হেলথ ইন্সিওরেন্স কী ও কেন? করোনা পরিস্থিতিতে মেডিক্লেম পেতে গেলে কী করণীয়? করোনা কভার থাকলেও কোন ক্ষেত্রে ক্লেম পাবেন না?

শরীর থাকলে সমস্যা হবেই। আধুনিক জীবনধারায় সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নানারকম শারীরিক সমস্যা, অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা। স্ট্রেস লেভেল, অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া আর পরিবেশ দূষণ, এসব মিলেমিশে ক্রমেই বাড়ছে অসুখ-বিসুখ, ভাইরাস সংক্রমণ। এদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে দিন দিন আকাশছোঁয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রের খরচ। এখানেই বৃদ্ধি পাচ্ছে হেলথ ইন্সিওরেন্সের গুরুত্ব।

 

হেলথ ইন্সিওরেন্স কত প্রকার? 

মোটামুটি দু’ধরনের স্বাস্থ্য বিমা হয়। সরকারি ও বেসরকারি হেলথ ইন্সিওরেন্স। সরকারি হেলথ ইন্সিওরেন্সের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল, ইউনাইটেড, ওরিয়েন্টাল, নিউ ইন্ডিয়া ইন্সিওরেন্স। এই চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্য বিমা সংস্থার মধ্যে আবার ন্যাশনাল, ইউনাইটেড ও ওরিয়েন্টাল ইন্সিওরেন্সের সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ক্রমাগত লোকসানের ফলে সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত বলে জানাচ্ছে মোদী সরকার।

দিন দিন চিকিৎসা যেভাবে খরচ সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি যদি ৬ শতাংশ হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই খরচ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে গরিব মানুষ তো দূর অস্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছেও চিকিৎসার খরচ একটা বড় ইস্যু। আর এখানেই হেলথ ইন্সিওরেন্সের প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা আছে, কেবল বয়স্কদের ক্ষেত্রেই হেলথ ইন্সিওরেন্স লাগবে, কম বয়সীদের লাগবে না। এটা একেবারেই ভুল ভাবনা। আমার এক পরিচিত আত্মীয় যুবক হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান। তার প্রেশার মেপে দেখা যায় ৪০০! ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল ছেলেটির দুটো কিডনিই অকেজো। এবার ডায়ালিসিস এবং কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের যে খরচ তা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই হেলথ ইন্সিওরেন্স করুন কম বয়সেই।

এবার আসি করোনা পরিস্থিতিতে মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্সের কথায়। করোনা হেলথ ইন্সিওরেন্সের সুবিধা,

কোন কোন ক্ষেত্রে পেতে পারেন মেডিক্লেম? 

করোনা রোগীদের সুস্থতার হার বৃদ্ধি পেলেও রোজ রোজ এই ভাইরাসকে নিয়ে যে গবেষণা ও তথ্য উঠে আসছে তাতে চিকিৎসার ধরণও কিছুটা পালটে যাচ্ছে। করোনার ক্ষেত্রে দু’ধরনের পলিসি হয়। করোনা স্পেসিফিক ডিজিস যেটা করোনা পলিসি বলে নানা বেসরকারি বিমা সংস্থা নাম দিয়েছে। এতে মোটামুটি আবার তিন রকমের পলিসি হয়, সাড়ে তিন মাস, সাড়ে ছয় মাস এবং সাড়ে নয় মাসের। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থাগুলি রিনিউয়েবল পলিসি এ পর্যন্ত চালু করেনি। তবে কিছু বেসরকারি কোম্পানিগুলি করোনার রিনিউয়েবল পলিসি করেছে। যা প্রত্যেক বছর নবীকরণযোগ্য। এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন, সরকারি বিমা সংস্থাগুলিতে প্রিমিয়াম প্রায় তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রিমিয়ামের অঙ্ক উত্তরোত্তর বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রত্যেকদিনই নতুন নতুন সরঞ্জাম আসছে, চিকিৎসা পরিষেবার পরিবর্তন হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে চিকিৎসার খরচও বাড়ছে। তবে সাধারণত, কিছু ইঞ্জেকশন আর সাধারণ কিছু ওষুধপত্র ছাড়া করোনা রোগীর ওষুধে তেমন কোনও খরচ নেই। অনেক ক্ষেত্রে করোনা রোগীকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই রোগীর ইসিজি করে নেওয়া দরকার। ইসিজি রিপোর্টে কোনও অসুবিধার কথা উল্লেখ থাকলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নেওয়া একেবারেই উচিত নয়। এতে হার্ট ড্যামেজ হতে পারে।

আর করোনা কভার বিমা কেনার ১৫ দিনের মধ্যে যদি আপনি করোনা সংক্রমিত হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে মেডিক্লেম পাবেন না।

বর্তমানে করোনার ক্ষেত্রে তিন রকমের চিকিৎসা হচ্ছে। একটা হল, হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা। দুই, হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা। এবং তিন নম্বর হল হোটেল কিংবা কোনও ভবনে রেখে চিকিৎসা করা। যেগুলোকে আমরা সেফ হোমে থেকে চিকিৎসা বলে জেনে আসছি। জেনে রাখা জরুরি, এই সেফ হোমে থাকা রোগীরা মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্সের সুবিধা পাবেন না। কারণ, করোনার ক্ষেত্রে আইসিএমআর দু’রকমের চিকিৎসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একটা হল হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা এবং অন্যটি হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা। হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা করাতে গেলে আগে আইসিএমআর স্বীকৃত সেন্টার থেকে কোভিড টেস্ট প্রয়োজন। সেটা ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা পাবেন না। হোম আইসোলেশনে থেকে মেডিক্লেম পেতে হলে প্রথমেই চিকিৎসকের ছাড়পত্র প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনে যেন চিকিৎসক উল্লেখ করে থাকেন যে, হাসপাতালে বেড নেই তাই হোম আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। হোম আইসোলেশনে থাকাকালীন চিকিৎসকের দেওয়া প্রত্যেকদিনের ইন্টারন্যাল ট্রিটমেন্ট রিপোর্ট থাকতে হবে। প্রতিদিনের ব্লাড প্রেশার লেভেল, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, পালস রেটের সার্টিফিকেট নিতে হবে। সুস্থ হওয়ার পর দ্বিতীয়বার কোভিড টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসতে হবে। এই জিনিসগুলো ধাপে ধাপে মানলে তবেই হোম আইসোলেশনে থেকে মেডিক্লেমের সুবিধা পাওয়া যাবে। তাছাড়াও, যদি রোগীর জন্য বাড়িতে নার্স রাখা হয়, তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর সহ প্যাডে বিল থাকতে হবে।

করোনা কভার পলিসি করার সময় প্রি-একজিসটিং (আগে থেকেই যে রোগ ছিল) ডিজিসের কথা অবশ্যই উল্লেখ করবেন। এতে যদি বিমা বাতিল হয়ে যায় তাও ভালো। কিন্তু কো-মর্বিডিটি থাকলে করোনা রোগীদের মেডিক্লেম দিতে অস্বীকার করছে বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিমায় আগে থেকে উল্লেখ থাকতে হবে আপনার প্রি-একজিসটিং ডিজিসের কথা। তবেই মিলছে মেডিক্লেম। তাই আপনি যদি ধূমপায়ী হন সেটাও আগে থেকে উল্লেখ করুন। তবে অনলাইনে ১০ শতাংশ ছাড় থাকলেও প্রি-একজিসটিং ডিজিস সম্পর্কে জানানোর কোনও জায়গা নেই। তাই অফলাইনে এজেন্ট দিয়ে প্রি-একজিসটিং ডিজিসের কথা জানিয়ে দিন। করোনা কভারে ডিসপোজাল আইটেম যেমন পিপিই কিট ইত্যদি সব কভার পাওয়া যায়।

হাসপাতালে চিকিৎসায় ডিসপোজাল আইটেম, ইনবেড পলিসি পাওয়ার জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমায় রাইডার বেনিফিশিয়ারি পেতে পারেন। তার জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে রাইডার ঢুকিয়ে নিতে হবে স্বাস্থ্য বিমা নবীকরণের আগেই। মাঝপথে যোগ করা যাবে না। তাই সামনে যাঁদের স্বাস্থ্য বিমার নবীকরণের তারিখ, তাঁরা তখনই রাইডার যোগ করে নিতে পারেন।

 

অনলাইন পলিসি বনাম অফলাইন পলিসি 

অনলাইনে স্বাস্থ্য বিমা কিনলে প্রিমিয়াম ১০ শতাংশ কম হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, ক্লেম করার ক্ষেত্রে সেখান থেকে কোনও সাহায্য পাবেন না। মাউন্ট এভারেস্টে চড়তে গেলে গাইড দরকার, গুগল ম্যাপ ততটা সাহায্য করবে না। তাই স্বাস্থ্য বিমাতেও হ্যাকল-ফ্রি ক্লেম পাওয়ার জন্য চেনা ও নির্ভরযোগ্য এজেন্টের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিমা করুন। এতে ক্লেমের সময় সুবিধা পাবেন।

 

(লেখক বিশিষ্ট ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার। বিমা বা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে কোনও পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করুন: 98363 74487, 98356 66559, [email protected])

Comments are closed.