বাড়ির পুজো থেকে সার্বজনীন হয়ে ওঠা বলাগড়ের ‘বুড়িমা’র দুর্গা পুজোর অজানা কথা    

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজোর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনি, উপকথা বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলের ভাঁজে ভাঁজে লুকোচুরি খেলে। তেমনই এক ঘটনা হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের অন্তর্গত সোমড়া বাজারের  ‘সোমড়া আঞ্চলিক দুর্গোৎসব’ তথা ‘বুড়িমা’র পুজোর ইতিহাস।

 

মহামারির বাজারে এই বছরে মায়ের আরাধনা নানা বিধিনিষেধের মধ্যে দিয়েই চলছে।বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারি, সব জায়গাতেই সুরক্ষার অন্ত নেই। বুড়িমার পুজোও সেই সব নিষেধাজ্ঞার বাইরে নয়। বুড়িমার পুজোর ইতিহাস খুঁজলে জানা যায়, একদা এই পুজো সোমড়ার মুখার্জি বাড়ির পুজো ছিল। সঠিক কোন সময় থেকে এই পুজো শুরু হয়েছে সেই বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্যই জানা যায় না। তবে ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই পুজোর দলিল দস্তাবেজ পাওয়া যায় বলে পুজো কমিটির সদস্য বিদ্যুৎ ব্যানার্জি জানাচ্ছেন। তখনও এই পুজো বাড়ির পুজো হিসেবেই পরিচিত ছিল।

 

মুখার্জি বাড়ির উত্তরাধিকার পাঁচু গোপাল মুখার্জির খুবই কম বয়সে মৃত্যু হয়। এবং ছয় মাসের মধ্যে তাঁর স্ত্রীও দেহত্যাগ করেন। পাঁচু গোপাল মুখার্জি ও তাঁর স্ত্রী যখন মারা যান, তখন তাঁদের পাঁচ সন্তান সোনা রানী মুখার্জি (১১ বছর), কার্তিক মুখার্জি (৬ বছর) গণেশ চন্দ্র মুখার্জি (৩ বছর) রমেশ চন্দ্র মুখার্জি (১ বছর) গায়ত্রী মুখার্জি (৬ মাস) বর্তমান ছিলেন।এই রকম অবস্থায় সোনা রানী দেবীর মামারা তাদের নিয়ে এলাহাবাদে চলে যান। এবং তাঁদের সোমড়ার বাড়ি ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়। বছর পাঁচেক ধরে বাড়ির পুজো বন্ধ থাকে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাড়ার কয়েকজন এই পুজোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পরিবারের কাছে আবেদন জানালে পুজোটিকে পাড়ার মানুষদের করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সময় থেকে আবার পুরনো বেদিতেই পুজো শুরু হয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে দেখা যায় পরপর দুই বছর পুরোনো বেদিতে পুজো হওয়ার ফলে নানারকম দুঃসংবাদ ঘটতে থাকে। তাই তৃতীয় বছর থেকে এই পুজোর বেদির পাশে একটি কাঁচামাটি দিয়ে বেদি করা হয় এবং সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে বুড়িমার পুজো সেখানেই হয়।

 

‘সোমড়া আঞ্চলিক সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ কমিটির সদস্য তপন রায় জানাচ্ছেন, পাঁচু গোপাল মুখার্জি শেষ সময়ে খুব দারিদ্রের মধ্যে দিনযাপন করতেন। তার ফলে একসময় মায়ের পুজো করার মতো সামর্থ তাঁর ছিল না। কথিত আছে, সেই সময় মা স্বপ্নে পাঁচু গোপাল বাবুকে দেখা দিয়ে একটা থোড় দিয়ে পুজো দিতে বলেছিলেন। সেই থেকে বুড়িমার নবমীর নৈবেদ্যতে থোড় দেওয়ার রীতি আজও প্রচলন আছে। এই পুজোর ইতিহাস এতটাই প্রাচীন যে, ঠিক কবে থেকে এই পুজো শুরু হয়েছে তার কোনেও সঠিক তথ্য না পাওয়া যাওয়ায় লোকমুখে এই পুজো ‘বুড়িমা’র পুজো নামে খ্যাত হয়ে গেছে।

পাঁচু গোপাল মুখার্জির বড় মেয়ে সোনা রানী মুখার্জি সাথে বিয়ে হয়েছিল চন্দননগরের বাগবাজারের বাসিন্দা বিমলাপতি চ্যাটার্জির। পরবর্তীকালে সোনা রাণী চ্যাটার্জি সোমড়ার এই বাড়িতে ফিরে আসেন। এবং বর্তমানে তাঁর সন্তান প্রভাত চ্যাটার্জি এখানে বাস করেন। প্রভাতবাবু এখন এই পুজোর অন্যতম সদস্য। তাঁর কথা থেকে জানা যায়, বুড়িমার পুজো সোমড়ার পুরোনো এক ঐতিহ্যকে আজও বহন করে নিয়ে চলছে। বুড়িমার এই পুজো সোমড়ার কোনও পুরোহিত করেন না। এখন এই পুজোর পুরোহিত কাটোয়া নিবাসী সনাতন চক্রবর্তী ও বিমল মুখার্জি।

গ্রাম বাংলার বাড়ি এবং বারোয়ারি পুজোর ইতিহাসের প্রাচীন দস্তাবেজ ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু সবসময় সেগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এক সামান্য বাড়ির পুজোকে ইতিহাসের পাতায় হারানোর হাত থেকে রক্ষা করে সোমড়ার সেই সময়েরক কয়েকজন মানুষ ‘বুড়িমা’র পুজোকে এক নবরূপ দান করে ‘সোমড়া আঞ্চলিক সার্বজনীন দুর্গোৎসব’এ পরিণত করেন। বর্তমান প্রজন্ম সেই ধারাবাহিকতাকে এখনও স্বমহিমায় বহন করে নিয়ে চলেছেন।

 

Comments are closed.