১,২৫০ বছর আগে তৎকালীন বঙ্গে এসেছিলেন পূর্ব পুরুষেরা, ‘হড়’ বাড়ির পুজোর বয়স ৩৪২ বছর; কলকাতার কাছেই, ঘুরে আসবেন নাকি প্রাচীন এই পুজোয়?  

কলকাতা আর দুর্গাপুজো এক কথায় সমার্থক। থিমের পাশপাশি বিনেদিয়ানা, সব মিলিয়ে তিলোত্তমার পুজোর জুড়ি মেলা ভার। তবে আপনি যদি প্রকৃতি প্রেমী হন, একটু নির্জনে পুজো কাটাতে চান। যেখানে আলোর রোশনাই নেই, মানুষের ভিড় নেই। যেখানে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার পথে হয়তো কাশ ফুলের দেখা পেলেন। শহরের অনেক কিছুই নেই, তবু এমন কিছু রয়েছে যা আপনাকে মুগ্ধ করবে, দু’দণ্ড শান্তি দেবে। একই সাথে ইতিহাসের হাতচ্ছানি, ঐতিহ্যের ছোঁয়া। আজ সেরকমই এক পুজোর সন্ধান আপনাদের জন্য। 

আজ থেকে প্রায় ১২৫০ বছর আগের কথা। আদিশুরের সময় কৌনজ থেকে কাশ্যপ গোত্রীয় ‘হড়’ পদবীর ব্রহ্মণরা তৎকালীন বঙ্গদেশে আসেন। এঁদেরই একটি অংশ সেই সময়ের বঙ্গ এবং বর্তমানে বাংলা দেশের নড়াইলের সেনহাটি থেকে এপার বাংলার হারোয়ার গোপালপুর গ্রামে চলে আসেন। সুন্দরবন জনবসতি স্থাপন এবং হিন্দু ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণনগরের রাজবংশ ‘হড়’দের জমি দেন। শুরু হয় জমিদারি। এবং এই হড় বংশেরই পূর্ব পুরুষ রামজয় হড় চৌধুরী দুর্গা পূজার সূচনা করেন। 

এই সমস্ত কিছুই জানা গেল এই বংশের বর্তমান সদস্য অর্ঘ্য চৌধুরীর থেকে। এখানে বলে রাখা ভালো, চৌধুরী এনাদের জমিদারি প্রাপ্ত পদবী। অর্ঘ্যই পুজোর খুঁটিনাটি নিয়ে TheBengalStory-এই সঙ্গে কথা বললেন। জানালেন, উল্টো রথের দিন থেকেই মোটামুটি পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ওইদিন প্রতিমার কাঠামো কাটা হয় এবং জন্মাষ্টমীর দিন থেকে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। সেই শুরুর দিন কৃষ্ণনগর থেকে বিহারী পাল আসতেন প্রতিমা গাড়িতে, তাঁর সহযোগী ছিলেন নিরঞ্জন মালি। ৩৪২ বছর পেরিয়েও সেই নিরঞ্জন মালির বংশধরেরাই পুজোর প্রতিমা গড়ে আসছেন। অর্ঘ্য বাবু জানান, জমিদারির সময় পুজোও হত মহাসমারোহে। সপ্তমীতে সাতটি, অষ্টমীতে আটটি এবং নবমীতে নটি পাঁঠা এবং মোষ বলি হত। জমিদারি আমলে পুজোতে ১০/১২ মণ চিঁড়ে মুড়ি, নারকেল নাড়ু, ভোগ দর্শনার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হত। 

অর্ঘ্য বাবুর কথায়, ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর সেই জৌলুস অনেকটাই কমেছে। জ্যোতির্ময় হড় চৌধুরী এবং সময় চৌধুরী বলি প্রথা বন্ধ করেন। বাহুল্য কমলেও আজও বাড়ির সদস্যরা একই রীতিনীতি মেনে পুজো করে আসছেন। পুজো নিয়ে অর্ঘ্য বাবু জানান, ” বনেদি বাড়ির রীতি নীতি মেনেই পুরোনো পট ও একচালায় সাড়ে চার হাত প্রতিমা তৈরী হয়। পরিবারের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় ও জমির আয়ের উপর চলে বর্তমান পুজোর খরচ-খরচা। মহালয়ার বোধন হত ত্বোপধ্বনি দিয়ে। মহালয়া থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত চন্ডীপাঠ ও ভোগ বিতরন হত। ষষ্ঠীর দিন বোধনতলায় বোধন হত। সপ্তমী তে আখ ও সাতসাগরের জল দিয়ে মাকে মহাস্নান করিয়ে দালানে তোলা হত। মাঝিরা জল আনত। গাঙ্গুলী বাড়ি ছিলেন পুরোহিত। পরে, কলশুর, টাকি, যদুরহাটি থেকে পুরোহিত আসতেন। আজো অষ্টমীর দিন প্রসাদ বিতরণ দেখলে সেই পুরোনো দিনের ছবি অনেকটাই ফুটে ওঠে। হড় চৌধুরীদের অনেকেই এখন আর এই গ্রামে থাকেন না, কিন্তয়পুজোর বনেদিয়ানা ও ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে সকলেই চলে আসেন গোপালপুর গ্রামে। আজো হাড়োয়ার গোপালপুরের পুজো বলতে স্থানীযরা এই হড় চৌধুরী বাড়ির পুজোই বোঝেন এবং বছর ভর অপেক্ষায় থাকেন।” 

মায়ের বিসর্জন নিয়েও বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেন অর্ঘ্য। জানান, ” আজও বিদ্যধরীর তীরে সর্বপ্রথম হড়’দের প্রতিমাই বির্সজন করা হয়। দশমীর দিন দালানের সামনে ৩ফুট বাই ২ফুটের গর্ত করা হয় ও তা জল দিয়ে ভর্তি করা হয়। পরিবারের বয়ঃজেষ্ঠ সেই গর্তে নামেন। অন্যদিকে পরিবারের সবাই তাঁর আশীর্বাদ নেন ও কোলাকুলি ও মিষ্টিমুখ পর্ব। প্রথাটি কাদামাটি নামে পরিচিত।” 

হড় চৌধুরী পরিবারের তরফে ইতিমধ্যেই নেট মাধ্যমে তাঁদের বাড়ির পুজো দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একটি অন্যরকম পুজো কাটাতে চাইলে কলকাতার কাছেই প্রাচীন এই পুজোয় একটা দিন কাটিয়ে আসতে পারবেন। কীভাবে যাবেন? 

শিয়ালদহ মেন শাখার হাসনাবাদ লোকালে করে আপনাদের নামতে হবে মালতিপুর স্টেশনে। সেখান থেকে অটো করে গোপালপুর হাটখোলা। হাটখোলা কালিমন্দির থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই আপনি পৌঁছে যাবেন হড় চৌধুরীদের ৩৪২ বছরের প্রাচীন পুজোয়। 

বিশেষ ধন্যবাদ- অভিষেক হড় চৌধুরী   

 

 

Comments are closed.