আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২৬ অক্টোবর ২০০২, জামবনিতে সিপিআইএম নেতা দিবাকর মালাকার খুনের পর দুবরা গ্রামে হানা দিল বাসু ভকতের লোকজন, চাষের মাঠ থেকে ফিরছিলেন মোহিনীমোহন ষড়ঙ্গী…
প্রসূন ষড়ঙ্গীর সাক্ষ্য
দুবরা গ্রামের ঘটনার বর্ণনায় যেখানে থেমেছিলেন ওই পুলিশ অফিসার, সেখান থেকে শুরু করলেন জামবনির দুবরার প্রসূন ষড়ঙ্গী।
‘সেদিন আমি ঝাড়গ্রাম শহরে। গ্রামের বাড়িতে থাকলে এতদিন আর বেঁচে থাকতাম না। সেদিনই খুন হয়ে যেতাম। বাসু ভকতের বাহিনী দুবরা গ্রামকে টার্গেট করে মূলত আমাদের ফ্যামিলির জন্যই। বাবা কংগ্রেস করতেন। পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের সিটে কংগ্রেসের হয়ে লড়েছিলেনও। আমিও তখন কংগ্রেস করি। তার আগে করতাম ছাত্র পরিষদ। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ছটা কলেজ ছিল তখন। সবকটাতেই ছাত্র পরিষদের জোরদার সংগঠন ছিল।
সেদিন সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী যখন গ্রামে ঢোকে তখন বাবা বাড়ি ছিলেন না। রোজ চাষের জমি দেখতে যেতেন একদম সকালে। তারপর রোদ বাড়লে মাঠ থেকে ফিরতেন। সেদিনও জমি থেকে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির একটু আগে সিপিআইএম বাহিনী বাবাকে দেখতে পায়। বাবার তখন যথেষ্টই বয়স হয়েছে। পালানোও সম্ভব ছিল না। প্রথমে পিছন থেকে একজন বাবার পিঠে গুলি করে। বাবা সাইকেল থেকে পড়ে যান। আর উঠতে পারেননি। এরপর আরও তিন-চারটে গুলি করে ওরা। চপার দিয়ে কোপায় ৭২ বছরের মানুষটাকে। তারপর ওরা মাটিতে হিঁচড়ে টানতে টানতে মৃতপ্রায় বাবাকে বাড়ির সামনে নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে উঠোনে খড়ের গাদা ছিল। ধানের গোলা ছিল। গ্রামের সব বাড়িতে যেমন থাকে। সেই খড়ের মধ্যে রক্তাক্ত বাবাকে ফেলে দেয় বাসু ভকতের লোকজন। তখনও বাবা বেঁচে। এরপর…এরপর খড়ের গাদায় কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বাসু ভকতের বাহিনী। জীবিত অবস্থায় পুড়ে মৃত্যু হয় বাবার। অপরাধ, সিপিআইএম জমানায় জামবনিতে কংগ্রেস করা।’
প্রসূন ষড়ঙ্গী বলছেন, আর আমি তা শুনে শিউরে উঠছি। এমন নৃশংস খুনও হয়? একই কথা বলেছিলেন ওই পুলিশ অফিসারও। বলেছিলেন, ‘দুপুরে আমরা পুরো ফোর্স নিয়ে দুবরায় যেতে পেরেছিলাম। তখনও ষড়ঙ্গীদের বাড়ি ধিক ধিক করে জ্বলছে। খড়ের গাদা থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে। আর মাংস পোড়ার বীভৎস গন্ধ। এমন ভয়াবহ খুন আমার চাকরি জীবনে দেখিনি আগে।’ কিন্তু ৭২ বছরের মোহিনীমোহন ষড়ঙ্গীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জীবন্ত পুড়িয়েই থামেনি সিপিআইএম বাহিনী।
আবার বলতে শুরু করলেন প্রসূন ষড়ঙ্গী। ‘বাবাকে খড়ের গাদায় ফেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর আমাদের বাড়িতে ঢোকে বাসু ভকতের বাহিনী। বাড়ির পেছনে একটা বড় নালা ছিল। বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মা সেই নালায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমাদের পুরো বাড়ি লুঠপাট করে জ্বালিয়ে দেয় সিপিআইএম বাহিনী। এরপর পাশেই কাকাদের বাড়িতে আক্রমণ করে তারা। পুরো পরিবার মিলে আমাদের তিনখানা বাড়ি। সবকটাই লুঠ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরেই থাকত আরও একটা সক্রিয় কংগ্রেসি পরিবার। সেই পরিবারের কর্তা শিশির শতপথী বাবার সঙ্গে কংগ্রেস করতেন। তখন প্রায় ৮২ বছর বয়েস। শিশির জেঠু বাড়িতে ছিলেন। আমাদের বাড়িতে লুঠতরাজ চালিয়ে সিপিআইএম বাহিনী তাঁদের বাড়িতে হানা দেয়। শিশির জেঠু কিছু বোঝার আগেই তাঁকে গুলি করে। তারপর চপার দিয়ে কোপায়। বাড়ির পাশেই পুকুরে স্নান করতে গেছিলেন শিশির জেঠুর স্ত্রী শিবানী শতপথী। প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা। স্বামীর চিৎকার শুনে তিনি দৌড়ে আসেন পুকুর ধার থেকে। তাঁকেও রেয়াত করেনি বাসু ভকতের লোকজন। শিবানী শতপথীকে গুলি করে চপার দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটে তারা।
প্রায় দু’ঘন্টা ধরে দুবরা এবং আশপাশের গ্রামে তাণ্ডব চালায় সিপিআইএমের লোকজন। ভয়ঙ্কর, বীভৎস তাণ্ডব। বেছে বেছে ঝাড়খন্ড এবং কংগ্রেস পরিবারগুলোর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। কেউ প্রতিরোধ করতে পারেনি, পুলিশে খবর দিতে পারেনি। আমি তখন ঝাড়গ্রাম শহরে। অনেক বেলায় খবর পেয়েছিলাম, বাসু ভকতের বাহিনী আমাদের বাড়ি অ্যাটাক করেছে। তখনও জানতে পারিনি কী বীভৎসভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে খুন করেছে আমার বৃদ্ধ বাবাকে। খুন করেছে বৃদ্ধ দম্পতি শিশির শতপথী, শিবানী শতপথীকে। সেদিন সারাদিন বাড়ি ফিরতে পারিনি সিপিআইএমের ভয়ে। ঝাড়গ্রাম থেকে বিভিন্ন লোককে বারবার ফোন করছি। ঝাড়গ্রামে বসে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে, কে সাহায্য করতে পারে। কীভাবে বাসু ভকত বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করতে পারে বাবা-মাকে। পুলিশ যখন দুপুরের পর আমাদের গ্রামে গিয়েছিল, ততক্ষণে সব শেষ।’
প্রসূন ষড়ঙ্গীর কথা শুনে ভাবছিলাম কী ভয়ঙ্কর ছিল ঝাড়গ্রাম মহকুমায় রাজনীতির চেহারাটা। খুন, বদলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কোনও শব্দই যথেষ্ট নয় এক কথায় এই রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য। কখনও কখনও মনে হয়েছে বর্বরতাও যথেষ্ট লঘু শব্দ ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সিপিআইএম, ঝাড়খন্ডি এবং মাওবাদীদের কিছু আচরণকে বোঝানোর জন্য।
একজন দিবাকর মালাকার খুন হলেন সকালে। আর তার বদলায় তিন তিনজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খুন! আর খুন তো যেমন-তেমন নয়। গুলি করে, চপার দিয়ে কেটে একেবারে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা। যাতে মৃতদেহ চিনতে পর্যন্ত না পারা না যায়। এই খুনের মধ্যে তো স্রেফ রাজনৈতিক বদলা নেই। পরতে পরতে বুঝিয়ে দেওয়া আছে, সর্বশক্তিমান শাসক দলের গায়ে হাত পড়লে কী হতে পারে তার প্রতিক্রিয়া! গোটা এলাকায় দু’-আড়াই ঘন্টার ভয়াবহ তাণ্ডবের মধ্যে দিয়ে বিরোধী মনোভাবাপন্ন সাধারণ মানুষজনের মধ্যে একটা ফিয়ার সাইকোসিস তৈরি করা। যে বদলার কাহিনী মুখে মুখে ঘুরবে এদিক-ওদিক। গ্রামের পর গ্রাম লোকে বুঝে যাবে, বাসু ভকত রেগে গেলে কী হয়! তিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে পালটা খুনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত শাসক বিরোধী মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া আছে, সামনের বছর পঞ্চায়েত ভোট, আর একজন সিপিআইএম নেতা-কর্মীও খুন হলে তার প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। কংগ্রেসি, ঝাড়খন্ডিদের মৃতদেহ শনাক্ত করারও লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এবার ফিরতে হবে সেই প্রশ্নে। বাসু ভকতের মৃত্যু আসলে ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া? এই প্রশ্ন নিয়ে আবার ফিরলাম সেই পুলিশ অফিসারের কাছে। ‘মোহিনীমোহন ষড়ঙ্গীর মতো না হলেও বাসুদেব ভকতের খুনটাও তো কম ভয়াবহ কিছু নয়!’
‘নয় তো। টাঙি, বল্লম দিয়ে কুপিয়ে, কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। তারপর একাধিক তীর ছোঁড়া হয়েছে শরীরে। মোহিনী ষড়ঙ্গীদের খুনের কয়েক মাসের মধ্যের ঘটনা এটা। বাসুদেব ভকতের মৃতদেহ ঝাড়গ্রামে এনে ভালোভাবে দেখি আমরা। পুরো শরীরে বীভৎস প্রতিহিংসার চিহ্ন। আসলে একটা সময়ের পর আমরা বুঝতে পারছিলাম, বাসুদেব ভকত বাহিনীর এই অত্যাচার জামবনিতে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। মানুষের তীব্র রাগ জমা হচ্ছিল বাসু ভকতের ওপর। সিপিআইএমের ওপর। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারত না। সিপিআইএম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি ছিল প্রচণ্ড। দেখুন, বাসু ভকতকে নৃশংসভাবে হত্যা ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া তা এক কথায় বলা অসম্ভব। কিন্তু এটা বলা যায়, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ব্যক্তি হত্যার রাজনীতির যে নৃশংস পরম্পরা চালু হয়েছিল, তার একটা স্পেশাল কেস স্টাডি বাসু ভকতের খুন। এমন কেস স্টাডি ওখানে আরও অনেক আছে। বাসু ভকত শাসক দলের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন বলে তাঁর মৃত্যুর প্রচারটা বেশি হয়েছিল। তবে একটা কথা বলতে পারি, বাসু ভকতের নৃশংস হত্যা হয়তো কখনও না কখনও হওয়ারই ছিল।
রামজীবন মুর্মু, ২০১১
২০০৯ সালের পর ফের রামজীবন মুর্মুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম দু’বছর বাদে। মাঝে দেখা করার সুযোগ হয়নি। ২০১১ বিধানসভা ভোটের অ্যাসাইনমেন্টে ফের গেলাম ঝাড়গ্রাম। এবং আবার একবার গেলাম রামজীবন মুর্মুর বাড়ি। এই দু’বছরে জঙ্গলমহলে পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই।
২০০৯ সালে লালগড়কে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম মহকুমার একটা বিস্তীর্ণ অংশে চূড়ান্ত আধিপত্য ছিল মাওবাদীদের। কিষেণজির নেতৃত্বে লালগড় আন্দোলন সেই সময় একেবারে তুঙ্গে। সিপিআইএম কর্মী, সমর্থকদের খুন এবং বাড়িছাড়া করার ঘটনা তখন মাওবাদীদের রুটিন কর্মসূচি। সিপিআইএম কর্মী শালকু সরেনের খুন তখন মাওবাদীদের নৃশংস হত্যার রাজনীতির এক চূড়ান্ত উদাহরণ। মৃতদেহ তোলা যাবে না, সৎকার করা যাবে না, মাওবাদীদের এই ফতোয়ায় লালগড়ে শালকু সরেনের মৃতদেহে হাত দিতে পারেনি কেউ। পুলিশ, সিআরপিএফ তখনও জঙ্গলমহলের বহু এলাকায়, গ্রামে ঢুকতে পারছে না। সিপিআইএম বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি তখন বিনা শর্তে মাওবাদীদের নেতৃত্বে একত্রিত হতে শুরু করেছে। লক্ষ্য, সিপিআইএমকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। সেই ছ’য়ের দশকের শেষ থেকেই সিপিআইএমের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছিল কংগ্রেস এবং ঝাড়খন্ড পার্টি। ১৯৯৮ সাল থেকে লড়ছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। আর মাওবাদীরা তো আছেই। কিন্তু লালগড় আন্দোলনের পর ভিন্ন এক পরিস্থিতি তৈরি হল জঙ্গলমহলে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম উত্তর যুগে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম বিরোধী আন্দোলনের ব্যাটন লালগড়কে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম মহকুমার হাতে চলে এল। সেই সময় সব বিরোধী দলের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটাই বার্তা, সিপিআইএমকে উৎখাতের এমন অনুকুল পরিবেশ আগে কখনও আসেনি। দরকার একটা শেষ জোরদার ধাক্কার। এতদিনের সরকারের পতন অনিবার্য। তাই সিপিআইএমকে হারানোর জন্য তখন অভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে সমস্ত বিরোধী দল।
আর দু’বছর পর ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের সময় পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। সেই সময় পায়ের তলায় অনেকটা জমি ফিরে পেয়েছে পুলিশ এবং সিআরপিএফের যৌথ বাহিনী। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে দু’চারটে ভাল অপারেশনও ততদিনে হয়ে গেছে। তাছাড়া, বাছবিচারহীন খুনোখুনি করে মাওবাদীরা তখন গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে পারত না, কিন্তু মনে মনে মাওবাদী বিরোধী হয়ে উঠেছিল সেই সময়। ২০০৮-০৯ সালে বিভিন্ন গ্রামের সক্রিয় সিপিআইএম নেতা-কর্মীরা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ছিল ঠিকই। তবে সাধারণ মানুষের মাওবাদীদের প্রতি যথেষ্টই সমর্থন ছিল। কিন্তু মাওবাদীরা যথেচ্ছ খুনোখুনি শুরু করার পর বহু সাধারণ মানুষেরও তাদের সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়। যে পরিস্থিতি ২০০৯ সালে ছিল না। তাছাড়া আরও একটা বড়ো পরিবর্তন হয়েছিল জঙ্গলমহলে।
তা হচ্ছে মাওবাদীদের মোকাবিলায় সিপিআইএমের সশস্ত্র প্রতিরোধ। একদম সশস্ত্র ক্যাম্প তৈরি করে মাওবাদীদের সর্বাত্মক মোকাবিলায় নেমে পড়ে রাজ্যের শাসক দল। ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় এই সশস্ত্র ক্যাম্প ছিল কয়েকটা। কিন্তু ২০১০ থেকেই তার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। জঙ্গলমহলের বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে দোতলা-তিনতলা পার্টি অফিসকে সশস্ত্র ক্যাম্পে কনভার্ট করে সিপিআইএম। কোথাও তেমন লোকেশনে পার্টি অফিস না থাকলে সেখানে কোনও পার্টি সদস্য কিংবা নেতার বাড়িতে ক্যাম্প করা হয়। প্রতিটা ক্যাম্পে অন্তত আট-দশজন লোক সবসময় থাকত। বন্দুক থাকত অন্তত ছ’আটটা। গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে লোক এবং বন্দুক রাখা হোত আরও বেশি। মাওবাদীরা হঠাৎ আক্রমণ করলে যাতে তাদের ঠেকানো যায়। এই ক্যাম্পগুলোকেই ‘হার্মাদ শিবির’ বলে অভিযোগ করতে শুরু করে বিরোধীরা। পুলিশের মদতে পুরো জঙ্গলমহলে সিপিআইএমের হার্মাদ শিবির চলছে বলে ২০১০ সাল থেকেই রাস্তায় নামেন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিআইএমের এই সশস্ত্র ক্যাম্প এবং এই ক্যাম্পের সঙ্গে মাওবাদীদের লড়াইয়ের বহু ঘটনা আছে। যার এক মর্মান্তিক পরিণতি ২০১১ সালের শুরুতে নেতাইয়ে৷ আপাতত শুধু এটুকুই বলার, ২০১১ সালে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের পক্ষে পরিস্থিতি ততটা অনুকুল ছিল না, যতটা ছিল ২০০৯ সালে। যদিও সিপিআইএমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মেরুকরণটা তীব্র ছিলই।
রাজ্যে যখন ৩৪ বছরের সরকার বদল কয়েকটা দিনের মাত্র অপেক্ষা, এমনই এক সময় ২০১১র প্রখর গ্রীষ্মে আমার গাড়ি গিয়ে থামল রামজীবন মুর্মুর বাড়ির সামনে। এবার আর বারবার গাড়ি থামিয়ে লোককে জিজ্ঞেস করতে হয়নি বাড়ির ডিরেকশন। আর জঙ্গমহলে মাটি কিংবা মোরামের রাস্তায় এপ্রিল-মে মাসের দাবদাহে বারবার গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নামার অভিজ্ঞতা যাঁর আছে তিনি জানেন, আপনি রাস্তায় নামলেন মানেই, গাড়ির সঙ্গে ছুটতে ছুটতে আসা ধুলো, বালি, মাটি এবং তীব্র গরম আপনার পার্মানেন্ট সঙ্গী হল।
আগেরবার পৌঁছে দেখেছিলাম, বাড়ির উঠোনেই বসেছিলেন রামজীবন। এবার উঠোনটা ফাঁকা। কেউ নেই। তবে বাড়ির চেহারায় কিছু বদল হয়নি। ঘরের দরজা খোলা। উঠোন পেরিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে দেখলাম ভেতরেও কেউ নেই। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, ভাবছি কাকে জিজ্ঞেস করব রামজীবনের কথা। তবে গ্রামের একটা সুবিধে হচ্ছে, গাড়ি ঢুকলে আস্তে আস্তে দু’একজন ঠিক জড়ো হয়ে যায়। হলও তাই। এক মহিলা বললেন, ‘এই তো একটু আগেই ছিল। কাছাকাছিই কোথাও গেছে। এসে যাবে।’
অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। যদিও সময় নেই হাতে খুব একটা। পরদিন ভোট ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। ভেবেছিলাম, মিনিট পনেরো দেখা করে ফিরে যাব। দেখব, জঙ্গলমহলে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া সিপিআইএম জমানায় কেমন আছেন রামজীবন মুর্মু। দু’পাঁচ মিনিট কেটেছে। সামনে এগিয়ে এল একটা ছেলে। যুবক বলাই ভাল। বছর কুড়ি বয়স। ‘কাকা বোধয় থানায় গেছে। কাল বলছিল, আজ একবার থানায় যাবে।’
‘কেন, থানা কেন? কী হয়েছে?’
‘আপনি কে?’
‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। দু’বছর আগে একবার এসেছিলাম এই বাড়িতে। রামজীবন মুর্মু আর তাঁর ভাই নকুলবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ঝাড়গ্রামে কাজে এসেছি, ভাবলাম দেখা করে যাই। আপনি?’ নিজের পরিচয় না জানিয়ে বললাম আগন্তুক যুবককে।
আমার নাম উজ্জ্বল মাহাতো। পাশেই থাকি। রামজীবন কাকার ছেলে শিবরাম আমার বন্ধু। গত পুজোয় পুলিশ শিবরামকে অ্যারেস্ট করেছিল। মিথ্যে সব কেস দিয়েছে। রাস্তা কাটা, খুনের চেষ্টা। দু’মাস পর বেল পেল। তারপর শিবরাম বাড়িতেই থাকত, বেশি বেরোত না। এ’বছর ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ আবার অ্যারেস্ট করল। এক মাস পর বেল হল। তারপর থেকেই শিবরাম বাড়িছাড়া। কোথায় গেছে কেউ জানে না। পুলিশ আসে ওর খোঁজে। রামজীবন কাকাকে মাঝে-মাঝে থানায় ডেকে পাঠায়।’
এই ব্যাপারগুলোতো তো জানা ছিল না। তাঁর এক ছেলে আছে, বলেছিলেন রামজীবন। নামও বলেছিলেন। কিন্তু সে কী করতো জানতে চাইনি তখন।
‘পর পর দু’বার পুলিশ অ্যারেস্ট করল কেন?’ জানতে চাইলাম উজ্জ্বলের কাছে। ধূসর রঙের টি-শার্ট আর ভদ্রস্থ একটা প্যান্ট পরনে। পায়ে চামড়ার চটি। হাতে ঘড়ি, আংটি নেই, মোবাইল ফোন আছে। হাজার চারেক টাকার মোবাইল সেট। অভাব হয়তো আছে কম-বেশি, কিন্তু দারিদ্রের যে প্রকট ছাপ দেখতে পাই এই এলাকার বহু মানুষের চোখে-মুখে, তা উজ্জ্বলের চেহারায় নেই। অবশ্য কম বয়সীদের চেহারায় দারিদ্রের ছাপটা কম। সবাই মোটামুটি কিছু না কিছু করে এখন। সন্তোষ রাণা বলেছিলেন, এই এলাকার আদিবাসী মানুষেরা পুরো পরিবার নিয়ে বংশ পরম্পরায় প্রায় ক্রীতদাসের মতো কাজ করতো এক সময়। ঝাড়গ্রামের প্রথম এসডিপিও তুষার তালুকদার তো এই রামজীবনের বাবাকেই মুক্তি দিয়েছিলেন স্ত্রী হত্যার দায় থেকে। সেই রামজীবনের ছেলের বন্ধু এখন ডান হাত প্যান্টের পকেটে, বাঁ হাতে মোবাইল ফোন, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দশ-পাঁচজনের সামনে অচেনা লোকের কাছে পুলিশের সমালোচনা করছে, এটাও তো একটা গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণ। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দু’ভাবেই। উজ্জ্বলের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আরও চার-পাঁচজন জড়ো হয়েছে।
‘পুলিশ তো এই করছে দু’বছর ধরে। যাকে-তাকে অ্যারেস্ট করছে মাওবাদী বলে। আপনি কোন মিডিয়া?’ পালটা প্রশ্ন করল সে। গাড়িতে লাগানো প্রেস স্টিকার এবং আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যানকে দেখে ঠিকই বুঝেছে। এও জঙ্গলমহলে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ২০০৮ সালের শেষে লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর। মাওবাদী এবং পুলিশের পরই যাদের সবচেয়ে বেশি দেখেছে জঙ্গলমহলের মানুষ, তারা সাংবাদিক। অনেককে দেখেছি, টেলিভিশন সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে হাত দিয়ে চুল ঠিক করে নিচ্ছেন।
‘শিবরামের মতো কি এই গ্রামের অনেককেই পুলিশ ধরেছে?’ জিজ্ঞেস করলাম উজ্জ্বলকে।
‘হ্যাঁ, ধরেছে। অনেককে ধরেছে। শিবরাম তৃণমূল করতো। আমিও করি। পিসিপিএ’র মিটিং-মিছিলে যেত। আমিও যেতাম। ওকে ধরল মাওবাদী বলে। বেল পাওয়ার পর আবার ধরল। ভোটের আগে আবার ধরতো, তাই পালিয়েছে।’
উজ্জ্বল মাহাতোর কথা শুনছি আর ভাবছি, কী বিচিত্র কারবার। এত কিছু বদল হল, কিন্তু সিপিআইএম বিরোধিতা মানেই পুলিশি হেনস্থা, জঙ্গলমহলে এই ব্যাপারটা পাল্টাল না আজও! নকুলও একই কথা বলেছিলেন। আর ভাবছিলাম রামজীবন মুর্মুর কথা। রামজীবন মাহাতোর জীবন যে নিজের গতিপথে তাঁকে আর কত কী দেখাবে, কত শার্প টার্ন নেবে, কে জানে?
ছ’বছর বয়সে বাবার ধাক্কায় পড়ে গিয়ে যক্ষা রোগে ক্ষয়ে যাওয়া মায়ের মৃত্যু। তারপর মামা বাড়িতে থাকা। পুলিশে ধরা দিল বাবা। সহানুভুতিশীল এক পুলিশ অফিসারের উদ্যোগে বাবার ছাড়া পাওয়া। এত বছর বাদে দু’দুবার পুলিশ ধরল ছেলেকে। এখন মাঝবয়সে পৌঁছে ছেলের জন্য থানায় দৌড়ঝাঁপ!
‘আপনি কী করেন?’ জিজ্ঞেস করলাম উজ্জ্বলকে। ‘আচ্ছা ওকেই ধরল কেন?’
‘তৃণমূল করি। ২০০৭ থেকে। তখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম চলছে। শিবরামের কাকা ঝাড়খন্ড পার্টি করত। আমরা তৃণমূল করতে শুরু করলাম। আগে গ্রামে সিপিআইএম একটু বেশি ছিল। কিন্তু ওই সময় থেকে আমরা আর সিপিআইএম সমান-সমান হয়ে গেলাম। ২০০৮ পঞ্চায়েত ভোটের আগে একদিন গ্রামে আমাদের মিটিং চলছিল। গ্রামেরই কয়েকজন ছিলাম। সবাই সিপিআইএম বিরোধী। কীভাবে ভোটে লড়া হবে, কে কোথায় ক্যান্ডিডেট হবে এই সব নিয়ে মিটিং। নদীর ওপার থেকে মোটরসাইকেলে চেপে সিপিআইএমের লোকজন এল। প্রায় সবার হাতে বন্দুক। আমাদের মারধর করল। মিটিং ভেঙে দিল। যে সব গ্রামে সিপিআইএমের বেশি লিড ছিল সেখানে বেশি কিছু করত না ওরা। কিন্তু যেখানেই বিরোধীরা সমান-সমান হয়ে গেছে সেখানেই ওরা অত্যাচার করেছে।’
উজ্জ্বল মাহাতোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি কী করেন?’ এর জবাব এল, ‘তৃণমূল করি।’
এও ২০০৭ পরবর্তী পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলে এক মৌলিক পরিবর্তন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে এই বদলটা শুরু হয়েছে। যেখানেই রাজনৈতিক লড়াই তীব্র হয়েছে, সেখানেই মানুষের আর সব পরিচয়, জীবন-জীবিকা গৌণ হয়ে গিয়েছে। মানুষের তখন একমাত্র পরিচয় হয়েছে, তার রাজনৈতিক আইডেনটিটি। সে কোন পার্টি করে, এটাই তখন মুখ্য। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম কিংবা লালগড়, বিনপুর তো বটেই, সেই সময় রাজ্যের বহু এলাকাতেই মানুষের একমাত্র পরিচয়, হয় ‘সিপিআইএম’ নয়তো ‘তৃণমূল কংগ্রেস’। এমনই তীব্র তখন এপার বাংলার রাজনৈতিক মেরুকরণ।
‘কিন্তু শুধু তৃণমূল করার জন্যই পুলিশ শিবরামকে ধরল? তৃণমূল তো বললেন, গ্রামের অনেকেই করে!’
‘ওর কাকা ঝাড়খন্ড পার্টি করে তো। তাই শিবরামকে টার্গেট করেছে। নকুল কাকাকেও তো ধরেছে। পুলিশ যাকে খুশি অ্যারেস্ট করছে হার্মাদদের কথায়।’
‘আচ্ছা শিবরাম কী করত? মানে, কাজ-কর্ম?’
‘তেমন কিছু না। আমি আর শিবরাম একই কাজ করতাম। শাল পাতার থালার ব্যবসা।’
‘শাল পাতার থালা? কী রকম?’
‘গ্রামের মহিলারা জঙ্গলে শাল পাতা কুড়োতে যায়। তাদের কাছ থেকে শাল পাতা কিনতাম। এক হাজার শাল পাতা কিনতাম ২০ টাকায়। তারপর সেই পাতা দিয়ে থালা তৈরি করতাম। শাল পাতার থালা। সেই থালা বিক্রি করতাম উড়িষ্যায়। অমরদা বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে থালা সাপ্লাই করতাম। এক হাজার পাতার থালা বানিয়ে বিক্রি করলে লাভ থাকত ৮-১০ টাকা।’
‘শিবরামও তাই করতো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু পুলিশ ধরার পর ওর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘আর আপনার ব্যবসা?’
‘এখন বন্ধ আছে। ইলেকশন চলছে তো।’
কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১২
আর সময় নেই। ফিরব ফিরব করছি। ‘রামজীবনবাবুর মনে হয় দেরি হবে। অন্য কোনওদিন আসব। দেখি পারলে কাল আসব একবার।’ উজ্জ্বলকে বলে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে। গ্রাম ছাড়িয়ে খানিকটা এগিয়ে পড়লাম পিচ রাস্তায়। কাল বিধানসভা ভোট। জঙ্গলমহলের মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনের এক এসপার-ওসপার পরীক্ষা। যদিও গোটা রাজ্যেই তাই। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। গত দু’বছরে এত নৃশংস হত্যা-পাল্টা হত্যার সাক্ষী এই লালগড়, জামবনি, বিনপুর, বেলপাহাড়ি, একটা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে বহু মানুষের, বহু পরিবারের ভবিষ্যৎ, জীবন-জীবিকা। এখানে মানুষের মনে এত ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধস্পৃহা জমা হয়ে রয়েছে! কে আবার ঘরছাড়া হবে, কত খুন হবে, সবই তো নির্ভর করছে ভোটের রেজাল্টের ওপর। ভোটের রেজাল্ট সিপিআইএমের পক্ষেই হোক আর বিরুদ্ধেই হোক, সবই যে গরিব মানুষ। গরিবের সঙ্গে গরিবের এই মুরগির লড়াই কি পাকাপাকি থামবে ২০১১ সালের এই বিধানসভা ভোটের রেজাল্টের পরে, না তা বাড়বে? নানান সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা। মাঝে মাঝে পুলিশ-আধা সামরিক বাহিনীর গাড়ি যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি, দূর থেকে একটা লোক হেঁটে আসছে। মাথায় একটা গামছা জড়ানো। ৪২-৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ নিয়ে সূর্য তখন মাঝ আকাশে। ক্লান্ত পায়ে আস্তে-আস্তে হাঁটছে লোকটা। আমাদের গাড়ি হুশ করে পেরিয়ে গেল লোকটাকে। রামজীবন মুর্মু না? এক ঝলক মুখটা দেখে তো তাই মনে হল!
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, দাঁড়াও।’ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থামাতে বললাম ড্রাইভারকে। কিন্তু থামাতে-থামাতেই গাড়ি এগিয়ে গেল ৫০-৭০ মিটার। গাড়িতে বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পেছন দিকে। লোকটা হেঁটেই চলেছে ধীর পায়ে। দরজা খুলে নামতে গেলাম। ইচ্ছে করল না, বাইরে এত গরম। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে একবার সময় দেখলাম। দেড়টা বাজে। যদি লোকটা সত্যিই রামজীবন হয়, কথা বলতে বলতে কিছুটা সময় চলে যাবে। তাছাড়া বলবই বা কী? বলার তো নেইও কিছু। এই গরমের মধ্যে আবার নামব? খিধেও পেয়েছে।
‘দাদা, গাড়ি ঘোরাব?’
‘ঘোরাবে? না থাক, ছেড়ে দাও। চলো।’
লোকটা তো রামজীবন মুর্মু নাও হতে পারে। আবার হতেও পারে। কীই বা এসে যায়! একজন রামজীবন মুর্মুর সঙ্গে একই বয়সী আরও একটা গরিব আদিবাসী মানুষের তফাতই বা কী? শহর থেকে এসে এসি গাড়ি চেপে ঘুরছি। এর সঙ্গে, তার সঙ্গে কথা বলছি। সব তো নিজেরই কাজে। মাঝে-মধ্যে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। হয়তো কাউকে বলছি, কী সুন্দর জায়গা এই ঝাড়গ্রাম। ট্যুরিজমের কত কী করা যেত! আমরা শহরের মানুষ তো ঝাড়গ্রামকে এমন এক ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবেই দেখে এসেছি ঘরোয়া আড্ডায়, যেখানে এখন আর যাওয়া যায় না স্রেফ মাওবাদীদের জন্য!
কিন্তু রামজীবন মুর্মুর মতো যে মানুষগুলো ৩৬৫ দিনই বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে প্রকৃতি, রাষ্ট্র এবং আর্থিক অবস্থার সঙ্গে? তাঁদের প্রতি আমি, আমরা সত্যিই কতটা সংবেদনশীল, এই প্রশ্নেরও কোনও জবাব নেই আমার কাছে। লোকটা হয়তো রামজীবনই ছিল। কিন্তু বাইরে এত গরম, আর খিধেও পেয়েছে, এই দুই কারণে তো গাড়ি থেকেও নামলাম না। ঝাড়গ্রাম শহরে ফিরতে ফিরতে মাথায় শুধু ঘুরছে শিবরাম মুর্মুর কথা। উজ্জ্বল বলেছে, শিবরাম তৃণমূল কংগ্রেস করে। এখন কোথায় আছে, কে জানে! পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ছেলেটা। রামজীবনের আর থিতু হয়ে বসা হল না এক জায়গায়। ছ’বছর বয়সে বাবার জন্য পুলিশ দেখেছে, এখন দেখছে ছেলের জন্য।
ঝাড়গ্রাম শহরে যখন ঢুকছি, তখনও ভাবছি, লোকটা নিশ্চয় রামজীবন নয়। তীব্র গরমে গাড়ি থেকে না নামার অস্বস্তিটা গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে। মাথার ওপর আগুনে সূর্যকে নিয়ে থানা থেকে বাড়ির দিকে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া লোকটার রামজীবন মুর্মু না হওয়াই তখন আমার একমাত্র সান্ত্বনা।
চলবে
(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)
Comments are closed.