উত্তরাখণ্ডের এক জেলায় ৩ মাসে হয়নি একজনও কন্যা সন্তান, পুরুষ-মহিলা অনুপাতের হিসেবে করুণ ছবি উত্তর ভারতজুড়ে
সম্প্রতি সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশি জেলার ১৩২ টি গ্রামে গত ৩ মাসে একটিও কন্যা সন্তান জন্মায়নি। অথচ এই সময়ের মধ্যে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে ২১৬ টি। এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরই দেশজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী মোদীর বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও প্রকল্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার নিউ ইন্ডিয়ায় নারী শক্তির প্রবল উত্থানের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তব কি নরেন্দ্র মোদীর দাবিকে সমর্থন করছে? সমাজকর্মীরা অভিযোগ করছেন, কন্যা ভ্রুণ হত্যা যে ভারতে ক্রমেই পর্দার আড়ালে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, তা এই ঘটনায় জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
কন্যা সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। অথচ পুত্র সন্তান হলে আনন্দের সীমা নেই। পুরুষতান্ত্রিক ভারতে এই মনোভাব নতুন নয়। আর এই মনোভাবের জেরেই বছরের পর বছর ধরে কন্যা সন্তানকে অবহেলা, যেন ভারতের আত্মায় ঢুকে পড়েছে। সরকারি প্রচার থেকে শুরু করে জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজ, উত্তরকাশির ঘটনা ফের একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ২০১৯ সালে এসেও নারীমুক্তির স্লোগান স্রেফ খাতায় কলমেই।
২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ক্রমান্বয়ে ভারতে পুরুষ-মহিলা অনুপাতের উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কন্যাভ্রুণ হত্যার ঘটনা আজও সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। ২০১১ সালে ভারতে পুরুষ-নারীর অনুপাত অর্থাৎ, প্রতি হাজার পুরুষের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৯৪৩। আর ০ থেকে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত, প্রতি ১ হাজার পুত্র সন্তান পিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যা ৯১৯। ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে ভারতে সেই সময় প্রতি হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ছিল ৯৩৩ এবং ০ থেকে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ১ হাজার পুত্র পিছু কন্যার সংখ্যা ছিল ৯২৭।
জনগণনায় রাজ্যওয়াড়ি হিসেবেরও প্রতিফলন হয়েছে। ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী, পুরুষ-নারী অনুপাতে সবচেয়ে ভালো জায়গায় দক্ষিণের কেরল এবং পুদুচেরি। এই দুই রাজ্যেই নারীর সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে পুরুষকে। কেরলে প্রতি হাজার পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা ১০৮৪। আর ০ থেকে ৬ বছর বয়স অবধি প্রতি হাজার জন পুত্র পিছু কন্যার সংখ্যা ৯৬৪। পুদুচেরিতে প্রতি এক হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ১০৩৭। ০ থেকে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি হাজার পুত্র সন্তান পিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যা ৯৬৭। অন্যদিকে, ২০১১ সালের জনগণনার হিসেব অনুযায়ী সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় উত্তরের হরিয়ানার। সেখানে প্রতি ১ হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা মাত্র ৮৭৯। যা জাতীয় গড়ের চেয়েও কম। সেই রিপোর্টেই উঠে এসেছিল, হরিয়ানায় ০ থেকে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে প্রতি এক হাজার পুত্র সন্তান পিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যা ৮৩৪।
শুধুমাত্র হরিয়ানাই নয়। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই হারেই বেড়েছে নারী-পুরুষে অনুপাত। যা নিয়ে দ্রুত সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কিন্তু ২০১১ জনগণনার পর কেটে গিয়েছে ৮ বছর। উত্তরকাশির ঘটনা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কন্যা সন্তান আজও বোঝা। এই কুসংস্কার মিটবে কবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতেই হবে। আর এই দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। না হলে এমন দিন দূরে নয়, যখন ভারতমাতার দেশে বিরল হবেন মহিলারাই।
Comments are closed.