রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে রাজ্যর সংঘাত যে চরম জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, তার কোনও প্রতিফলন রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে পড়বে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে। আর সেই জল্পনায় ইন্ধন যুগিয়েছে কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের ভূমিকা। পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরলেও রাজ্যপালের সঙ্গে সিপিএম পরিচালিত এলডিএফ সরকারের বিরোধ তুঙ্গে। রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে কেরলের রাজ্যপালের মূল আপত্তি নাগরিকত্ব আইনকে ঘিরে। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে না জানিয়েই সরকার বিধানসভায় নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করিয়েছে। এর জেরেই তিনি বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের জন্য সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণ ফেরত পাঠিয়ে দেন। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন তাঁকে চিঠি লিখে অধিবেশন উদ্বোধনের আগের দিন অনুরোধ করেন, তিনি যেন সরকারের তৈরি করে দেওয়া বয়ানের বাইরে গিয়ে কিছু না বলেন। উদ্বোধনের দিন রাজ্যপাল রাজ্যের বয়ানের বাইরে গিয়ে কিছু বলেননি বটে। কিন্তু তিনি নাগরিকত্ব আইন সংক্রান্ত অংশ পাঠ করতে গিয়ে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বলে আমি পড়ছি ঠিকই। কিন্তু এর সঙ্গে আমি একমত নই।
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশন। সেখানে ধনখড় সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাষণই পাঠ করবেন, না তার বাইরে গিয়ে নিজের কথাও খানিকটা বলবেন, তা নিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলেও চলছে আলোচনা। এর আগে ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট আমলে তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীরের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ ছিল। তিনি সাংবিধানিক রীতি মেনে সরকারের বেঁধে দেওয়া বয়ান পড়তে চাননি বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে। পরে জ্যোতি বসুরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নালিশ করেছিলেন এবং তাঁর অপসারণ দাবি করেছিলেন। বামেদের আবদার মেনে ইন্দিরা গান্ধী ধরমবীরকে সরিয়েও দিয়েছিলেন। তারপর আর কোনও সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধ এই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানায় সরকার অনেক রাজ্যপালের অনেক কাজকর্মের সমালোচনা করেছে, অনেক কাজের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তার বেশি কিছু হয়নি। তৃণমূলের ১১ বছরের শাসনে এই প্রথমবার রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের সংঘাত রীতিমতো যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
এই রাজ্যের রাজ্যপালের সঙ্গে নবান্নের সংঘাত শুরু একেবারে প্রথম থেকেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা-সহ সব বিষয় নিয়েই তিনি রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন বিভিন্ন সময়ে। রাজ্যের তাবড় মন্ত্রীরা তো বটেই, এমনকী খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। মমতা তো পরিষ্কার অভিযোগ করেছেন, রাজভবন থেকে রাজ্যপাল সমান্তরাল প্রশাসন চালাচ্ছেন। রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের সংঘাত এমন জায়গায় চলে গিয়েছে যে, শাসকদল সংসদের বাইরে এবং ভিতরে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশও জানানো হয় তৃণমূলের তরফ থেকে। রাজভবনে বসে এবং তার বাইরে জগদীপ ধনখড় যতবার সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, তা রীতিমতো নজিরবিহীন। এর আগে আর কোনও রাজ্যপালকে এভাবে ঘন ঘন সাংবাদিক বৈঠক ডাকতে দেখা যায়নি। কেরলের রাজ্যপালের মতো ধনখড়ও নয়া নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে একেবারে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ভাষায় সওয়াল করেছেন। তার জন্য তাঁকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্র সমালোচিত হতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে ‘বিজেপির দালাল’-এর মতো মন্তব্যও। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীকে রাজভবনে চা চক্রে ডেকেও রাজ্যপাল বিরোধ কমাতে পারেননি। যাদবপুরের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও ছাত্র বিক্ষোভের জেরে রাজ্যপালকে ফিরে যেতে হয়েছে। নজরুল মঞ্চে এই সমাবর্তনে ছাত্র বিক্ষোভের পিছনে শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদত ছিল বলে রাজভবনের অভিযোগ। রাজ্যপাল স্বয়ং বলেছেন, এটা পূর্বপরিকল্পিত। এর পিছনে কারা ছিল,সকলেই জানে। এর পর ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুদিনে শেষ বোমাটি ফাটিয়েছেন রাজ্যপাল ব্যারাকপুরে। তিনি অভিযোগ করেন, রাজ্যে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিস্ফোরক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। এখানে সবাই একটাই শব্দ বোঝে, সেটা হল রাজনীতি। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের তরফে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যটার্জি বলেন, বারবার এ ভাবে নৈরাজ্যের কথা বলে রাজ্যপাল আসলে নৈরাজ্যকেই মদত দিচ্ছেন। এখানেই শেষ নয়। ব্যারাকপুরে রাজ্যপাল সেখানকার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মাকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করে আবার বিতর্কে জড়িয়েছেন। এ ব্যাপারেও তাঁকে সমালোচিত হতে হয়েছে।
এই আবহেই প্রশ্ন উঠেছে, বাজেট অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে রাজ্যপাল সরকারের বেঁধে দেওয়া বয়ানের বাইরে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিংবা নাগরিকত্ব আইন নিয়ে নিজের কথা বলে বসবেন না তো? যদি সত্যিই সেরকম কিছু ঘটে, তবে সেটা হবে নজিরবিহীন। এখন রাজভবন আর নবান্নের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। দেখা যাক, কে জেতে এই যুদ্ধে।
Comments are closed.