‘এবার ভাবছি পালা করবো, কার্ল মার্ক্স। জানেন লোকে বলে, আমায় নাকি রুশিদের মত দেখতে।’
‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’মৃণাল সেনের ছবি আকালের সন্ধান-এর সংলাপ। ছবিতে গ্রাম্য শখের যাত্রা পালাকারের (রাজেন তরফদার অভিনীত) মুখনিসৃত মার্ক্স অনুরাগের অভিজ্ঞান। মার্ক্সবোধ সম্পর্কে আম বাঙালির প্রচলিত বিভ্রমকেই যেন খোঁচা দিতে চেয়েছিলেন মৃণাল!
আজ কার্ল হাইনরিখ মার্ক্সের জন্মের ২০০ বছর পরেও সেই বিভ্রম থেকে মুক্ত নয় বঙ্গবাসী। সারস্বত অঙ্গনের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বাইরে বাংলায় মার্ক্স নিয়ে গণচর্চার পরিসরটির বিস্তার এবং বয়স নেহাত কম নয়। স্বাধীনতার আগে জাতীয় কংগ্রেসের অন্দরে নরম এবং চরমপন্থীদের সংঘাতের আবহে রুশ বিপ্লবের হাত ধরেই এদেশে মার্ক্স অনুরাগের সূচনা। বামপন্থী তথা কমিউনিস্টদের সৌজন্যে মার্ক্স রুশি নাকি জার্মান, এই সংশয় বয়ে নিয়েই বাংলার আটপৌরে গৃহস্থলিতে ঠাঁই করে নিয়েছিল মার্ক্সের নাম। কখনও নিন্দিত কখনও নন্দিত, দুই শতক আগে তৎকালীন প্রুশিয়ার তিয়েরে শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের আইন ব্যবসায়ীর ওই নবম জাতক।
‘মাকু হইছ? ঠাকুর দ্যাবতায় মন নাই! নিজের মারে জল টুকুও দিবি না? পোড়া কোপাইল্লা। নিজের কপাল পোড়াইছ, অহন বংশের অমঙ্গল করবি। নাস্তিক। মার্ক্স তোগো খাওয়াইবে?’
মায়ের পারলৌকিকতায় ‘না’ বলায় এই ভাষাতেই ধমক খেতে শুনেছিলাম এক সহপাঠীকে।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এটাও মার্ক্স সম্পর্কিত আর এক পপুলার সামাজিক অভিজ্ঞান। আটের দশকের মৃণাল সেনের রিল লাইফ থেকে উত্তর কলকাতার ওই রিয়েল লাইফ যেন একই সুতোয় বাঁধা। নিন্দার বহর এমনই, ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গ তুলে অনেক আলোকপ্রাপ্তকেও ফোঁস করতে শুনেছি। আজও শুনে চলেছি।
এর উল্টোদিকের ছবিটাও কিন্তু খুব আশাপ্রদ নয়। মার্ক্স নিন্দিত বা নন্দিত, সবটাই খন্ডিত। মার্ক্স আছেন ‘বাদ’ নেই। বাম শাসনের আমলে একটা দেওয়াল লিখন প্রায়শই দেখা যেত। ‘মার্ক্সবাদ সত্য কেননা ইহা বিজ্ঞান’। যেন কোনও ক্যাথলিক ফরমান, কিংবা ইমাম সাহেবের ফতোয়া। এমন নিয়তিসিদ্ধ ঘোষণাই কি মার্ক্স অনুরাগী সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে বিঁধেছিল?
‘জামার তলায় পৈতে আর আস্তিনের নীচে তাবিজ নিয়ে এক নিকষ কুলিনের ছা বুঝিয়ে গেল কীভাবে দুনিয়াটাকে বদলাতে হবে।’কী নিদারুণ পর্যবেক্ষণ ছিল কবি সুভাষের।
বামপন্থীদের চিন্তা, চেতনার, যান্ত্রিকতার সহজ পথ তাঁকে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা। চাই কুল দেবতার মত বন্দনা। তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকার কৌশল। তাই বঙ্গজ ভ্যানগার্ড কুলের কল্যানে সেই গণচর্চা এখন মার্ক্স বন্দনায় পর্যবসিত। ছবিতে আছেন, উদযাপনে আছেন কিন্তু, জীবনচর্চায় উপেক্ষিত, তবুও তিনি বেঁচে আছেন। দুশো বছর আগে রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে জন্মানো সেই মানব সন্তানটি নিজের কৃতকর্মের জোরে বেঁচে আছেন।
সম্প্রতি কলকাতায় সেই রক্ত মাংসের (দেবশিশু নয়) মানুষটি কীভাবে কার্ল মার্ক্স হয়ে উঠেছিলেন, এমনই এক ছায়াছবি দেখেছিলাম। গত নভেম্বরে, রুশ বিপ্লবের (শতবর্ষ ) মাস সেটা। কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ‘দ্যা ইয়ং কার্ল মার্ক্স’ ফরাসি ছবি। পরিচালক রাউল পেক। ছাত্র, গবেষক, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট, রুজির লড়াই, প্রেম, যৌন জীবন, মায় ফ্রেড্ররিখ এঙ্গেলসের সান্নিধ্যে কমিউনিস্ট ইশতেহার রচনা পর্যন্ত বিষয় নিয়ে এই ছবি-‘দ্যা ইয়ং কার্ল মার্ক্স’।
ছবির শুরু কোনও এক অরণ্যে। বেশ কিছু নারী-পুরুষের কাঠ কুড়োনোর দৃশ্য দিয়ে। যাদের প্রুশিয়ান সেনারা তাড়া করে। কাউকে মেরেও ফেলে। কারণ, অরণ্যটি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওই জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। গাছগুলিও তাই। কিন্তু যে ডালপালা গাছ থেকে খসে পড়েছে তা যদি কেউ জ্বালানি করে, তবে সেটা সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার লঙ্ঘনের নামান্তর। ছবির সুরটা এখানেই বাঁধা হয়ে যায়। এখান থেকেই আমরা সোজা ঢুকে পড়ি মার্ক্সের জীবনে। যে মার্ক্স বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা, ইয়ং হেগেলিয়ান সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করছেন। Rhieninish Tseitung (রাইনশ সাইতুঙ) এ লেখার দায়ে প্রুশিয়ার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। অপরদিকে এঙ্গেলসের সঙ্গে পরিচয়। যাঁর জীবনের দুই ভাগের চরম বৈপরীত্য। মার্ক্সের লেখা পাঠের সুবাদে ধনকুবের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। মার্ক্সের ব্যক্তিগত জীবন আর রাজনৈতিক কর্তব্যবোধের টানাপোড়েনের মাঝে বোনা হতে থাকে দুনিয়ার এক মহত্তম বন্ধুত্বের নকশিকাঁথা। তৈরি হতে থাকে দ্বান্দ্বিক ঐতিহাসিকতার বৈজ্ঞানিক প্রয়োগে গড়ে ওঠা শ্রমিক শ্রেণীর দর্শনের রূপরেখা। ছবি শেষ হয় ইশতেহার লেখার শেষে।
কেবল একটা খটকা, ছবির শেষে রোলিং ক্রেডিট যখন দেখানো হচ্ছে। তখন পর্দায় অনেক মুখ ভেসে ওঠে, যাঁরা বিপ্লবী তো দূর, তার শত্রু হিসেবেই পরিচিত। এই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মানে ঠিক বোঝা গেল না। এর অর্থ হতে পারে ফরাসি প্রযোজক নিঃশর্তে পয়সা ঢালেনি। ১৮৮৩ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে মার্ক্সের দর্শন ভিসুভিয়াসের শামিল। অগ্ন্যুৎপাতের আশঙ্কা। তাই দুশো বছর পরেও ঝুঁকি নেননি প্রযোজক। কেননা তারা নিশ্চিত মার্ক্সবাদের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা যায়নি আজও।