এনআরসির জন্য যে কোনও নথি, যেখানে জন্মের তারিখ ও জন্মস্থানের উল্লেখ রয়েছে, তা নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে দাখিল করা যাবে। এমনই জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু বিপুল পরিমাণ ভারতীয়, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের জন্ম শংসাপত্র বা বার্থ সার্টিফিকেটই (Birth certificate) নেই। তথ্য বিশ্লেষণধর্মী মাধ্যম IndiaSpend.com এ উঠে এসেছে তেমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
যদিও বয়স্ক মানুষের জন্ম শংসাপত্র না থাকলেও, অন্য কোনও নথি থাকার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু মূল সমস্যা ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়ে। যাদের বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্ম শংসাপত্রই একমাত্র আইডেন্টিটি। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ৪-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ সালে ৫ বছরের কম বয়সী প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ৩ জনের জন্ম রেজিস্ট্রার্ড হয়েছে এবং বার্থ সার্টিফিকেট রয়েছে। যা সামগ্রিকভাবে ৬২.৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ সালে যা ছিল মাত্র ২৬.৯ শতাংশ।
এর অর্থ হল, দেশজুড়ে ৩৭.৭ শতাংশ শিশুর বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্ম শংসাপত্র (Birth certificate) নেই। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জন শিশু জন্ম জন্মগ্রহণ করলে, তার মধ্যে ৩৮ টি শিশুরই জন্ম শংসাপত্র নেই! কিন্তু এর কারণ কী?
ইন্ডিয়া স্পেন্ড তার রিপোর্টে দেখেছে, সাধারণভাবে ২০০৫ সালের আগে যারা জন্মেছে, তাদের বার্থ সার্টিফিকেট থাকার সম্ভাবনা কম। তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক কালে এই হার অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু একেবার গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করা, তফশিলি জাতি ও উপজাতি এবং যে সমস্ত পরিবারে স্কুল শিক্ষার চল নেই, সেখানে জন্মের শংসাপত্র তৈরি করার প্রথা অত্যন্ত কম।
কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এনআরসিতে বার্থ সার্টিফিকেট (Birth certificate) জন্মের তারিখ এবং জন্মস্থানের প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর পিআইবি থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আধার, ভোটার কার্ড এবং পাসপোর্ট নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়।
বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, বর্তমান ভারতে প্রত্যেকটি জন্ম এবং মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয় না। এর নেপথ্যে থাকতে পারে একাধিক কারণ। তবে মূলত রাজ্যগুলোর দুর্বল পরিকাঠামো, দারিদ্র্য এবং সামগ্রিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবই এর অন্যতম কারণ।
এই প্রসঙ্গেই গত বছর ২৬ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল একটি প্রতিবেদন। তাতে বর্তমান পরিকাঠামোর বিশ্লেষণ করে দেশব্যাপী এনআরসির বাস্তবতা খতিয়ে দেখেছিলেন শমিকা রবি এবং মুদিত কাপুর। তাতে উঠে এসেছিল, বর্তমান পরিকাঠামো ব্যবহার করে দেশজুড়ে এনআরসি করতে গেলে তা ব্যাপক আকারের গোলমাল এবং বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত হবে।
প্রতিবেদনেই তার কারণও তুলে ধরেছিলেন শমিকা রবি ও মুদিত কাপুর। তাঁরা জানাচ্ছেন, ১৮ বছরের কম বয়সের বালক-বালিকাদের ভোটার কার্ড হবে না। ফলে তারা যদি কমপক্ষে দশম কিংবা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা না করে, তাহলে স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। ফলে বার্থ সার্টিফিকেটই তাদের একমাত্র পরিচয় পত্র। কিন্তু তাও যদি না থাকে, তবে কী হবে?
কী হবে তার জ্বলন্ত উদাহরণ অসম। সেখানে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় বাদ পড়েছিল ৪০ লক্ষ মানুষের নাম। এর মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু। কারণ, তাদের মা-বাবা সন্তানের বার্থ সার্টিফিকেট দাখিল করতে পারেননি। গোটা দেশের চিত্রটিও কার্যত এরকমই।
ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, ভারতে গত ৫ বছরে ২৪ মিলিয়ন বা ২ কোটি ৪০ লক্ষ শিশু, যাদের বয়স ৫ এর কম, তাদের জন্ম রেজিস্ট্রিকৃত নয়।
সরকারি তথ্য বলছে, দেশের অন্তত এমন ৯ টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আছে, যেখানে জন্ম রেজিস্ট্রেশনের হার জাতীয় গড়ের চেয়েও কম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং পূর্বতন জম্মু-কাশ্মীর।
দুর্বল সরকারি পরিকাঠামো, দারিদ্র্য এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে অনুর্ধ্ব ৫ শিশুদের, যাদের বার্থ সার্টিফিকেট ভিন্ন অন্য কোনও নথি পরিচয়পত্র হিসেবে থাকে না, তাদের একটা বড় অংশের জন্মের শংসাপত্র নেই। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই নথি নির্ভর নাগরিকত্ব প্রদানের যে কোনও প্রয়াস যে চূড়ান্ত বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত হতে পারে, তার আশঙ্কা থেকেই যায়।
Comments are closed.