কর্ণাটকের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্কের ইতিহাস দুশো বছরেরও পুরনো। সেই কবে মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে জানপ্রাণ লড়ে শহীদ হলেন আর তাঁর ছেলেরা আশ্রয় হিসাবে কলকাতায় বাস করতে শুরু করলেন। এ হেন টিপুকে এত দিন জাতীয় বীর হিসাবে সকলে জেনে এসেছেন। ইদানীং বিজেপি ও তার আদর্শপিতা আরএসএস টিপুকে অবশ্য খলনায়ক বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বছর তিনেক আগে টিপু জয়ন্তী পালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। তখন আরএসএস নেতৃত্ব বলেছিলেন, টিপু হলেন দক্ষিণ ভারতের ঔরঙ্গজেব আর সিদ্দারামাইয়া হলেন কর্ণাটকের লালু। টিপু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, তিনি অসহিষ্ণু, লাখ লাখ মানুষকে বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, ভেঙ্গেছিলেন বহু মন্দির-আরএসএসের অন্যতম মুখপত্র পাঞ্চজন্য-তে এই সব মিথ্যা ইতিহাস-চর্চা হয়েছিল। মূল ধারার ইতিহাস কোনও দিন এই সব কথা সমর্থন করে না। ভারতবর্ষের ইতিহাস বিজেপির হাত ধরে বদলাচ্ছে ক্রমশ এবং তা অগ্রসর হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও সংঘর্ষের ইতিহাসে। শুধু টিপু সুলতান নয়, লাল কেল্লা বা তাজমহলের শাহজাহান, একদা কংগ্রেসের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ বিজেপির ভোট বৈতরণী পার হওয়ার উত্তম বৈঠা হয়ে উঠেছে।
কেন এই অতীতচারণা? তা কি বর্তমানকে ভুলিয়ে রাখার জন্য? এই কৌশলের সর্বশেষ সংযোজন হল কর্ণাটকের কৃষকদের আত্মহত্যা। বিজেপি কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে যে সব পোস্টার প্রদর্শন করছে, তার মধ্যে একটি হল—একজন কৃষক গলায় দড়ির ফাঁস লাগাচ্ছেন। আর সেই আত্মহত্যার জন্য কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে কর্ণাটকের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াকে।
কৃষকদের আত্মহত্যা ভারতের একটি জ্বলন্ত সমস্যা। সেই সমস্যার পিছনে রয়েছে কৃষিনীতি। রাজনীতি যে ভাবে কৃষিকে স্ববধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং বহুজাতিক বীজ কোম্পানি, সার কোম্পানি, কীটনাশক কোম্পানিকে তোল্লাই দিচ্ছে, তাতে ভারতবাসীর প্রতি ঘরে বিষ প্রবেশ করছে প্রতিটি খাদ্যের সঙ্গে। আর এই ধীর-বিষ ক্রমশ আমাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে রোজ। যার জন্য সিদ্দারামাইয়াকে কাঠগড়ায় তুললে হবে না, মূল দায় হল কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের, যাঁদের পরিকল্পনা কৃষকদের আত্মহত্যার জন্য দড়ি সরবরাহ করছে।
প্রতিদিন ভারতবর্ষে কমপক্ষে ৪৩ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। বার্ষিক কৃষক-স্ববধের পরিমাণ হল ১৬ হাজার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর এই হিসাব পাঁচ বছরের পুরনো। সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতি বছর। বিজেপির তথাকথিত উদারনীতি চালু হওয়ার পর এই মৃত্যু মহামারীর আকার নিয়েছে। শুধু কর্ণাটক নয়, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রেদেশে এই হার ভয়াবহ। প্রতি ৪২ মিনিটে একজন কৃষক স্ববধে লিপ্ত হচ্ছেন।
মূল কারণ অবশ্যই কর্পোরেট চাষ। নেই ফসলের দাম। কৃষক জমি থেকে ফসল তুলে যে ভ্যান ভাড়া করে আড়তে পণ্য নিয়ে যাবেন, পণ্যের দামে তাঁর ভাড়া ওঠে না অনেক ক্ষেত্রে। অথচ ক্রেতা কৃষিজ পণ্য কিনতে হিমশিম খান, এত চড়া দাম! কারা খায় লাভের গুড়? ফড়ে দালাল—এক কথায় মধ্যস্বত্ত্বভোগী। কে তাদের আশ্রয় দেয়? রাজনীতি। ধর্মরূপী যক্ষ এখন যুধিষ্ঠরকে এই সব প্রশ্ন করেন না। কারণ প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও আমাদের প্রত্যেকের জানা।
ফলে কৃষকের আত্মহত্যা ভোটের বাজারে একটি পণ্য। গত বছর বাজেটে অরুণ জেটলি চুক্তিচাষের লক্ষ্যে আদর্শ আইনের ঘোষণা করেন, সেখানে চাষকে কর্পোরটের হাতে আক্ষরিক অর্থেই তুলে দিয়েছেন তিনি। ফসল নষ্টের কারণে, ঋণের বোঝার জন্য যে সব চাষীরা আত্মহত্যা করছেন, তাঁদের বাঁচানোর জন্য আজ পর্যন্ত কোনও জাতীয় নীতি তৈরি হয়নি। এই আক্ষেপ সুপ্রিম কোর্টেরও। গুজরাতে কৃষক আত্মহত্যার একটি মামলায় আদালত এই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীরা অবশ্য এ সব নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁদের ভোট দরকার। আর নির্বাচন বৈতরণী পার হতে গেলে প্রয়োজন লক্ষ লক্ষ লাশ। সেই লাশের ছবি ছাপা হবে চকচকে ব্যানারে। কর্পোরেটের পয়সায়। অর্থ এলেই ভোট আসবে। ভোটার না আসতে চাইলে তাদের হাত-পা বেঁধে নিয়ে আসা হবে–কর্ণাটকে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ইয়েদ্দুরাপ্পা তেমনই নিদান দিয়েছেন।
অতঃপর যক্ষ অর্থাৎ ধর্মরূপী বক যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই মরুতের প্রশ্বাস তুমি গ্রহণ করতে পারো, যদি জানাও যে তোমার দেশ কোথায়? তোমার রাজধর্ম কী?
যুধিষ্ঠির মর্ত্যে থাকলে অবশ্যই বলতেন, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। শবদেহ নিয়ে এই রাজনীতি আমার রাজধর্ম নয়।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)