এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে তেলঙ্গানায় ১,৩৫৮ জন কৃষক এবং ৪২ জন কৃষি শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। তার ঠিক পরেই আছে কর্ণাটক। ২০১৫-য় কর্ণাটকে ১,১৯৭ জন কৃষক এবং ৩৭২ জন কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। সেই বছর মধ্য প্রদেশে ৫৮১ জন কৃষক এবং ৭০৯ জন কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।
আবার একটি ভোটের মুখে দেশ। রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের নিত্য নতুন প্রতিশ্রুতিতে ফের সরগরম বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। কিন্তু দেশের অন্নদাতারা ভালো নেই। সাহেবরাওদের কথা বলবে কে?
Comments are closed.