‘বাস স্ট্যান্ডে বাবাকে দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল’, কোটা থেকে রাজ্যের উদ্যোগে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা লিখলেন মুর্শিদাবাদের ছাত্রী

অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। বাস স্ট্যান্ডে নেমে যখন বাবাকে দেখতে পেলাম, চোখে জল এসে গিয়েছিল। খুব কষ্টে ও দুশ্চিন্তায় আমার বাবা ও মা গত একমাস উপর কাটিয়েছে। আমিও। ভিন রাজ্যে পড়তে গিয়ে এই অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে স্বপেও ভাবিনি। ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব। সেই মতোই এগোচ্ছিল পড়াশোনা। গত বছর বেলডাঙা সিআরজিএস হাই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর জুন মাসে সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মতো আমিও মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষার (NEET) জন্য পড়াশোনা করতে রাজস্থানের কোটায় পাড়ি দিয়েছিলাম।
সেখানে অ্যালেন কেরিয়ার ইনস্টিটিউটে দিব্যি চলছিল পড়াশোনা। হস্টেলে থাকতাম। কোর্স আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর শুধুই চলছিল বিভিন্ন রকমের মক টেস্ট। সেগুলিও প্রায় শেষের পর্যায়ে ছিল। তখনই হঠাৎ এই লকডাউনের কথা ঘোষণা করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম দিকে এই লকডাউনের গুরুত্ব বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল। হস্টেলের বাইরে বেরনো তো এক প্রকার বন্ধই ছিল। আমাদের খাবার হস্টেল থেকেই দিত। এই লকডাউনের ঘোষণার পর থেকেই দেখালাম, ধীরে ধীরে খাবারের মান পড়ে যেতে লাগল।
যেখানে আমাদের দুপুরে ভাতের সঙ্গে ডাল ও দু’রকমের তরকারি দেওয়ার কথা, সেখানে কিছুদিন পর থেকেই একটা তরকারি দেওয়া শুরু হল। এছাড়াও খাবারে ফল থাকার যে কথা ছিল, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। হস্টেলের অনেক কর্মীই নিজেদের বাড়ি চলে যাওয়ায় এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হল আমাদের। আমি যে হস্টেলে থাকতাম আমাদের অবস্থা তাও তুলনামুলকভাবে ভাল ছিল বলা যায়। কিন্তু যাঁরা পেয়িং গেস্ট হিসেবে ছিল বা অন্যান্য জায়গায় ছিল তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হয়। টাকা দিয়েও তাঁরা অনেকেই খাবার পায়নি।
এছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য সেই অর্থে সেরকম কোনও দোকান খোলা ছিল না। খুব দরকারি জিনিসগুলো অর্ডার দিয়ে আনাতে হচ্ছিল। এবং সেসবই নির্দিষ্ট দামের থেকে অনেকটাই বেশি দিয়ে। প্রথম দফার লকডাউনের পর মনে হয়েছিল যে সব কিছু খুলে যাবে। তাই ১৮ এপ্রিলের উদয়পুর-শালিমার এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে রেখেছিলাম। কিন্তু লকডাউন আরও বেড়ে যাওয়ায় সেই ট্রেন বাতিল হয়ে যায়। তারপর থেকে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যেই সময় কাটছিল।
এর মধ্যেই একদিন খবর পেলাম উত্তরপ্রদেশ সরকার কোটায় পড়তে আসা ৭-৮ হাজার ছাত্রছাত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। সেই খবরটা শোনার পর থেকেই আমরাও আশায় বুক বাঁধছিলাম, এবার হয়ত আমাদেরকেও বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর অসম, মধ্যপ্রদেশের মতো আরও রাজ্য তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু করল।
আমরাও পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে ছিলাম। বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিল। আমার পরিবারের লোকজন মুর্শিদাবাদের ভারত সেবাশ্রম সংঘের এক মহারাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও তিনি বহরমপুরের সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এছাড়াও অনেকরকম ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। নবান্নেও ফোন করে আমাদের কথা জানাই।
কোটায় আমরা পশ্চিমবঙ্গের ২,৫৬৮ জন ছাত্রছাত্রী ছিলাম। গত ২৭ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির টুইটের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি যেতে পারব ভেবে খুবই আনন্দ হয়েছিল।
২৯ এপ্রিল ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের বাসে তোলা হয়। বাসে ওঠার আগে হয় থার্মাল স্ক্রিনিং। এরপর প্রায় ৩০ জন ছাত্রছাত্রী ও অবিভাবককে নিয়ে ছাড়ে আমাদের বাস। বাসে ওঠার সময় আমাদের প্রত্যেকের জন্য শুকনো খাবার, জল ও ফলের ব্যবস্থা করা হয়। বাসে লাগেজও তুলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিট নাগাদ বাস ছাড়ে। মোট ১২৪ টা বাস ছাড়ে। আমাদের বাসের সংখ্যা ছিল ৯৮। কিন্তু বাসে করে বাড়ি ফেরার এই অভিজ্ঞতাও যে খুব সুখকর ছিল তেমনটা নয়। বাস ছাড়ার পর থেকে বাস কোথাও দাঁড়ায়নি। শুধু একবার একটা পেট্রোল পাম্পে দাঁড় করানো হয় বাস। সেখানে পাশেই একটা ধাবা ছিল। আমরা সেখানে ওয়াশ রুম ব্যবহার করি। এরপর একেবারে দাঁড়ায় এলাহাবাদে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। তাও পরেরদিন দুপুর ৩টে নাগাদ। সেখানে আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও ওখান থেকেই আমাদের রাতের জন্য খাবার প্যাক করে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার পর আবার ছাড়ে বাস। কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পরই আমাদের বাস আটকে দেওয়া হয়। এলাহাবাদ রোডের উপর দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয় আমাদের বাসকে। জানা যায়, আমাদের মতোই বেঙ্গালুরুর পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই বাসে তিনজনের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসায় আটকে দেওয়া হয় তাঁদের। তখনই আমরা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর স্ত্রীকে ফোনে বিষয়টি জানানোর পর, তিনি আমাদের সঙ্গে এলাহাবাদের সাংসদ রিতা বহুগুণা যোশীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তাঁকে সব কিছু খুলে বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাসটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। একসাথে অনেকগুলি বাস ছিল ও পুলিস আমাদের এসকর্ট করে নিয়ে যায়। রাতে আর কোথাও দাঁড়ায়নি বাস।
এর মাঝে শুধু চা খাওয়ার জন্য ও বাথরুম ব্যবহারের জন্য পেট্রল পাম্পের সামনে দাঁড় করানো হয় বাস। পরেরদিন বিকেল চারটে নাগাদ আমারা পৌঁছোই চিত্তরঞ্জনে। সেখানে প্যানরোমা রিসোর্টের সামনে আমাদের বাস দাঁড় করানো হয়। সেখানে আমাদের খাবার দেওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে এসবিএসটিসির বাসে করে সবাইকে নিজের নিজের জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি বহরমপুর স্টেডিয়ামে নামি বাস থেকে। সেখান থেকে প্রায় ১৮ কিমি আমার বাড়ি। আমি সেখানে পৌঁছনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা গাড়ি নিয়ে পৌঁছোয়। বাবাকে দেখতে পেয়েই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। তারপর গাড়িতে করে বাড়ি ফিরতে প্রায় ১১ টা বেজে যায়।
এই পুরো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহেলটকে। এবং অবশ্যই সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীকে। বাড়িতে সবাই খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল। বাবা এই কদিনে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। সবাইকে আবার ঠিকমত দেখতে পাব কিনা জানতাম না। কিন্তু এখন বাড়িতে সবাই খুব খুশি। বাড়িতে ফিরে এখন আবার মায়ের হাতের রান্না ও বাবার আদর খাচ্ছি। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার মত হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর প্রতি এই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

(অনুলিখন: অভিজিৎ দাস)

 

Comments are closed.