ভুয়ো আইএস দেবাঞ্জনের কীর্তিকলাপে গোটা তিলত্তমা তোলপাড়। নীলবাতি লাগানো গাড়ি, সশস্ত্র দেহরক্ষী, একের এক ভুয়ো ক্যাম্প এবং তাতে আমন্ত্রিত পুলিশ কর্তা থেকে শুরু করে হেভিওয়েট নেতা মন্ত্রী, এমনকী ফলকে মন্ত্রীর নামের তলায় পশ্চিবঙ্গ সরকারের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে তাঁর নাম পর্যন্ত খোদাই রয়েছে। এখানেই শেষ নয় পুর কর্তার সই নকল করে কলকাতা পুরসভার মত এক প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়ো একাউন্ড পর্যন্ত খুলে ফেলেছিলেন তিনি। দেবাঞ্জনের কীর্তকলাপ যেন পাকা হাতে লেখা কোনও হিট ছবির চিত্রনাট্য।
আর এই দেবাঞ্জন কাণ্ড মনে করিয়ে দিচ্ছে আরেক প্রতারকের নাম। তাঁকে ভারতবর্ষের এমনকী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রতারক বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। তিনি নটবরলাল।
শাহজাহানের সৃষ্টি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য তাজমহল তিন তিনবার বেচে দিয়েছিলেন নটবারলাল। যাঁরা এটুকুতেই অবাক হচ্ছেন তাঁদের জানাই, শুধু তাজমহল নয় লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু করে সাংসদ সমেত গোটা সংসদ ভবনটি নাকি তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন বিদেশেদির কাছে।
ঘটনাগুলি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাজমহল, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন এগুলি বিক্রি করা সম্ভব! আর এখানেই নটবরলালের দক্ষতা। সই নকল করার এক ‘ঈশ্বর প্রদত্ত’ ক্ষমতা ছিল তাঁর। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের হুবুহু সই নকল করতে পারতেন এই প্রতারক। অম্বানি থেকে টাটা সকলের সই নকল করা নটবারলালের ‘বাম হাতের খেলা’। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন এক অতি উঁচু দরের ‘অভিনেতা’। শিল্পপতি, শীর্ষ স্তরের সরকারি আমলা থেকে ভিখারী বাস্তবের মঞ্চে সব ভূমিকাতেই তিনি নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেন সাধারণ মানুষের সামনে।
বিদেশিদের কাছে নিজেকে একজন শীর্ষ স্থরের সরকারি আমলা হিসেবে পরিচয় দিতেন। তারপর সুযোগ বুঝে তাজমহল বা এই জাতীয় সরকারি সম্পত্তি বিক্রির কথা জানতেন। সরকারের টাকার দরকার, কিন্তু এক্ষুনি বিক্রির খবর প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না ভাবমূর্তি নষ্টের ভয়ে। এই ছিল নটবরের প্রাথমিক টোপ। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে রাষ্ট্রপতির সই করা সরকারি নথিপত্রও তিনি দেখাতেন সম্ভাব্য ক্রেতাদের।
১৯১২ সালে নটবরলাল জন্মগ্রহণ করেন বিহারের বাংরা নামে এক গ্রামে। বাবা ছিলেন স্টেশন মাস্টার। তাঁর প্রকৃত নাম, মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব।
ছোটোবেলা গ্রামের এক বৃদ্ধ প্রতিবেশী তাঁকে একটি চেক সই করে হাতে দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনতে বলেছিলেন। পরে ওই বৃদ্ধর চেকবই থেকে চেক চুরি করে বৃদ্ধের সই নকল করে তখনকার দিনে এক হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছিলেন নটবর। সেই শুরু। ১৯৩৭ সালে প্রথম নটবরকে পুলিশ গ্রেফতার করে। রেলে চুরির অভিযোগে। তবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে জেল থেকে পালন তিনি। এক সময়ে আট রাজ্যের পুলিশ হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজতো। গ্রেফতার করলেও বেশি দিন জেলে বন্দি রাখা যেতে না তাঁকে। একাধিকবার জেল থেকে পালিয়েছেন তিনি। জেল পালানোর ব্যাপারেও বিখ্যাত হয়ে আছেন নটবর। ১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে শেষ বারের জন্য জেল থেকে পালন তিনি। আর তারপরে পুলিশের কাছে অধরাই থেকে গিয়েছেন ‘তাজমহলের বিক্রেতা’।
লাখ লাখ টাকা প্রতারণার পাশাপাশি নিজের গ্রামবাসীদের প্রচুর টাকা দানও করেছেন তিনি। গ্রামের লোক এতটাই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন যে মৃত্যুর পরে গ্রামে নটবরলালের মূর্তি অব্দি বসাতে চেয়েছিলেন। যদিও প্রশাসন অনুমতি দেয়নি।
Comments are closed.