কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #দুই

পুলিশ অফিসাররা বুঝলেন, সুমনকে মারধোর করে লাভ নেই। বরং তাঁকে কনফিডেন্সে নেওয়া দরকার। সুমনের বাবা-মাকে ডেকে পাঠানো হল পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশ লাইনে। তিনজনকে একসঙ্গে বসিয়ে টানা কথা বললেন অফিসাররা। বোঝানো শুরু হল সুমন মাইতিকে। সুমনকে সরকারিভাবে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দেওয়া হল না ঠিকই, তবে তার বিরুদ্ধে মামলা অনেক হাল্কা করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন অফিসাররা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের সিনিয়র অফিসাররা সুমন মাইতি এবং তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। এরপরই পুলিশকে প্রচুর ইনফর্মেশন দিলেন সুমন। হদিশ মিলল বহু না জানা তথ্যের। সুমনের শর্ত একটাই, সব মামলা থেকে তাকে মুক্তি এবং চাকরির একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সুমনকে সমস্ত কেস থেকে মুক্তির আশ্বাস দিলেন অফিসাররা। সুমনের দেওয়া ইনফর্মেশন পুলিশের কী কী কাজে লেগেছিল, তার সবটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। শুধু এটুকুই জরুরি, ‘স্যার, ইদানিং কিষেণজি এবং সুচিত্রা সবসময় একসঙ্গে থাকে। শশধরের মৃত্যুর পর থেকেই এই নিয়ম। কিছুদিন আগে ঝাড়গ্রামের একটা গ্রামে কিষেণজি এবং সুচিত্রা এক বাড়িতে টানা এক মাস ছিল।’ সুচিত্রা মানে, সুচিত্রা মাহাতো। এবং শশধর মানে শশধর মাহাতো। ঝাড়গ্রামের মাওবাদী স্কোয়াডের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এই দম্পতি। সেই বছরই মার্চ মাসে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় শশধরের। সেই এনকাউন্টার কীভাবে হয়েছিল এবং কীভাবে সেখান থেকে সুচিত্রা পালিয়েছিলেন, সেই ঘটনা পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
রবীন্দ্র ভগতের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই প্রভীন কুমার ত্রিপাঠীর মনে পড়ে গেল মাত্র এক সপ্তাহ আগে সুমনের দেওয়া ইনফর্মেশন। সিআরপিএফের সোর্সও খবর দিয়েছে, কিষেণজির সঙ্গে এক মহিলা রয়েছেন। হয়তো সোর্স ইনফর্মেশনটা ঠিকই। কিন্তু সিআরপিএফ কমান্ডান্টের প্ল্যানিং নিয়ে সন্দেহ দেখা দিল পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের মনে। ২০০৯ সাল থেকে ঝাড়গ্রাম, লালগড়ে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নিজে একাধিক অপারেশন করেছেন প্রভীন ত্রিপাঠী। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর মনে হল, এত বেশি সংখ্যক ফোর্স নিয়ে অপারেশনে গেলে সফল হওয়ার চান্স কম। পিন পয়েন্ট ইনফর্মেশন থাকলে কম ফোর্স নিয়ে অপারেশন করলে কাজ দেয় বেশি। কারণ, বেশি ফোর্স বিভিন্ন গ্রামে ঢোকা মানেই মুভমেন্টের খবর জানাজানি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া ফোর্সের নিজেদের মধ্যেও ক্রস ফায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটেছে দু’একবার। আর এরা তো আট কোম্পানি ফোর্স নিয়ে অপারেশনের প্ল্যান করছে।
কিন্তু সিআরপিএফের ফোর্স মুভমেন্ট নিয়ে রবীন্দ্র ভগতকে কিছু বললেন না প্রভীন ত্রিপাঠী। সেটা তাঁর এক্তিয়ারেও পড়ে না। হাজার হোক কিষেণজির ইনফর্মেশন এসেছে সিআরপিএফের কাছে। শুধু একটা অনুরোধ করলেন ১৮৪ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডান্টকে। ‘কুশবনি গ্রামে আমার খুব রিলায়েবল একজন সোর্স আছে। অনেকদিনের। প্লিজ তাড়াহুড়ো করে কুশবনি গ্রামে ফোর্স পাঠাবেন না। তার আশপাশের গ্রাম এবং জঙ্গলে অপারেশন শুরু করুন। কুশবনি গ্রামটা ছেড়ে রাখুন ট্যাকটিকাল কারণে। কুশবনি গ্রামের পরই জঙ্গল শুরু হছে। অপারেশনে কিষেনজিরা যদি কোনওভাবে এস্কেপ করে যায়, ম্যাক্সিমাম চান্স কুশবনিতে আশ্রয় নেবে।’
ঝাড়গ্রাম শহর থেকে যে রাস্তাটা রেল লাইন পেরিয়ে সোজা পশ্চিমদিকে যাচ্ছে সেই রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার দূরে দহিজুড়ি মোড়। এই দহিজুড়ি মোড় থেকে দক্ষিণদিকে জামবনি যাওয়ার রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই একটা খাল। ২২-২৫ ফুট চওড়া। কালভার্ট টপকে খাল পেরোলেই একটা রাস্তা খাল বরাবর পশ্চিম দিকে চলে গিয়েছে। সেই রাস্তা ধরে আবার কিছুটা এগোলেই বাঁদিকে কুশবনি গ্রাম, এবং তারপরে শুরু হচ্ছে জঙ্গল। পুরো এলাকার ম্যাপ ধরে রবীন্দ্র ভগতের সঙ্গে কথা বললেন প্রভীন ত্রিপাঠী। সিআরপিএফের সোর্স ইনফর্মেশন বলছে, দহিজুড়ি থেকে পশ্চিমদিকে বিনপুর এবং দক্ষিণদিকে জামবনি যাওয়ার রাস্তার মাঝের গ্রামগুলোর কোনও একটাতে আশ্রয় নিয়েছে কিষেণজিরা।
সেদিন, মানে ২০ তারিখ রাতেই অপারেশন শুরু করে দিল সিআরপিএফ এবং রাজ্য পুলিশ। সঙ্গে স্পেশালাইজড ফোর্স কোবরা। অপারেশন কিষেণজি। গ্রামে গ্রামে শুরু হল তল্লাশি। ২১ তারিখ সকাল থেকে জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করল ফোর্স। সারাদিন গ্রামে-জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করা হল। তার মধ্যে দু’জন মোটামুটি ঠিকঠাক অ্যারেস্ট। একটা বাড়ি থেকে উদ্ধার হল ল্যাপটপ এবং কিছু কাগজপত্র। কিন্তু কিষেণজি বেপাত্তা। কিষেণজি যে এলাকাতেই ছিলেন তা ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হলেন গোয়েন্দারা। কিন্তু তাঁর হদিশ কেউ দিতে পারল না।
কিষেণজির খোঁজে যৌথ বাহিনীর এই বিরাট অভিযানের খবর ২১ তারিখ বিকেল থেকেই পৌঁছতে শুরু করল সংবাদমাধ্যমের কাছে। যার পরিণতি হল খুব স্বাভাবিক। ২২ তারিখ সকাল থেকেই যৌথ বাহিনীর পিছু নিতে শুরু করলেন সাংবাদিকরা। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম সেদিন রাতে এবং ২৩ তারিখ সকালে কলকাতা থেকে সাংবাদিক পাঠিয়ে দিল ঝাড়গ্রামে। ২২ তারিখ সারাদিন বিনপুর, ঝাড়গ্রামে অভিযান চালিয়েও খালি হাতে ফিরল যৌথ বাহিনী। নানা রকম খবর আসতে শুরু করেছ পুলিশ এবং সিআরপিএফের কাছে। কেউ বলছে, কিষেণজি রাজ্য থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছেন ওড়িশায়, কেউ বা বলছে ঝাড়খন্ডে। এই আশঙ্কাটাই করেছিলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। এত ফোর্স নিয়ে অপারেশন করলে গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। আরও দু’একদিন অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন রবীন্দ্র ভগত এবং জেলার পুলিশ সুপার। যদি রাজ্যের বাইরে চলে না গিয়ে থাকেন, তবে কিষেণজি আছেন আশপাশেই কোথাও। ইনফর্মেশনে কোনও ভুল নেই। সোর্স ইনফর্মেশনকে কনফার্ম করেছে ধৃতরা। কিন্তু কোথায় মোস্ট ওয়ান্টেড মাওয়িস্ট লিডার?
২৩ তারিখ সকাল থেকে ফের একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশে অপারেশন শুরু করল যৌথ বাহিনী। যুদ্ধ যুদ্ধ মানে আধা সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের একতরফা তল্লাশি অভিযান। আর কোনও কোনও জায়গায় ফোর্সের সঙ্গে দু’চার কিলোমিটার তফাত রেখে সাংবাদিকদের মুভমেন্ট। সেদিন সকাল থেকে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে টানা খবর চলছে কিষেণজির বিরুদ্ধে অভিযানের। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, দু’দিন, তিন রাত টানা অপারেশন চালিয়ে তখন অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে ১৮৪ সিআরপিএফ ব্যাটেলিয়ন এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ। সারাদিন অপারেশনের পর বিকেলে ঝাড়গ্রামে নিজের ব্যাটেলিয়নে ফিরে গেলেন রবীন্দ্র ভগত। প্রভীন ত্রিপাঠী চলে গেলেন মেদিনীপুর শহরে। আগের বেশ কয়েকবারের মতো এবারও হাত ফস্কে বেরিয়ে গেলেন কিষেণজি!
সেদিন সন্ধেবেলা নিজের অফিসে বসে রয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। টেলিভিশনে দেখছেন, টানা খবর চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান নিয়ে। কিন্তু তিনি তো নিজে জানেন, আর আশা নেই বিশেষ। টানা ফোন আসছে সাংবাদিকদের। কোনও ফোন ধরছেন, কোনওটা ধরছেন না। অনবরত ফোনে কথা হচ্ছে মহাকরণের সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে। আবার ফোন বাজল। ফোনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন প্রভীন ত্রিপাঠী।
‘স্যার, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। দুপুরে সুচিত্রা গ্রামে ঢুকেছে।’
‘কী বলছ? সত্যি?’ উত্তেজনা চেপে রাখতে পারলেন না পুলিশ সুপার। ‘এখনই আমার অফিসে চলে এস।’
যিনি ফোন করলেন তাঁর নাম না লিখতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারণ, সেই ব্যক্তির নিরাপত্তা। এই ব্যক্তির বাড়ি কুশবনি গ্রামে। প্রভীন কুমার ত্রিপাঠীর সেই রিলায়েবেল সোর্স। যাঁর কথা ভেবেই কুশবনি গ্রামে ফোর্স না পাঠাতে বলেছিলেন রবীন্দ্র ভগতকে। আচমকা হাজির হওয়া তাঁর ফোনে আবার আশার আলো দেখলেন কিছুক্ষণ আগেই হাল ছেড়ে দেওয়া পুলিশ সুপার।
ধরা যাক, কুশবনির সেই বাসিন্দার নাম এক্স। পিসিপিএ’র সক্রিয় সদস্য এক্স এক সময় সিপিআইএম করতেন। সিপিআইএম করার জন্যই কয়েক বছর আগে তাঁকে একবার গ্রামে গাছে বেঁধে পিটিয়েছিলেন সুচিত্রা মাহাতো। একই সঙ্গে সেদিন ওই গ্রামেরই আরও কয়েকজনকে সিপিআইএম করার জন্য শাস্তি দিয়েছিল মাওবাদীরা। এক্স সেদিনের ঘটনা ভোলেননি। মাওবাদীদের ভয়ে ২০০৯ সাল থেকে পিসিপিএ করতে বাধ্য হলেও, প্রকাশ্যে গাছে বেঁধে মারের সেই ঘটনা তাড়া করে ফিরত তাঁকে। বহুদিন ধরেই তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রাখতেন প্রভীন ত্রিপাঠী। একদিন কথায় কথায় জেলার পুলিশ সুপারকে এক্স বলেছিলেন, ‘স্যার, পারলে বদলা আমি নেবই। আমাকে গাছে বেঁধে মেরেছে সূচিত্রা। চান্স পেলেই ধরিয়ে দেব ওকে। শুধু দেখবেন আমার যেন কিছু না হয়।’ তখন ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার ছিলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। এক্সের সঙ্গে তাঁর এই কথা হয়েছিল দেড়-দু’বছর আগে। এতদিন বাদে হঠাৎই এক্সের ফোন, ‘স্যার, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই, দুপুরে সুচিত্রা গ্রামে ঢুকেছে।’
মাওবাদী এলাকায় কাজ করা যে কোনও অফিসারই জানেন, আদর্শগত কারণের বাইরেও বহু ছেলে-মেয়ে ছোটবেলায় মাওবাদী দলে যোগ দেয় শুধুমাত্র খাবার-দাবারের চিন্তা করতে হবে না বলে। ঠিক তেমনই অনেকে যোগ দেয় কারও ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেও। কখনও হয়তো শাসক দলের স্থানীয় কোনও নেতা কারও ওপর অত্যাচার করেছে, হয়তো কোনওদিন তল্লাশির নামে পুলিশ কারও বাড়িতে হানা দিয়ে মারধোর করেছে, এই সব থেকে এক্কেবারে ব্যক্তিগত আক্রোশে বদলা নিতেও মাওবাদী দলে নাম লেখানোর সংখ্যা কম নয়। আবার উল্টোটাও ঘটেছে একইভাবে। মাওবাদীদের হাতে পরিবারের কারও খুন হওয়া কিংবা অন্য কোনও ‘শাস্তি’র বদলা নিতেও অনেকে সিপিআইএমে নাম লিখিয়েছিলেন। সুচিত্রার ওপর এমনই বদলার মানসিকতা থেকে এক্স সেদিন সন্ধ্যায় প্রভীন ত্রিপাঠীকে ফোন করেছিলেন।
টেবিলের ড্রয়ার টেনে কিষেণজির ছবি বের করলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। কী যে হচ্ছে গত ১৫ দিন, একমাস ধরে, নিজের কাছেই তখন ম্যাজিকের মতো লাগছে তাঁর। কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না, এতদিন ধরে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরে কাজ করছেন, অথচ, মাস খানেক আগেও কিষেণজির কোনও সাম্প্রতিক ছবি ছিল না তাঁদের কাছে। নাগালের মধ্যে কখনও পেলেও কীভাবে তাঁকে চিনবেন তা নিয়ে সংশয় ছিল নিজেরই। কয়েকদিন আগে হঠাৎই ঝাড়গ্রামের একটি সাইবার ক্যাফের এক কর্মী দেখা করতে যান ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন একটি ল্যাপটপ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে বললেন, ‘স্যার, একজন ল্যাপটপটা সারাই করতে দিয়ে গিয়েছে আজই। ল্যাপটপের ডিস্কে কিছু ইনফর্মেশন, কিছু ছবি রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে মাওবাদীদের। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম। আমার কথা যেন স্যার কেউ জানতে না পারে।’
সেই ল্যাপটপেই পাওয়া গেল কিষেণজির ছবি। তাঁর কম বয়সের যে ছবি প্রভীন ত্রিপাঠী কিংবা অলোক রাজোরিয়াদের কাছে ছিল তার সঙ্গে কোনও মিল নেই। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। চোখে ঔজ্জ্বল্য আছে, কিন্তু চেহারা অনেক ভাঙা। মাথায় ছোট করে কাটা চুল।
ছবিটাকে টেবিলে রেখে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চলে এলেন এক্স।
‘স্যার, আজ দুপুরে সুচিত্রা গ্রামে এসেছে। আমার বাড়িতেই এসেছে। আমার হেল্প চাইল। বলল, গ্রামে অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।’
‘একা এসেছে?’
‘না স্যার। ওর সঙ্গে দুজন আছে। একটা বুড়ো মতো লোক, আর ১৬-১৭ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। খাবার আর জল চাইল। দিলাম। বলল, ‘‘ফোর্স তাড়া করছে।’’ চাদর আর কম্বল চাইল। তাও দিয়েছি। বলেছি, এখন কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। দু’একদিন গ্রামেই থেকে যেতে।’
‘বুড়ো লোকটাকে তুমি চেন? আগে দেখেছ কখনও?’ প্রশ্ন করলেন প্রভীন ত্রিপাঠী।
‘না, স্যার। প্রথম দেখলাম। বাচ্চা ছেলেটাকেও আগে দেখিনি।’
এবার টেবিলের ওপর রাখা কিষেণজির ছবিটা এক্সকে দেখালেন প্রভীন ত্রিপাঠী।
‘হ্যাঁ স্যার। এই বুড়োটাই সুচিত্রার সঙ্গে এসেছে।’
উত্তেজনায় যেন কেঁপে উঠলেন পুলিশ সুপার। ‘এখন কোথায় আছে ওরা?’
‘স্যার, গ্রামের ঠিক বাইরে যেখানে জঙ্গল শুরু হচ্ছে, সেখানে একটা গাছের তলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। ওরাই বলেছে গ্রামে থাকলে বিপদ হতে পারে। লোকজন জানাজানি হয়ে যাবে। সব গ্রামে নাকি জোর তল্লাশি চলছে। স্যার, রাতের খাবারও দিয়ে এসেছি ওদের। কাল সকালে আবার আমাকে খাবার নিয়ে যেতে বলেছে। সুচিত্রা যে এসেছে গ্রামের আর কেউ জানে না স্যার।’
এক্সের মাথায় তখনও ঘুরছে সুচিত্রার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিশোধস্পৃহা। তখনও তিনি জানেন না সুচিত্রা মাহাতো নয়, ওই বুড়ো লোকটার জন্যেই বহু বছর ধরে হন্যে হয়ে ঘুরছে অন্তত পাঁচ রাজ্যের পুলিশ। ওই বুড়ো লোকটাকে ধরতেই কয়েক’শ অপারেশন চালিয়েছে অসংখ্য আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান। কিন্তু বারবার হাত ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছেন কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি। প্রভীন ত্রিপাঠী জানেন, যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায়, কিন্তু খুব দ্রুত। এই মুহূর্তের পরিস্থিতি কাল নাও থাকতে পারে।
‘তুমি ওদের সকালের খাবার কখন দিতে যাবে বলেছ?’
‘স্যার টাইম কিছু বলিনি। বলেছে তাড়াতাড়ি দিতে। ডিম, পাউরুটি এই সব।’
‘ঠিক আছে। একটু সকাল সকাল খাবার দিয়ে তুমি আমাকে ফোন করবে। তারপর আমি বলব কী করতে হবে। আর এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলবে না।’

আগের পর্বে কী হয়েছিল?

এক্স বেরিয়ে যেতেই একা প্ল্যানিংয়ে বসলেন। সিআরপিএফের কমান্ডান্ট রবীন্দ্র ভগত কিংবা কোবরার কমান্ডান্ট দীপক চট্টোপাধ্যায়কেও কিছু জানালেন না। কোবরাও একই সঙ্গে তিন দিন ধরে জঙ্গলে অপারেশন চালাচ্ছে। কিন্তু এই স্পেসিফিক ইনফর্মেশনটা এসেছে রাজ্য পুলিশের কাছে। যতই যৌথ অপারেশন হোক না কেন, বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে এইটুকু কম্পিটিশন লেগেই থাকে যে কোনও বড় অপারেশনের সময়। ২৩ নভেম্বর, ২০১১ রাতে প্রভীন কুমার ত্রিপাঠী শুধু কথা বললেন ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে।
২৪ নভেম্বর ২০১১। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ডিম, পাউরুটি, কলা নিয়ে এক্স গেলেন কুশবনি গ্রামের একদম সীমানায়। বাড়ি থেকে মিনিট পনেরোর হাঁটা। রাস্তা থেকে কম-বেশি পাঁচশো মিটার দূরে জঙ্গলে একটা বড় গাছের নীচে উই ঢিবি। তার আড়ালে মাটিতে বিছানার চাদর পাতা। তাতে বসে রয়েছেন সুচিত্রা আর ওই বুড়ো লোকটা। ফুট চারেক দূরে দাঁড়িয়ে ১৬-১৭ বছরের ছেলেটা। ছেলেটার হাতে ধরা বন্দুক। সুচিত্রা আর বুড়ো লোকটার পাশে রাখা আরও দুটো রাইফেল। বিশেষ কোনও কথা হল না ওদের। সুচিত্রার পাশে ভাঁজ করে রাখা কম্বলের ওপর খাবারের প্যাকেট দুটো নামিয়ে রাখলেন এক্স। ‘গ্রামে পুলিশ ঢুকেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন সুচিত্রা।
‘না। দুপুরে খাবার নিয়ে কখন আসব?’
‘কেউ জানতে পারেনি তো আমাদের কথা? আজকের দিনটা হয়তো থাকতে হবে এখানে।’ ফের বললেন সুচিত্রা মাহাতো। বয়স্ক মানুষটার মুখে কোনও কথা নেই। বাচ্চা ছেলেটাও পাথরের মতো চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে হাতে রাইফেল নিয়ে।
‘না না।’ যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাওয়া যায়, ভাবতে ভাবতেই স্বাভাবিক গলায় এক্স উত্তর দিলেন।
‘একটা-দেড়টা নাগাদ তিনজনের আন্দাজে দুপুরের খাবার দিয়ে যেও কিছু।’
‘আর কিছু লাগবে? কিছু আনতে হবে?’ দু’পা পিছিয়ে প্রশ্ন করলেন এক্স।
‘না। আর কিছু লাগলে দুপুরেই বলে দেব।’
দ্রুত পিছন ঘুরে কুশবনির জঙ্গল থেকে বেরোলেন এক্স। পাঁচশো মিটার রাস্তা মাত্র মাঠ থেকে। কিন্তু তাতেই কপালে, নাকে ঘাম জমেছে। মাঠে উঠে গ্রামে নিজের বাড়ির রাস্তা ধরলেন এক্স।
বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগে আশপাশে সতর্ক চোখ রেখে ফোন করলেন প্রভীন ত্রিপাঠীকে। ‘স্যার, ওরা তিন জন একই জায়গায় বসে আছে। আমি এই মাত্র খাবার দিয়ে গ্রামে ফিরলাম। দুপুর দেড়টা নাগাদ যেতে বলেছে খাবার নিয়ে।’
‘ঠিক আছে। তুমি ওখানেই থাক, আমি জানাব কী করতে হবে।’ ঘড়ি দেখলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। সাড়ে আটটা বাজে।
এক্সের ফোন ছেড়েই মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি বিনীত গোয়েলকে ফোন করলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। ‘স্যার, একটা খবর ম্যাচিওর করেছে। কিষেণজিকা পাক্কা লোকেশন মিলা হ্যায় স্যার। আভি তক সিআরপিএফ’কো বাতায়া নেহি। স্যার, উই আর প্রিপেয়ারিং ফর অপারেশন।’
‘ভেরি গুড। হোয়েন ডু ইউ ওয়ান্ট টু স্টার্ট?’
‘স্যার, ইন দ্য আফটারনুন। বাট বিফোর দ্যাট আই ওয়ান্ট টু টেক আ রিস্ক। রেকি করনা চাহতে হ্যায় হাম।’
‘হোয়াট?’
‘ইয়েস স্যর। হাম খুদ যায়েঙ্গে। অপারেশন কে পহলে হাম একবার খুদ দেখনা চাহতে হ্যায় ওহ এক্স্যাক্ট কাহা পর হ্যায়। কিসিকো পাতা নেহি চলেগা’
‘ওকে। বাট ডোন্ট টেক এক্সট্রা রিস্ক। আয়াম কামিং টু ঝাড়গ্রাম। বেস্ট অফ লাক।’
প্রথামাফিক সিনিয়র অফিসারকে জানিয়ে ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াকে ফোন করলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। বললেন, রেডি হয়ে নিতে। তারপর দ্রুত তৈরি হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার রওনা দিলেন ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে। সকাল ১১ টা নাগাদ ঝাড়গ্রামে পুলিশ সুপারের অফিসে পৌঁছালেন প্রভীন ত্রিপাঠী। ততক্ষণে সেখানে হাজির অলোক রাজোরিয়াও।
খড়গপুর থেকে রওনা দিয়ে সকাল সাড়ে ১১ টার মধ্যে ঝাড়গ্রামে পুলিশ সুপারের অফিসে পৌঁছে গেলেন ডিআইজি বিনীত গোয়েলও। তারপরই ম্যাপ নিয়ে বসে পড়লেন অপারেশনের বেসিক প্ল্যানিংয়ে। এই ফাইনাল প্ল্যানিংয়ে ডাকা হল রাজ্য পুলিশের কাউন্টার ইনসারজেন্সি ফোর্স (সিআইএফ) এবং কোবরার অফিসারদের। বিনীত গোয়েল বসে গেলেন অপারেশনের প্ল্যানিংয়ে। একই সময় একটা সাদা স্করপিও গাড়িতে রেকি করতে বেরোলেন প্রভীন ত্রিপাঠি এবং অলোক রাজোরিয়া। গাড়ির সামনে শুধু পুলিশ সুপারের সিকিউরিটি অফিসার। গাড়িতে উঠেই এক্সকে ফোন করলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। যে জায়গায় আগের দিন কিষেণজিদের বসিয়ে রেখে এসেছেন এক্স, ঠিক সেই জায়গাটা তাঁকে নিয়ে গিয়ে একবার শুধু দূর থেকে নিজের চোখে দেখে আসতে চান তিনি। কিন্তু তাঁর এই রেকির প্ল্যানিং কিছু এক্সকে বললেন না। দহিজুড়ি মোড় থেকে জামবনির দিকে কিছুটা এগোলেই খাল। সেই খালের কাছে এক্সকে অপেক্ষা করতে বললেন পুলিশ সুপার।
ঝাড়গ্রাম শহর থেকে মিনিট কুড়ির রাস্তা। কিন্তু ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের অফিসের বাইরে তখন কয়েকজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে। তাঁদের যাতে কোনও সন্দেহ না হয় তার জন্য সরাসরি দহিজুড়ি মোড়ে যাওয়ার রাস্তা ধরলেন না। গাড়ি ঘোরালেন দহিজুড়ির উলটো রাস্তায়, মেদিনীপুর শহরের দিকে। কিছুটা গিয়েই শুরু হচ্ছে কলাবনি জঙ্গল। তাঁর আগে ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে জামবনির রাস্তা ধরল পুলিশ সুপারের গাড়ি। সাদা স্করপিও’র পেছনের সিটে পাশাপাশি প্রভীন ত্রিপাঠী, অলোক রাজোরিয়া। অনেকটা রাস্তা অতিরিক্ত ঘুরে কুশবনিতে ঢোকার রাস্তায় খালের কাছে পৌঁছল পুলিশ সুপারের গাড়ি। খাল বরাবর গাড়ি একটু এগোতেই রাস্তায় ধারে দাঁড়িয়ে এক্স। মুহূর্তের জন্য থামল সাদা স্করপিও। এক সেকেন্ডে এক্স উঠে পড়লেন গাড়িতে। কালো কাচ। তবু এক্সকে পেছনের সিটে নিজেদের মাঝখানে বসিয়ে নিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার এবং ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। দুপুর ১২ টা বাজে। এক্স উঠতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।
‘আমরা গাড়ি জোরে চালিয়ে বেরিয়ে যাব। তুমি শুধু হাত দিয়ে দেখিয়ে দেবে কোথায় ওরা বসে আছে।’
ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন এক্স। শুধু বললেল, ‘স্যার আমাকে কিন্তু তাড়াতড়ি ছেড়ে দেবেন। ওদের দুপুরের খাবার দিতে যেতে হবে।’
খালের পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা এগোলেই বাঁদিকে ঘুরে (দক্ষিণদিকে) একটা মাটির রাস্তা নেমে গিয়েছে। সেই মাটির রাস্তা ধরে এগোলে ডানদিকে (পশ্চিমদিকে) টানা জঙ্গলে, আর বাঁদিকে (পূর্বদিকে) কিছু বসতি। কুশবনি গ্রাম। এক্সের ইশারায় সেই মাটির রাস্তায় নেমে পড়ল সাদা স্করপিও। সাত-আটশো মিটার গাড়ি এগোতেই ডানদিকের জঙ্গলে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন এক্স। চোখের আন্দাজে মাটির রাস্তা থেকে শ’পাচেক মিটার দূরে একটা জায়গা। না থেমে দু’জন আইপিএস অফিসার এবং এক্সকে নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়িটা। যাতে কারও সন্দেহ না হয়, অনেকটা এগিয়ে ফের মুখ ঘুরিয়ে গাড়ি ফিরে এল সেই খালের ধারে যেখানে তোলা হয়েছিল এক্সকে। গাড়িতে বসেই এক্সের হাতে একটা গ্লোবাল পজিশনিং ডিভাইস (জিপিএস) দিলেন অলোক রাজোরিয়া। দেখিয়ে দিলেন কীভাবে ডিভাইসটা অন করতে হয়। ‘তুমি যখন একটু বাদে খাবার দিতে যাবে ওদের আশপাশে কোথাও এটা আস্তে করে মাটিতে ফেলে দেবে।। ওরা যেন কেউ দেখতে না পায়। শুধু বাড়ি থেকে বেরনোর আগে এটা অন করে নেবে।’ জিপিএস ডিভাইসটা এক্সের হাতে দিয়ে তাঁকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন অলোক রাজোরিয়া।

চলবে

Comments are closed.