রোগের দাওয়াই Immunity, বাড়ছে বাজারচলতি Immuno Booster এর চাহিদা, কী খাবেন কী খাবেন না

করোনা আবহে রোজের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে কাঁচা হলুদ থেকে মুসম্বি। সব জায়গায় একই কথা, ইমিউনিটি ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু সকাল থেকে রাত, বিভিন্ন খাবার খেয়েও করোনা টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ আসছে! ইমিউনিটি থাকতেও করোনা হল কী করে?

ওষুধের দোকান থেকে অনলাইন মার্কেট, সব জায়গায় হুড়মুড়িয়ে বিকোচ্ছে Immunity Booster। খাদ্যতালিকাও সাজানো হচ্ছে ইমিউনিটি বর্ধক খাবারে (immunity builder foods.) কিন্তু সেগুলো করোনা প্রতিরোধে কতটা কার্যকর? ইমিউনিটি কখন জরুরি আর কতটা জরুরি, সেটা আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে।

একদিকে রয়েছেন রোগী, তার হাতে অস্ত্র ইমিউনিটি। প্রতিপক্ষ করোনা, তার অস্ত্র অ্যান্টিজেন। ইমিউনিটি আছে বলেই সে ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত নয়। তা হলে ইমিউনিটি কেন জরুরি? তা বোঝার জন্য জানতে হবে ইমিউনিটির কাজের প্রক্রিয়া।

 

করোনা মোকাবিলায় প্রতিরোধ ক্ষমতার কার্যকারিতা

immuno builder food

 

মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তপোক্ত হলেই কি তিনি করোনা জয়ে সক্ষম? অন্য কোনও ভাইরাস তাঁকে আক্রমণ করবে না? চিকিৎসকেরা বলছেন প্রত্যেকটি ব্যাকটিরিয়া ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে শরীরে তৈরি হয় সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি। এ ক্ষেত্রে ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে লিম্ফোসাইটস।

আর এক ধরনের ইমিউনিটি পাওয়া যায় অ্যান্টিবডির মাধ্যমে। কিন্তু করোনা নতুন। আমাদের শরীরের মেমরি সেলে এর ইমিউনিটি নেই। নেই কোনও অ্যান্টিবডিও। কারণ এটা অভূতপূর্ব। ফলে রোগীর শরীরে করোনা প্রবেশ করায় নানা ইনফেকশন ও সমস্যা তৈরি হবে। আর একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, অনেক রোগীর শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় ইন্টারলিউকিন বেরোচ্ছে। এতে মানুষের শরীরে এত বেশি ইমিউন রেসপন্স হচ্ছে যে, সাইটোকাইন স্টর্ম হয়ে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস মারতে গিয়ে নিজের শরীরের ক্ষতি করে ফেলছে। লাং, কিডনি, লিভার, ব্রেন ড্যামেজ হচ্ছে। লাইফ সাপোর্টে রাখতে হচ্ছে রোগীকে।

সুতরাং ইমিউনিটি থাকলেও করোনা বা ভাইরাসবাহিত রোগ প্রতিরোধে সে একটি ফ্যাক্টর মাত্র, একমাত্র নয়। রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলে অবশ্যই রোগকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু করোনায় সংক্রমিত হলে ইনফ্ল্যামেটরি ইমিউন রেসপন্স বেড়ে যাওয়ার মতো চিন্তার বিষয়ও কিন্তু থাকে। তবে বাজারচলতি immunity booster দুমদাম না খেয়ে প্রাকৃতিক শাক-সবজি, ফল খেলেই তা ভরপুর পাওয়া সম্ভব। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অনাক্রম্যতা এমন এক জিনিস যা বছরের পর বছর এমনকি কয়েক দশক ধরে একজনের খাদ্যাভ্যাসের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়। তাই চটজলদি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় না। তবে আপনার ডায়েটে সাধারণ পরিবর্তন করতে পারেন এমন কিছু খাবার রেখে যেগুলি শরীরের পক্ষে ভালো।

 

আমলা

amla

অনেক চিকিৎসক বিশ্বাস করেন যে ডায়েটে ভিটামিন-সি যুক্ত করলে এই করোনা আবহে বাড়তি সুরক্ষা পাওয়া যাবে। আমলার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট বৈশিষ্ট্যগুলি সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কার্যকরী প্রতিকার। তাজা আমলা পাওয়া সহজ নয়। তবে অনেক দোকানেই আমলা গুঁড়ো পাবেন। বিভিন্ন খাবারের পদে তা যোগ করতে পারেন।

সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা সারানোর জন্য আমলা একটি কার্যকরী প্রতিকার।

 

হলুদ

raw turmeric

হলুদ আমাদের প্রতিদিনের ডায়েটের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কারকিউমিন একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা হলুদে মজুত রয়েছে। হলুদের অ্যান্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্যও সবার জানা। তাই দিন শুরু করুন এক গ্লাস হালকা গরম জলে হলুদ, লেবু, আদা এবং এক চামচ মধু দিয়ে। জল খেতে খেতে গার্গলও করতে পারেন। ডাল রান্না করার সময় হলুদ গুঁড়ো অবশ্যই দিন।

 

আদা

ginger

গলার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে আদা ভীষণ উপকারী। ভারতীয় পরিবারে আদা চায়ের জনপ্রিয়তা এই কারণেই তুঙ্গে। আদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আদা সাধারণ ফ্লু বা সর্দি নিরাময়ের নিয়মিত ঘরোয়া প্রতিকার। তামিলনাড়ু তথা দক্ষিণ ভারতে ওষুধের দোকানে সুক্কু বা শুকনো আদা একটি জনপ্রিয় উপাদান। আদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে।

 

লেবু

fresh lemon

ভিটামিন সি এর অন্যতম সহজ উপলব্ধ উৎস লেবু। রোজ যে বোতলে বা পাত্র থেকে জল নিয়ে খান, সেখানে কয়েক টুকরো লেবু ফেলে রাখুন। ভিটামিন সি পেয়ে যাবেন এখান থেকেই। এছাড়া খেতে পারেন মুসম্বি।

অতিরিক্ত পরিমানে চা পান করলে শরীরের ক্ষতি হয় একথা সবাই জানি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বার বার উষ্ণ তরল পানের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। করোনা মরামারি ঠেকাতে মাস্ক পরা, বার বার হাত ধোওয়ার মত এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি টোটকা। তবে এই টোটকায় চা প্রেমীদের মন বেশ ভালো। কারণ করোনার প্রভাবে বাড়িতেও বারবার চা পানের সুযোগ মিলছে।

 

আর্সেনিকাম অ্যালবাম

immunity booster

 

সচেতনতা, আগাম সতর্কতার পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ভারতীয় বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির উপর ভরসা কেন্দ্রের আয়ুষ মন্ত্রক। আয়ুর্বেদিক, যোগাভ্যাস, ইউনানি, সিদ্ধা ও হোমিওপ্যাথি- এই পাঁচ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির উপর নির্ভর করে করোনা মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রের আয়ুষ মন্ত্রক। তাদের নির্দেশিকায় উল্লেখিত হোমিওপ্যাথি ওষুধের নাম আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ সিএইচ (Arsenicum Album 30CH)। যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে চিকিৎসক মহলেই।

 

রোগ প্রতিরোধে তুলসি

সর্দি, গলা ধরা, হাঁচি-কাশিকে ঠেকিয়ে রাখার অব্যর্থ দাওয়াই তুলসী। এখন যা পরিস্থিতি সুগার-প্রেশার-কোলেস্টেরল-ওজন, সবই রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণে। না হলে এদের হাত ধরেও বাড়াবাড়ি করতে পারে কোভিড। বৃদ্ধি করতে হবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। তুলসীর মধ্যে রয়েছে সেই গুণ। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল, জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে তুলসী। প্যাথোজেন বা ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করতে এই পাতার জুড়ি নেই। তাই জ্বর হোক বা না হোক, রোজ তুলসি পাতা চিবিয়ে খাওয়া যায়, এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না।

রোজ তুলসী পাতা কাঁচা চিবিয়ে খাওয়া সবচেয়ে ভাল। এছাড়া গরম জলে তুলসী পাতা দিয়ে সেই জল নিয়মিত পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। কণ্ঠস্বর ঠিক রাখতে অপ্রতিরোধ্য তুলসী। মধুর সঙ্গেও রোজ চার থেকে পাঁচটি কাঁচা তুলসী পাতা খেলে তা উপকার দেবে।

 

কেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম তুলসী?

tulsi

 

ফাই্টোকেমিক্যালস, বায়োফ্ল্যাভিনয়েড এবং অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট রয়েছে এতে। রয়েছে রোজমারিনিক অ্যাসিড। এটি শ্বাসনালীর ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া ও সেই সংক্রান্ত সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে। সর্দি-কাশি না হলেও রোজ কাঁচা তুলসী পাতা ৪-৫ টি চিবিয়ে খেলে গলা ভাল থাকে।

রোজ চায়ের মধ্যে তুলসী পাতা ব্যবহার করে তুলসী-টি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া মাথা যন্ত্রণা কিংবা কণ্ঠস্বর ভেঙে যাওয়ার সমস্যায় আর্য়ুবেদ চিকিৎসকরা তুলসী খেতে বলেন।

 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি করে তুলসী?

শরীরে টি-হেল্পার কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে তুলসী পাতার নির্যাস। ন্যাচারাল কিলার কোষ এবং টি-হেল্পার কোষের কার্যকলাপ ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে।

 

ইমিউনিটি কী ভাবে কাজ করে? (How Immunity Works?)

এ তো গেল immunity booster -এর কথা। কিন্তু শরীরে কীভাবে কাজ করে এই ইমিউনিটি?

করোনাভাইরাস বা অন্য কোনও ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেই আমাদের শরীর সতর্ক হয়ে যায়। তখন সেই অ্যান্টিজেনকে বাধা দিতে শরীর অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে। অ্যান্টিবডি লড়াই করে সেই অ্যান্টিজেনকে মেরে ফেলে। কিন্তু অনেক অসুখের অ্যান্টিবডি শরীরে না-ও থাকতে পারে। কোনও ইনফেকশন হলে তা আমাদের শরীরের মেমরি সেল মনে করে রেখে দেয়।

তাই ফরেন প্রোটিন শরীরে প্রবেশ করা মাত্র সে সতর্ক হয়ে যায়। ধরা যাক, কেউ ছোটবেলায় কোনও অসুখের টিকা নিয়েছিলেন বা অসুখটি খুব ছোটবেলায় হয়ে গিয়েছে। এবার অনেক বছর পরে সেই ভাইরাস আবার তাঁর শরীরকে আক্রমণ করলে, শরীরের মেমরি সেল তাকে চিনে ফেলে। তখন মেমরি সেল এমন সিগন্যাল দিতে শুরু করে যে, দশটা মেমরি সেল থেকে হাজারটা সেল তৈরি করে ফেলে। সে চিনে ফেলে শরীরের পুরনো শত্রুকে। তৎপর হয়ে সেই ভাইরাসের মোকাবিলা করে।

 

ইমিউনিটির ধরন (Types of Immunity)

immuno booster myth

 

সাধারণত মানুষ কিছু ইমিউনিটি নিয়েই জন্মায়। একে বলে ইনেট ইমিউনিটি। আর প্রকৃতিতে থাকতে থাকতে অর্জন করে অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি। এই ইমিউনিটি দু’ভাগে বিভক্ত। একটা হল ন্যাচারালি অ্যাকোয়ার্ড। পরিবেশে থাকতে থাকতে বিভিন্ন ভাইরাসের বিপক্ষে শরীর অনাক্রম্যতা তৈরি করে। অন্যটি হল আর্টিফিশিয়ালি অ্যাকোয়ারড বা কৃত্রিম ইমিউনিটি। এ ক্ষেত্রে সেই রোগের ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এরাও আবার অ্যাক্টিভ ও প্যাসিভ এই দু’ভাগে বিভক্ত। ইমিউনিটি সক্রিয় হলে তা সারাজীবন সুরক্ষা দিতে পারে। আর প্যাসিভ হলে কয়েক মাসের ব্যবধানে ইমিউনিটি বুস্টার ডোজের প্রয়োজন পড়ে।

করোনা আবহে বাজারচলতি immuno booster -এর পাল্লায় না পড়ে সাধারণ শাক-সবজি থেকেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারেন, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।

 

Comments are closed.