পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কথা আলোচনা করতে গিয়ে হঠাৎ বহু বছর আগের বিহারের রাজ্যপাল বিনোদ চন্দ্র পান্ডের নিয়োগের গপ্প মনে পড়ে গেল। ১৯৯৯ সাল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানির দপ্তর। তিনি ফোন করছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে। গাওলা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হওয়ায় লালু তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গেছেন। তাঁর পরিবর্তে লালু-পত্নী রাবড়ি দেবী সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আডবানি রাবড়ি দেবীকে ফোন করে বললেন, আমরা বিনোদ পান্ডেকে আপনার রাজ্যের নতুন রাজ্যপাল নিয়োগ করতে চলেছি। আশা করি আপনার কোনও আপত্তি নেই। রাবড়ি দেবী বললেন, দয়া করে আপনি ১৫ মিনিট পরে আর একবার ফোন করবেন? মতামত জানাচ্ছি। আমি আডবানিকে শুধালাম, এটা কী হল? কেন ১৫ মিনিট পরে? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেসে বললেন, এমনটাই উনি করেন। আমি এ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আসলে রাবড়ি দেবী এখনও আনকোরা। কিছুই জানেন না। উনি লালুপ্রসাদজীকে এখন ডেকে পাঠিয়েছেন। উনি লালুর সঙ্গে কথা বলে মত নেবেন, তারপর লালুর উপস্থিতিতেই আবার আমার সঙ্গে কথা বলবেন।
আডবানি ফোন করলেন ১৫ মিনিট পর। বললেন, বিনোদ পান্ডে ভালো মানুষ। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ক্যাবিনেট সচিব ছিলেন। লালুজি ওঁকে বিলক্ষণ জানেন। বিজেপির লোকও নন। ভালো পরিবার। জ্যোতিষী। বিয়ে থা করেনি, সারাদিন কাজ নিয়ে থাকেন। আসলে ওঁর ভাই কমল পান্ডে তখন আডবানির স্বরাষ্ট্র সচিব। পরে তিনিও ক্যাবিনেট সচিব হন। আডবানি ফোনে রাবড়ির সঙ্গে কথা বলার সময় লালুর গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছি, লালু স্ত্রীকে প্রম্পট করছেন। কিন্তু সেদিন রাজ্যপাল কাকে করা হবে তা নিয়ে আডবানি রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতেন। অনেক সময় রাজ্য সরকারের পাঠানো দু-তিনটে নাম নিয়েও আলোচনা করতেন।
এখন রাজ্যপাল নিয়োগের মনোনয়ন, বিতর্ক সব কিছুই বদলে গেছে। জগদীপ ধনখড়কে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে মনোনীত করে কেন্দ্র ফোন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়ে দিয়েছে। রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলাপ-আলোচনায় আজকাল কেন্দ্র যায় না।
এমন নয় আজ যেভাবে জগদীপ ধনখড় বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন, প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক নেতাদের মতই বিবৃতি দিচ্ছেন, ট্যুইট করছেন, তা হয়তো অতীতে দেখা যায়নি। রাজ্যপালের সঙ্গে সংঘাত তো নতুন নয়। কেন্দ্র রাজ্যপালকে হাতিয়ার করে রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে অতীতে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে বারবার। অন্তত এই সংস্কৃতি নির্মাণ করেছিল কংগ্রেসই। নেহেরুও তো সরোজিনী নাইডুকে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল পদে নিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল। কংগ্রেস যখন ক্ষমতাসীন ছিল, তখনই তো অর্জুন সিংহ থেকে মতিলাল ভোরাকে রাজ্যপাল করার ট্র্যাডিশন তৈরি করা। আজ মোদী এবং অমিত শাহ সেই সব অবসরপ্রাপ্ত নেতা, বশংবদ আমলাকে রাজ্যপাল করে রাজ্যকে চাপের মধ্যে ফেলেছেন।
রাজভবন থেকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রও নতুন ঘটনা নয়। আর পশ্চিমবঙ্গের রাজভবন তো নিছক রাজ্যপালের বাড়ি নয়। এই ভবন ছিল ভারতের বড়ো লাট সাহেবের বাড়ি। এখানে প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা টিভি রাজেশ্বরকে রাজীব গান্ধী পাঠান, মনমোহন সিংহ পাঠান আর কে নারায়ণনকে। গোয়েন্দা কর্তারা রাজ্য সরকারের সমস্ত কার্যকলাপের ওপর নজর রাখতেন, রিপোর্ট দিতেন। বীরেন শাহর মতো জ্যোতি বসুর বন্ধুও সিপিএম দলের জেলায় জেলায় সন্ত্রাস, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্যের করুণ পরিস্থিতির সব রিপোর্ট পাঠাতেন কেন্দ্রের কাছে।
কিন্তু এখন কোনও গোপন রিপোর্ট নয়, রাজ্যপাল পদে পদে যাচ্ছেন প্রকাশ্য সংঘাতে। একটা হিসেব বলছে, ধনখড় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ২০১৯ এর ৩০ জুলাই। এই এক বছর এক মাস সময়ের মধ্যে কম পক্ষে ৫৫ টি বড় সংঘাত হয়েছে দু’পক্ষের। গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর রাজ্যপাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভ থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসার জন্য। এমনকী দুর্গা পুজোর সময় রাজ্য সরকার আয়োজিত কার্নিভাল বা বিসর্জন উৎসবে মিডিয়াতে তাঁকে দেখানো হয়নি, এমন অভিযোগ করা হয়েছে। রাজ্যপাল এবং তাঁর স্ত্রীর আসন নাকি এমন জায়গায় রাখা হয় যেখান থেকে কোনওভাবেই টিভিতে দেখা যাবে না। এছাড়া কথায় কথায় মুখ্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে তাঁর ডেকে পাঠানো, রাজ্য প্রশাসনের কাজকর্মে নাক গলানো, এমনকী করোনা দুর্যোগেও রাজ্য সরকারের সমালোচনা করা, এই সব অভিযোগ মমতা সরকার তুলেছে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে। রাজ্যপাল বলছেন, তিনি এ কাজ করছেন সংবিধান মেনে আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থে।
এখানে সবচেয়ে মূল্যবান প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে। রাজ্যপালের ক্ষমতার সীমানাটি কোথায়? যুক্তফ্রন্ট আমলে স্পিকার বিধানসভা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কেন্দ্র বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে। এ ব্যাপারে সমালোচনা হয়েছে সেদিনও। কিন্তু পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টে বোম্মাই বিচার কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার ব্যাপারেও অনেক সাংবিধানিক বিধিনিষেধ লাগিয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানে ১৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদে রাজ্যপাল কে হতে পারেন, তাঁর ক্ষমতার পরিসর কী হবে, তা সবিস্তারে বলা হয়েছে। রাজ্যপালের চার রকমের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনিক, আর্থিক, পরিষদীয়, ও বিচারবিভাগীয়। কিন্তু রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকেন এবং রাষ্ট্রপতিকে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুসারেই চলতে হয়, রাজ্যপালের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রথা অনুসরণ করা হয়। রাজ্যের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুসারেই রাজ্যপাল কাজ করেন। বিধানসভাতেও রাজ্যপালের ভাষণ রাষ্ট্রপতির ভাষণের মতই রাজ্য মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করে।
এ নিয়ে নানা মামলায় বিতর্ক হয়েছে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে। বিজেপি যখন বিরোধী দল ছিল, তখন তো রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এই একই যুক্তিতে লড়াই করেছে, যে যুক্তি আজ তৃণমূল কংগ্রেস বলছে। এমনকী গুজরাতে লোকায়ুক্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল একতরফা সিদ্ধান্ত নেন। তাতে গুজরাত মুখ্যমন্ত্রীর মনোনয়ন ছিল না। সেই সময় অরুণ জেটলির মত আইনজীবী বিতর্কে অংশ নিয়ে বলেছিলেন, রাজ্যপালের ক্ষমতা এখানে সীমাবদ্ধ। রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কাজেই আদালতের নির্দেশকে পর্যন্ত বিজেপি সেদিন চ্যালেঞ্জ করে।
জগদীপ ধনখড় একদা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। সংসদ সদস্য ছিলেন। বিশিষ্ট আইনজীবী উনি। ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। মানুষ হিসেবেও বেশ চিত্তাকর্ষক মানে হয়েছে। কাজেই তিনি যে তাঁর সীমাবদ্ধ সাংবিধানিক ক্ষমতা জানেন না, তা নয়। তবু তিনি রাজভবনে বসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে লাগাতার তৃণমূল সরকার বিরোধী প্রচার অভিযান শুরু করেছেন, তাতে মনে হয় দিল্লির প্রশ্রয় নিশ্চয়ই আছে। এতে রাজনৈতিক লাভ কার আর লোকসান কার, সে তো ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু তিনি যা করছেন তা যে সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.