ঠিক ২৮০ বছর আগে ১৭৩৮ খৃস্টাব্দে দুই শতাব্দী ধরে শাসন করতে থাকা ক্ষয়িষ্ণু মুঘল সাম্রাজ্যকে নির্মম আক্রমণে চুরমার করে মাত্র এক বছরের মধ্যে কোহিনূর ও দরিয়া নূর হিরেসহ অভাবনীয় ধন ভান্ডার নিয়ে দেশে ফিরে যান পারস্যের নাদির শাহ। এত কম সময়ের মধ্যে প্রবলবেগে ভারত বিজয়ের সঙ্গে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের আক্রমণাত্মক স্টাইলে গত চার বছরে দেশকে প্রায় কংগ্রেসমুক্ত করে দেওয়া তুলনা করা যেতে পারে।
কিন্তু অবশেষে কর্ণাটকে আস্থা ভোটের আগেই মুখ থুবড়ে পড়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সাংবাদিক সম্মেলনকে বেশি পাত্তা না দেওয়া অমিত শাহ যখন সাংবাদিকদের ডেকে সদর্পে ঘোষণা করলেন, কংগ্রেস একবার বিধায়কদের হোটেলের বাইরে এনে দেখুক, তখন জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, হঠাৎ হলো কী? ভারত নামক ঐতিহ্যশালী দেশের কেন্দ্রে ও ২২টি রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি সমস্ত নজির ভেঙে হঠাৎ এই ভঙ্গিতে প্রকাশ্যে কথা বলছেন কেন? রংবাজিতে সঞ্জয় গান্ধীও তো এর কাছে বাচ্চা!
সত্যি তো, অপারেশন কমল ব্যর্থ হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি মেরামতের চেষ্টা না করে উগ্র প্রতি আক্রমণের এত বড় ঝুঁকি নিলেন কেন অমিত? এটা বাধ্যতা নাকি কৌশল?
সংঘ পরিবারে বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কোনও নেতাকেই সংগঠনের থেকে বড় হতে দেয় না। বাজপেয়ীর মতো উদারবাদী নেতাও সংঘকে অস্বীকার করতে পারেননি। মোদির ক্ষেত্রে তো সংঘ রয়েছে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। তাই চার বছর পরেও যখন অর্থনীতি, বিদেশনীতি, কৃষকদের অবস্থা, কাশ্মীর সমস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল, যুবকদের জন্য কাজের ব্যবস্থা, প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রে মোদি সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি, তখন হঠাৎই বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি এবং আরএসএসের প্রিয় পাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গদকরিকে ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে জানাতে হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য আগ্রহী নন। কিন্তু কর্ণাটক নির্বাচনের আগে তাঁর প্রধানমন্ত্রী র প্রশ্ন উঠল কী কারণে!
কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দুবাদী সংগঠন সনাতন সংস্থা বহু দশক ধরে প্রচারের কাজ করে চলেছে। কালবুর্গি ও গৌরী লঙ্কেশ হত্যায় এদের নাম আলোচনায় উঠেও এসেছে।
গত ৩০ বছরে কর্ণাটক এক দল পরপর দু’বার ক্ষমতায় আসেনি। কিন্তু মোদির লাগাতার প্রচার সত্বেও প্রাপ্ত ভোটের বিচারে শাসক কংগ্রেস সর্বাধিক ভোট পেয়েছে। বিজেপির থেকে প্রায় দু’শতাংশ বেশি, এমনকি জেডিএস-এর প্রাপ্ত ভোটও (১৮.৩ শতাংশ) বিজেপি নিজের দিকে টানতে পারেনি। বাস্তব হলো, মায়াবতীর ০.৩% ভোট মিলিয়ে, মোট ৫৬.৬% ভোটার মোদি- শাহ’র বিরুদ্ধে। বিজেপির বিপদ বাড়িয়েছে বেঙ্গালুরুর মতো আইটি শহরেও ভালো ফল করতে না পারা।
এসব সত্ত্বেও যখন নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন বিজেপির জাতীয় দফতরে দাঁড়িয়ে মোদি দাক্ষিণাত্য বিজয়ের শিঙে ফুঁকলেন, তখন নিজের ভাবমূর্তি ও ক্ষমতাকে পাশা খেলায় বাজি রেখে ফেললেন মোদি-শাহ জুটি। রাজ্যপাল বাজুভাই বালা যথারীতি তাঁর কর্তব্য করেছেন। দেশের সামনে ইয়েদুরাপ্পা ছিলেন নিমিত্ত মাত্র। সুপ্রিম কোর্ট শনিবারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের আদেশ দেওয়ার পরে রাহুলের কাছে নৈতিকতার প্রশ্নে হার হলো মোদির এবং ইয়েদুরাপ্পার নিরুপায় পদত্যাগের পরে কৌশলের প্রশ্নে হার হলো শাহের। উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন কংগ্রেসের আজাদ, চিদম্বরম, গেহলট, সিংভি, সিববলের মতো সেনানায়করা। বিজেপির আগ্রাসন যত বেড়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নাইডু, চন্দ্রশেখর রাও, মায়াবতী, অখিলেশ, তেজস্বী, ইয়েচুরির মতো বিরোধী নেতারা সংযুক্ত প্রতিরোধের টানে আরও কাছাকাছি এসেছেন। বিরোধী ঐক্যের প্রথম সাফল্য হলো কর্ণাটক। আরও মারাত্মক, সোশ্যাল মিডিয়াতে পাখির চোখ রাখা বিজেপি বুঝতে পারল, দেশের মানুষের কাছে কর্ণাটকের লড়াই ন্যায়যুদ্ধ না হয়ে অন্যায়যুদ্ধই হয়ে থেকেছে, যার নায়ক অমিত শাহ।
শাহ জানেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া সংঘের কাছে কর্ণাটক এক ভয়ংকর ধাক্কা। এর আঁচ শাহের গায়েও লাগতে পারে। জিন্নাহর প্রশংসা করার কারণে আদবানির মতো হিন্দু হৃদয় সম্রাটকেও সংঘ ক্ষমা করেনি, অমিত শাহ তাদের কাছে অত ওজনদার নয়। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, সাংসদ শত্রুঘ্ন সিংহ, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ খোলাখুলি মোদি-শাহের তীব্র সমালোচনা করা সত্ত্বেও আজ অবধি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি শাহের বিজেপি। যদিও রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক যোদ্ধা স্মৃতি ইরানীকে প্রথমে শিক্ষা ও অল্পদিনের মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে সরিয়ে দিতে দেরি করা হয়নি।
২০১১ থেকে ২০১৪ এবং তার পরবর্তী সময়ে মোদির প্রচারে স্পষ্ট, এই বিজেপি বিশেষ ধরনের আক্রমণাত্মক ভাবমূর্তি বজায় রাখায় বিশ্বাসী। কর্ণাটক সেই ভাবমূর্তিকেই চ্যালেঞ্জের সামনে এনে ফেলেছে। বাস্তবিকই বিজেপির সমর্থকদের কাছে যে কোনো মূল্যে লড়াই জেতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে লড়াই কখনও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, কখনও পাকিস্তান ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে, কখনও দলিতদের বিরুদ্ধে। সঙ্গত কারণেই, গুজরাট কেশরী মোদিকে সামনে রেখে অমিত শাহ বিভ্রান্ত সমর্থকদের জানাতে চান, টাইগার জিন্দা হ্যায়। কারণ শেষ বিচারে জো জিতা ওহী সিকন্দর।
অতি সক্রিয় অমিত শাহকে দেখে মনে হয়, দেশকে তোলপাড় করা কিছু ইস্যুতে সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি সামনে রেখে ভোটে যেতে পারে মোদি সরকার। ততদিন অবধি দেখার অপেক্ষা, ২০১৯ সালে কোহিনূর হীরার সন্ধান গুজরাটের শাহ খুঁজে পান কিনা।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)