‘দাদা অঙ্ক কী কঠিন’, বাঙালি হলে তিনিও নির্ঘাত চন্দ্রবিন্দুর এই বিখ্যাত গানটি গেয়ে উঠতেন। তাঁর কাছে অঙ্ক মানেই আতঙ্ক। তখন তিনি ১৬ বছরের কিশোর। আরও এক বছর বাকি রয়েছে হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করতে। কিন্তু কোর্স শেষ করতে গেলে অঙ্ক কষতে হবে। আর এই কাজটি তাঁর এক্কেবারে পছন্দ নয়। যতটা অপছন্দ অঙ্ক করতে ঠিক ততটাই পছন্দ করেন কবিতা। স্বপ্ন দেখেন কবি হওয়ার। কবিতার টানে এবং অঙ্কের আতঙ্কে কোর্স শেষ না করেই স্কুল ছেড়ে দিলেন। অথচ নিয়তির কী আশ্চর্য ‘পরিহাস’, যে গণিতের কারণে তিনি স্কুল ছাড়া হয়েছিলেন, সেই অঙ্ক কষেই একদিন ‘নোবেল’ পেলেন।
৫ জুলাই, ২০২২-এর ফিল্ডস মেডেল জয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে ফিনল্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ম্যাথামেটিকস। চার বিজয়ীর মধ্যে রয়েছেন কোরিয়ান গণিতবিদ জুন হু। যিনি অঙ্ক করবেন না বলেই একদিন স্কুল ছেড়েছিলেন। আজ তিনিই অঙ্কের দুনিয়ায় সর্বচ্চ সম্মান প্রাপ্ৰক গণিতবিদ।
পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্য এই পাঁচটি বিষয়তে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। পরে এই তালিকায় অর্থনীতি যুক্ত হলেও অঙ্ক এখনও নোবেল দেওয়া শুরু হয়নি। তবে অঙ্কের জগতে সর্বচ্চ সম্মান হিসেবে ফিল্ডস মেডেলকেই ধরা হয়। অনেকেই একে অঙ্কের জন্য ‘নোবেল’ পুরস্কার বলে থাকে। যদিও এই মেডেল অনূর্ধ্ব চল্লিশের গণিতবিদদের দেওয়া হয়ে থাকে।
গণিতবিদ জুন হু-এর জীবনের গল্প যে কোনও ছবির চিত্রনাট্যকেও হার মানাবে। ১৬ বছর বয়সে স্কুল তো ছাড়লেন। তারপর ওই কিশোর বয়সেই ডুব দিলেন সাহিত্য চর্চায়। দীর্ঘ দু’বছর ধরে লিখে ফেললেন একের পর এক কবিতা। কিশোর বয়সের সৃষ্টি হলেও তাঁর কবিতা সাহিত্য প্রেমীদের কাছে সমাদর পেল। তাঁর বেশকিছু দীর্ঘ কবিতাও সে সময়ে প্রকাশিত হল।
কবি হওয়ার পথে হাঁটা দিলেও যাত্রাপথে যেন আরও অন্য কিছু অপেক্ষা করছিল। যা তাঁকে আজ বিশ্বসেরার আসনে বসিয়েছে। কিছুটা পরিবারের চাপেই ফের স্কুলে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছিলেন হু। সেখান থেকে কলেজ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন হু-এর দেখা হয় আরেক ফিল্ডস জয়ী গণিতবিদ হেইসুকি হিরোনাকার সাথে। জাপানের এই গণিতজ্ঞ ১৯৭০ সালে অ্যালজেবরিক জিওমেট্রির কাজের জন্য ফিল্ডস মেডেল পেয়েছিলেন।
সালটা ২০০২। দক্ষিণ কোরিয়ার সেওল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা ও মহাকাশ বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে হু। কলেজে ভর্তি হলেও তাঁর ক্লাসে মন নেই। ‘থ্রি ইডিয়েটস’-সিনেমার র্যাঞ্চোর মতো সারাদিনই নিজের ক্লাস ছেড়ে যখন যে ক্লাস পছন্দ হয় সেখানে ঢুকে পড়েন। এভাবেই একদিন তিনি গণিতের অধ্যাপক হেইসুকি হিরোনাকার ক্লাসে ঢুকে পড়েন হু। প্রফেসর হিরোনাকার ক্লাস করানোর ধরণ, গণিতের ওপর তাঁর বক্তৃতা সব কিছুতেই ভীষণভাবে প্রভাবিত হন হু। আর সেখান থেকেই তাঁর অঙ্কের প্রতি ভালোলাগা শুরু। পরে প্রফেসর হিরোনাকাই তাঁর গণিতের শিক্ষক হন।
স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকা যান হু। মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে ডক্টরেট করেন। ২০১০ সালেও তাঁর গবেষণায় বিষয় ‘মেট্রোয়েড এবং ক্রোমাটিক পলিনোমিয়াল’ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে ‘কম্বিনেটরিক্স’-এর ওপর তাঁর সাম্প্রতিক কাজই তাঁকে ফিল্ডস মেডেল এনে দিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় অঙ্ককে ভয় পাওয়া ছেলেটাই কোরিয়ার মধ্যে প্রথম গণিতবিদ হিসেবে এই সম্মান পেয়েছেন।
Comments are closed.