কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৬

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: পিসিপিএ নেতার খবরের ভিত্তিতে গোয়ালতোড়ের জঙ্গলে এনকাউণ্টারে মৃত্যু হল সিদু সোরেনের। কীভাবে বেলপাহাড়িতে প্রভাব বিস্তার শুরু এমসিসি-জনযুদ্ধর…

 

আটের দশক থেকেই বিহারে এমসিসির যে প্রভাব বিস্তার, তার আঁচ এসেই পড়ল বাংলায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার আকাশ বা শালবনির মদনের যাতায়াত শুরু হল বেলপাহাড়িতে। নয়ের দশকের শুরুতে রাজ্য পুলিশের ধারণাতেও ছিল না, কুড়ি-পঁচিশ বছরের কিছু ছেলেমেয়ে সন্ধে নামার পর গ্রামে-গ্রামে আসছে। গরিব আদিবাসী বাড়ির উঠোনে বসে খালি গলায় গান গাইছে, হতদরিদ্র মানুষগুলোকে প্রশ্ন করছে, কেন্দু পাতার দাম এত কম, তোমাদের চলে কীভাবে? জানতে চাইছে, এখানে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই কেন? তখনও বন্দুক নেই, খুনোখুনি নেই, ল্যান্ডমাইন নেই। তখনও সিপিআইএম আর ঝাড়খন্ড পার্টি এলাকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে ব্যস্ত।
বেলপাহাড়ি সহ গোটা ঝাড়গ্রামে দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির লড়াই-সংঘর্ষের মধ্যেই গরিবের মৌলিক দাবিদাওয়া পূরণের দাবিতে সন্ধের পর যাঁরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁদের স্থানীয় মানুষ তখন বনপার্টি বলেই জানতো। সাধারণ মানুষের কাছেই তখনও এমসিসি, জনযুদ্ধের নাম অচেনা, আর নয়ের দশকের শুরুতে বেলপাহাড়ি পুলিশ তো তখন সমস্ত অর্থেই, না নিধিরাম সর্দার বলা ঠিক হবে না, তবে ঢাল-তরোয়ালহীন তো বটেই!
তবে সর্দার ওই এলাকায় একজন ছিলেন, বাঁশপাহাড়ির ভীমার্জুন গ্রামে বাড়ি। সিপিআইএমের লোকাল কমিটি সম্পাদক, সুধীর সিংহ সর্দার। খুন হলেন একুশ শতকের গোড়ায়। প্রথম বড়ো মাপের সিপিআইএম নেতা খুন, নড়েচড়ে বসল মেদিনীপুরের পুলিশ। যদিও তখন দেশের সবচেয়ে বড় জেলা মেদিনীপুর মানে একদিকে কোলাঘাট, একদিকে দিঘা, একদিকে হলদিয়া তো অন্যদিকে গড়বেতা, একদিকে এগরা-বেলদা, অন্যদিকে বেলপাহাড়ির সঙ্গে বাঁকুড়া সীমানার জঙ্গল, আবার কোনওদিকে দাঁতন। হেলিকপ্টারেও একদিনে পুরো জেলা সফর অসম্ভব। পরিকাঠামোগত বাস্তব সমস্যাও ছিল পুলিশের।
মেদিনীপুরের ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে যখন একটা প্রাথমিক কথা হলই, তখন বাংলায় মাওবাদী করিডোরের একটা সামান্য ভূমিকাও জরুরি। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে রেললাইন পেরিয়ে যে রাস্তা সোজা চলে যাচ্ছে দহিজুড়ি, সেখান থেকে সোজা গেলে শিলদা মোড় পেড়িয়ে বেলপাহাড়ি। সেই রাস্তাতেই থানা বাঁহাতে রেখে আপনি খানিকটা এগিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলে কাঁকড়াঝোড়। লাগোয়া বিহারের পূর্ব সিংভূম জেলা। আবার বাঁদিকে না ঘুরে বাজার থেকে সোজা চলে গেলে বাঁশপাহাড়ি, চাকাডোবা হয়ে আপনি দু’পাশের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যাবেন ঝিলিমিলি। প্রবেশ করবেন বাঁকুড়া জেলায়। বেলপাহাড়ি থেকে চাকাডোবা হয়ে ঝিলিমিলির দু’পাশের ঘন জঙ্গলই তখন অপেক্ষায় মাওবাদী সভ্যতা বিস্তারের। জনশ্রুতি, এই মেদিনীপুর-বাঁকুড়া সীমানার জঙ্গল ঘেরা ছেন্দাপাথর গ্রামে কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে এখান থেকেই তিনি যান বিহারের মজফফরপুর।
তো এই বেলপাহাড়ির বিভিন্ন গ্রামে নয়ের দশকে মানুষের মধ্যে কীভাবে, কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল প্রথমে এমসিসি এবং পরে জনযুদ্ধ, তা বিস্তারিত বর্ণনা না করেও বোঝা সম্ভব একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলেই।
সেটা ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগের দিন। এবং তখনও পর্যন্ত এরাজ্যে এমসিসি বা জনযুদ্ধের প্রকাশ্য অ্যাক্টিভিটি অলমোস্ট শূন্য। অলমোস্ট বলার কারণ, তার বেশ কিছুদিন আগে চাকাডোবা থেকে ঝিলিমিলি যাওয়ার রাস্তায় একটি কেন্দু পাতার গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তে পুলিশ বুঝতে পারে এমসিসি এই কাজ করেছে। কেন্দু পাতার দাম বৃদ্ধির দাবি তুলে তারা কয়েক বছর ধরেই জনমত তৈরি করছিল। সেটা এই জেলা তো বটেই, সম্ভবত এরাজ্যে এমসিসির বিরুদ্ধে প্রথম নথিভুক্ত মামলা।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল পঞ্চায়েত ভোটের আগের সন্ধ্যায়। বেলপাহাড়ি থানা থেকে বাঁশপাহাড়ি যাওয়ার পথে সিঁদুরিয়া। সেখান থেকে উত্তরে, মানে ডানদিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে একটা খাল, তা পেরিয়ে পরপর গ্রাম তালপুকুরিয়া, পুকুরিয়া। ক্ষুদিরামের আত্মগোপন করে থাকা গ্রাম ছেন্দাপাথর থেকে এই তালপুকুরিয়ার দূরত্ব জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কম-বেশি তিন কিলোমিটার।
পরদিন ভোটের ডিউটি করতে আগের দিন বিকেলে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের দু’জন কনস্টেবল পৌঁছলেন সেই গ্রামের বুথে। গ্রামের লোকজন সন্ধ্যায় তাঁদের খাবার-দাবার দিলেন। গ্রামবাসীরা বাড়ি চলে গেলেন, জঙ্গলে ঘেরা তালপুকুরিয়া গ্রামের বুথে শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন দুই কনস্টেবল। রাত প্রায় নটা, চারদিক নিঝুম, ১৫-২০ জনের একটা সশস্ত্র বাহিনী মুখ ঢেকে হানা দিল বুথে। কোনও মারধোর নয়, গুলি-বন্দুকও না চালিয়ে দুই কনস্টেবলকে স্রেফ ভয় দেখিয়ে দুটো রাইফেল নিয়ে হেঁটে চলে গেল জঙ্গলের মধ্যে। সেটাই রাজ্যে এমসিসি-জনযুদ্ধের উত্থান এবং মাওবাদী আন্দোলন পর্বে পুলিশের বন্দুক ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা। প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের বেলপাহাড়ি থানায় দুই কনস্টেবলের রাইফেল ছিনতাইয়ের খবর পৌঁছল মাঝরাত পেরিয়ে। তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার গৌরব দত্ত। কয়েক বছর ধরে বনপার্টির মুভমেন্টের নানা খবর আসছিল, রাইফেল ছিনতাইয়ের ঘটনায় নড়ে গেলেন জেলা পুলিশের শীর্ষ অফিসাররা। কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ হল না।
পরদিন ভোট। এমনিতেই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল এলাকায়। সেটা প্রাক-ইলেকট্রনিক মিডিয়া যুগ, রাইফেল ছিনতাইয়ের খবরে বিরাট হইচই হল না। পরদিন ভোট মিটতেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্দুক উদ্ধারে। তালপুকুরিয়া থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তিন-চার কিলোমিটার গেলেই বাঁকুড়া সীমানা। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হল, যাতে কোনওভাবেই রাইফেল নিয়ে বিহারে বা বেশি দূরে পালাতে না পারে এমসিসি সদস্যরা। গ্রামে-গ্রামে ব্যাপক তল্লাশি শুরু করল পুলিশ। কিন্তু উদ্ধার হল না রাইফেল। চার-পাঁচদিনের মাথায় পুলিশ সোর্স মারফত খবর পেল, স্থানীয় সিপিআইএম নেতারা হদিশ পেয়েছেন, কার বাড়িতে বন্দুক রাখা আছে। পুলিশ কথা বলল শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে। সিপিআইএম নেতারা জানালেন, গ্রামে খোঁজখবর নিয়ে তাঁরা জানতে পেরেছেন কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে বন্দুক, খোঁজ চলছে। দু’দিন বাদে সিপিআইএমের এক স্থানীয় নেতা পুলিশকে জানালেন, তাঁরা রাইফেল দুটো উদ্ধার করেছেন, কিছুদিন তাঁদের কাছে থাকুক, তারপর পুলিশকে ফেরত দিয়ে দেবেন। আর গ্রামে তল্লাশি চালানোর দরকার নেই। পুলিশ তাড়াতাড়ি বন্দুক ফেরত চাইলে এক সিপিআইএম নেতা জানালেন, আত্মরক্ষার জন্য কয়েকদিন তাঁদের কাছে বন্দুক দুটো থাকুক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিছুদিন বাদে ফেরত দেবেন। অসহায় রাজ্য পুলিশ! এমসিসি’র এক শীর্ষ নেতার স্কোয়াড রাইফেল দুটো ছিনতাই করেছিল, কিন্তু ব্যাপক পুলিশি তল্লাশি শুরু হওয়ায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তারা বিশ্বস্ত একজনের কাছে রাইফেল দুটো লুকিয়ে রাখে। গ্রামে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর হদিশ করে ফেলে সিপিআইএম। কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেও নয়।
এর সাতদিনের মধ্যে জানা গেল, যে সিপিআইএম নেতার কাছে পুলিশের রাইফেল দুটো ছিল, তাঁর বাড়িতে গভীর রাতে হানা দিয়েছে এমসিসি’র বিরাট দল। বন্দুক উঁচিয়ে হাতছাড়া হওয়া রাইফেল দুটো নিয়ে চলে গেল তারা। এবারও রক্তপাত হল না। কিন্তু যাঁরা বোঝার তাঁরা বুঝলেন, সাংগঠনিকভাবে সিপিআইএমের সঙ্গে লড়াই করার মতো জনভিত্তি তৈরি করে ফেলেছে এমসিসি। অন্তত বেলপাহাড়ির কিছু গ্রামে। স্থানীয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খবর না পেলে কিংবা তাদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে না পারলে, কীভাবে ডাকাবুকো সিপিআইএম নেতার বাড়িতে চড়াও হয়ে বিনা বাধায় রাইফেল পুনরুধার করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে তখন অবশ্য কোনও সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক রিভিউ করেনি মহাকরণ বা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। রাজ্যের শাসক দলের কাছে তখনও এমসিসি-জনযুদ্ধের পরিচয়, তারা বনপার্টি। গ্রামে ঘুরে গান করে, সচেতনতামূলক নাটক করে! দু’একজন পুলিশ অফিসার শীর্ষ কর্তাদের সতর্ক করেছিলেন অবশ্য। কিন্তু স্থানীয় অফিসাররা অকারণে ভয় পাচ্ছেন বলে এই সাবধানবাণী উড়িয়ে দিয়েছিলেন জেলা এবং রাজ্যস্তরের দু’একজন শীর্ষ আইপিএস অফিসার। সেই ঘটনায় পরে আসব।
আপাতত বেলপাহাড়ি থেকে চট করে একবার যেতে হবে ঝাড়গ্রাম। সেখানে অপেক্ষা করছেন কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তাঁর বয়ান নিয়েই ব্যাক টু বেলপাহাড়ি। রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। এই দীর্ঘ লেখা যাঁরা পড়ছেন এবং যাঁদের এই হঠাৎ কথাবার্তা নেই বেলপাহাড়ি ছেড়ে ঝাড়গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে না, তাঁরা এতদিনে জেনেই গিয়েছেন, এই লেখকের এক জায়গায় টানা বসে থাকার হ্যাবিট নেই। এই লালগড়, তো এই জামবনি, এই বেলপাহাড়ি, তো এই ঝাড়গ্রাম!

স্নেহাশিস ভকত, প্রসূন ষড়ঙ্গী এবং শিবরাম মুর্মু 

কিষেণজি মৃত্যু রহস্যে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অযথা সাক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়ে পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়াও অর্থহীন। যদিও ছ’য়ের দশকের শেষে রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে শুরু হওয়া নকশাল আন্দোলন, তার পরম্পরা, ঝাড়খন্ড পার্টির উত্থান, তাকে সিপিআইএমের মোকাবিলা এবং শেষমেশ শাসক-বিরোধীর মধ্যে নৃশংস খুনোখুনি এবং সংঘর্ষ। এরপর এমসিসি’র প্রবেশ এবং নানান ঘটনা জানতে হয়তো আরও অনেকের সঙ্গেই কথা বলা যেত। কারণ, ২০১১ সালের নভেম্বরে জামবনিতে কিষেণজির মৃত্যু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে এই এলাকার প্রায় অর্ধ শতকের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বহু জানা-অজানা কাহিনি। কেন কিষেণজি এ’রাজ্যে এলেন, কোন পরিস্থিতিতে তাঁদের আন্দোলন একুশ শতকের গোড়ায় এত স্থানীয় মানুষের সহানুভুতি এবং সমর্থন পেল এবং কী কারণেই বা তিনি জনবিচ্ছিন্ন হলেন, যার জন্য কুশবনির সেই ব্যক্তি ২০১১ সালের নভেম্বরের এক সন্ধ্যায় মেদিনীপুর শহরে পুলিশ সুপারের অফিসে ছুটে গিয়েছিলেন মাওবাদী নেতার মৃত্যুবান নিয়ে, সমস্ত প্রশ্নই প্রাসঙ্গিক এই রহস্য সমাধানে। একই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত বদলও।
লালগড় আন্দোলনের মধ্যেই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত বদলাতে শুরু করেছিল। খাতায় কলমে রাজ্যে সরকার বদল হল ২০১১ সালের ১৩ মে। কিন্তু অন্যান্য জায়গার মতো জঙ্গলমহলেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব বিস্তার শুরু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে। ২০০৯ লোকসভা ভোটের পর ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, বিনপুরেও এই বার্তাই স্পষ্ট হয়ে উঠল, পুলিশ সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি, মাওবাদী, বিজেপি, কংগ্রেস, ঝাড়খন্ড পার্টি, যেখানেই যে থাকুক না কেন, সিপিআইএম বিরোধী লড়াইয়ের পেটেন্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। তৃণমূল কংগ্রেসই তখন এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিল জামবনির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতা বাসুদেব ভকতের পরিবারের সঙ্গে সেখানকারই কংগ্রেসি জোতদার-জমিদার মোহিনী মোহন ষড়ঙ্গীর উত্তরাধিকারীকে। আর ত্রিবেণী সঙ্গমের মতো সেই মিলনস্থলে এসে হাজির হল ছোট্টবেলায় মাকে হারানো, চরম দারিদ্রে বেড়ে ওঠা রামজীবন মুর্মুর একমাত্র ছেলে শিবরাম। কোন অভিন্ন কর্মসূচির ওপর দাঁড়িয়ে বাসুদেব ভকতের ভাইয়ের ছেলে স্নেহাশিস, সিপিআইএম বাহিনীর হাতে খুন হওয়া মোহিনী মোহন ষড়ঙ্গীর ছেলে প্রসূন এবং শিবরাম মুর্মুর মধ্যে কীভাবে গড়ে উঠল এই জটিল ঐক্য, তাও জঙ্গলমহলের নানান বিচিত্র কাজ-কারবারের মতোই কম আশ্চর্যের নয়। অথচ, না রাজনৈতিক, না অর্থনৈতিক, কোনও মিলই তো ছিল না এই তিন পরিবারের মধ্যে। কিন্তু সিপিআইএম পরিবারের স্নেহাশিস ভকত, কংগ্রেসি পরিবারের প্রসূন ষড়ঙ্গী এবং ঝাড়খন্ডি আবহে বেড়ে ওঠা আদিবাসী যুবক শিবরাম মুর্মু যেদিন সমস্ত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতিগত ফারাক ভুলে একই সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জঙ্গলমহলে তৃণমূল কংগ্রেসের ঝাণ্ডা তুলে ধরলেন, সেদিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল দুটো জিনিস।
প্রথমত, ঝাড়গ্রাম মহকুমার রাজনৈতিক মানচিত্রে সিপিআইএমের কক্ষচ্যূত হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। দ্বিতীয়ত, সিপিআইএম সরকার পতনের পর কিষেণজিরও এই এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন হওয়া প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অনিবার্য। কিন্তু কেন, সেই প্রসঙ্গে আসার জন্যই বেলপাহাড়ি থেকে ফিরতে হল ঝাড়গ্রামে।
লালগড় আন্দোলন শুরুর পর জঙ্গলমহলে সিপিআইএম বিরোধিতার স্টিয়ারিং কিষেণজির নেতৃত্বে মাওবাদীদের হাতে ছিল ঠিকই, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা চলে যেতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। তীব্র মেরুকরণের প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াইয়ের নেতৃত্ব থাকে একজনেরই হাতে। তা কখনও যৌথ হয় না। ২০১০ সালের শুরু থেকেই জঙ্গলমহলে এই নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্বের সংঘাত শুরু হয়েছিল মাওবাদীদের সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত মাওবাদীদের অস্ত্রের সামনে তৃণমূল নেতারা এলাকার নেতৃত্ব হাতে তুলে নিতে পারেননি। কিন্তু মে মাসে সরকার বদলের পর ঝাড়গ্রাম, জামবনি, লালগড়, বেলপাহাড়িতেও তৃণমূল কংগ্রেস শাসকের ভূমিকায় চলে এল। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার শুরু করল। সাধারণ সিপিআইএম বিরোধী তো বটেই, গোঁড়া সিপিআইএম, ঝাড়খন্ডি কিংবা আদি কংগ্রেস পরিবারও যখন তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরল, মুঠো আলগা হতে শুরু করল মাওবাদীদের।
তাই কিষেণজির মৃত্যু রহস্যের খোঁজ করতে গিয়ে এই জটিল ধাঁধারও সমাধান জরুরি যে, কোন ম্যাজিকে সিপিআইএম, ঝাড়খন্ডি এবং কংগ্রেসি পরিবার একসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেয়। কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের শেষ পর্যায়ে সাক্ষী পরপর তিনজন। বুদ্ধদেব এবং বাসুদেব ভকতের ভ্রাতুষ্পুত্র স্নেহাশিস ভকত, বাসু ভকত বাহিনীর হাতে খুন হওয়া মোহিনী ষড়ঙ্গীর ছেলে প্রসূন ষড়ঙ্গী এবং রামজীবনের ছেলে শিবরাম মুর্মু। ২০১৭ সালের জুন মাসে কথা বললাম তিনজনের সঙ্গে।
স্নেহাশিস ভকত 

‘আমার দাদু নরসিংহ দাস ভকত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। কলকাতায় বাড়ি ছিল। ১৯১৬ সালে পুলিশের তাড়া খেয়ে দাদু কলকাতা থেকে পালিয়ে এলেন মেদিনীপুরে। জেঠু, বাবার মুখে শুনেছি, মেদিনীপুরে থাকার সময় ১৯২০-২২ সালে চিল্কিগড়ের রাজাদের কাছ থেকে দাদু ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ১৫০ বিঘে জমি কিনেছিলেন জামবনির চুটিয়া গ্রামে। কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে দেন। তারপর চুটিয়াতেই থাকতে শুরু করেন।
নরসিংহ ভকতের এক মেয়ে, চার ছেলে। মেয়ে বড়, শক্তিরানী ভকত। তারপর পরপর চার ছেলে বীরেন্দ্রনাথ ভকত, বুদ্ধদেব ভকত, বাসুদেব ভকত এবং সুনির্মল ভকত। জামবনিতে এসেও দাদু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। কংগ্রেস করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কংগ্রেসেই ছিলেন। রাজনীতিতে আমাদের পরিবারে প্রথম উলটো রাস্তায় হাঁটলেন আমার জেঠু বুদ্ধদেব ভকত, তারপর বাসুদেব ভকত। বুদ্ধদেব ভকত এবং বাসুদেব ভকত সিপিআইএম করতে শুরু করলেন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার হওয়ার পর বুদ্ধ ভকতের সঙ্গে বাসুদেব ভকতের রাজনৈতিক কিছু বিষয় নিয়ে মতের অমিল হল। বুদ্ধদেব ভকত তখন সিপিআইএমের ঝাড়গ্রাম জোনাল কমিটির সম্পাদক। পার্টির কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই ভাইয়ের মতবিরোধ হল। বাসুদেব ভকত সিপিআইএম ছেড়ে দিলেন। শুধু ছাড়লেনই না, নির্দল ক্যান্ডিডেট হয়ে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়িয়ে গেলেন। জামবনি ব্লকের ৯ নম্বর অঞ্চলে কেনডাঙড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে সরাসরি লড়াই হল নির্দল বাসুদেব ভকত এবং তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে সিপিআইএমের। বাসুদেব ভকতের তখন এতটাই জনভিত্তি ছিল, নির্দল প্রতীক নিয়ে সিপিআইএমকে হারিয়ে কেনডাঙড়ি পঞ্চায়েত দখল করলেন এবং নিজে প্রধান হলেন। এটা ১৯৭৮ পঞ্চায়েত ভোটের কথা। এর পরই জেলার সিপিআইএম নেতারা বুঝলেন, বাসু ভকতের যা সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং জনভিত্তি, জামবনি হোক বা ঝাড়গ্রাম, তাঁকে দলের বাইরে রেখে কিছু করা যাবে না। ওই পঞ্চায়েত ভোটের কিছুদিন বাদে জেলার সিপিআইএম নেতারা তাঁর সঙ্গে কথা বলে ঝামেলা মিটমাট করে নিলেন। বাসুদেব ভকত সিপিআইএমে ফিরে গেলেন। বড় জেঠু বীরেন্দ্রনাথ ভকত কিংবা আমার বাবা সুনির্মল ভকত অবশ্য কোনও দিন রাজনীতি করেননি।’ কথা হচ্ছিল স্নেহাশিস ভকতদের ঝাড়গ্রাম শহরের বাড়িতে বসে। জামবনির চুটিয়া গ্রামে এখনও বাড়ি আছে, কিন্তু বুদ্ধদেব ভকত, বাসুদেব ভকতদের পরিবারে বহুদিন ঝাড়গ্রাম শহরে থাকেন।
‘কিন্তু আপনার এক জেঠু দশ বছরের এমএলএ, আর এক জেঠু জামবনি, ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমের দাপুটে নেতা। এই পরিবারে বড় হয়ে আপনারা সিপিআইএম ছাড়লেন কেন? তৃণমূল কংগ্রেসে কেন গেলেন?’ প্রশ্ন করলাম স্নেহাশিসকে।
‘এই কথাতেই আমার আপত্তি। আপনারা বাসুদেব ভকতকে দাপুটে নেতা বলেন কেন? তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিল। খুনের পরদিন লক্ষ মানুষের জমায়ত হয়েছিল জামবনিতে। জানতে চাইছেন কেন সিপিআইএম ছাড়লাম? তাঁর খুনেরও তো কিনারা হল না। খুনের দিন দুপুরে জেঠুকে মেদিনীপুর শহর থেকে ফোন করে দলের এক প্রথম সারির নেতা বলেছিলেন, সঙ্গে বন্দুক না রাখতে। তিনি কেন বলেছিলেন এই কথা? সঙ্গে বন্দুক, নিরাপত্তা রক্ষী থাকলে জেঠুকে হয়তো খুন হতে হোতও না। আসলে জেঠুর জনপ্রিয়তা যেভাবে ঝাড়গ্রামে বাড়ছিল, জেলার অনেক নেতাই তা সহ্য করতে পারছিলেন না। সেটাও তো তাঁর খুনের একটা কারণ হতে পারে।’
‘আপনি বলতে চাইছেন সিপিআইএমের লোকই চাইছিল বাসু ভকত খুন হয়ে যান? তাই তাঁকে বিপদে ফেলতে অস্ত্র সরাতে বলেছিলেন? কিন্তু তা কী করে হয়?’
‘দেখুন, আমি সরাসরি তা বলছি না। কিন্তু ঝাড়গ্রামে বাসুদেব ভকত, বুদ্ধদেব ভকতদের প্রভাব পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতারা যে মানতে পারছিলেন না, তা তো জেলা সিপিআইএমের সবাই জানে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও জানত সব কিছু। বাসু ভকতের খুনের এক-দেড় বছর পর বুদ্ধ ভকতও সিপিআইএম ছেড়ে দিলেন। পার্টি মেম্বারশিপ আর রিনিউ করেননি।’
‘কেন?’
‘সিপিআইএম জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের জন্য। বাসু ভকত, বুদ্ধ ভকতের জনপ্রিয়তা, প্রভাবকে ভয় পেতেন দীপক সরকার। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় পার্টি ছিল বাসু ভকতের নিয়ন্ত্রণে। তিনি দীপক সরকারের সব কথা শুনতেনও না। নিজের মতো চলতেন। জেলার নেতারা দেখছিলেন, এভাবে বেশিদিন চললে এলাকার পার্টির ওপর তাঁদের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাই বাসু ভকতের খুনের পর বুদ্ধ ভকতকে দলে কোণঠাসা করার কাজ শুরু হল। বুদ্ধ ভকত দলই ছেড়ে দিলেন।
আমার দাদা ছিল সৌমেন। সৌমেন ভকত। নিজের দাদা। সিপিআইএম করত। তারও আগে কলেজে এসএফআই করত। কিন্তু আমাদের পরিবারের ওপর দীপক সরকার গোষ্ঠীর এই আচরণ দেখে দাদা ঠিক করল এর বদলা নেবে। সিপিআইএম ছেড়ে জামবনি গণতান্ত্রিক উন্নয়ন মঞ্চ তৈরি করল দাদা। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে দাদা ফোন করল সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে। দীপক সরকারদের সমস্ত কার্যকলাপ জানাল। তারপর বলেছিল, বুদ্ধ ভকতকে ভোটে নির্দল হিসেবে ক্যান্ডিডেট করবে। সিপিআইএমের মুখোশ খুলে দেবে। বিমান বসু বললেন, রাগের মাথায় কিছু না করতে। বিমানবাবু টেলিফোনে দাদাকে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের পরিবারের প্রতি অনেক অবিচার হয়েছে। তুমি বুদ্ধকে বোঝাও এই সব না করতে। সূর্যকান্ত মিশ্র, দীপক সরকার তোমাদের বাড়ি যাবে সব ঝামেলার সমাধান করতে।’’ এর কয়েকদিন পরে সূর্যকান্ত মিশ্র আর ডহর সেন আমাদের বাড়িতে এলেন। জেঠুকে বললেন, ‘‘বিমানদা পাঠিয়েছেন। ক্ষোভ-বিক্ষোভ যা আছে ছাড়ুন। মেম্বারশিপ রিনিউ করুন।’’ কিন্তু জেঠু রাজি হলেন না।
এর কয়েক দিন পরে বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ফোন করে জেঠুকে ডেকে পাঠালেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। বুদ্ধ ভকত কলকাতা গেলেন। সেখানে বিমান বসুরা বললেন, ‘‘দীপকের সঙ্গে তো তোমার গোলমাল হচ্ছে, তুমি ঝাড়গ্রাম ছেড়ে দাও। ওড়িশায় গিয়ে হোলটাইমার হিসেবে পার্টি কর।’’
‘কী বলছেন? দীপক সরকারের সঙ্গে গোলমাল হচ্ছে বলে তা না মিটিয়ে বুদ্ধ ভকতকে ওড়িশায় চলে যেতে বলল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট? কী করলেন উনি?’
‘কী আর করবেন? আমরা বুঝতে পারলাম আলিমুদ্দিন দীপক সরকারের পাশেই আছে। উনি বললেন, ‘‘এই বয়সে ওড়িশায় যাওয়া সম্ভব নয়। এর পর থেকেই সিপিআইএমের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সব সম্পর্ক শেষ। জেঠুর বয়স হয়েছিল, বাড়িতে বসে গেলেন। কিন্তু দাদা ছাড়ল না। দাদা পুরো ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল। দীপক সরকার এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। জামবনির যে কেনডাঙড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৯৭৮ সালে নির্দল হয়ে লড়েছিলেন বাসু ভকত, ৩০ বছর পর ২০০৮ পঞ্চায়েত ভোটে সেখানেই নির্দল হিসেবে লড়ল দাদা। সরাসরি সিপিআইএমের বিরুদ্ধে। গ্রাম পঞ্চায়েতের আটটা আসনের মধ্যে দাদার নেতৃত্বে নির্দলরা জিতল পাঁচটা সিটে, তিনটে সিট জিতল সিপিআইএম। বাসু ভকতের মতোই দাদা নির্দল হিসেবে পঞ্চায়েত প্রধান হল। এর পরেই জামবনিতে দাদার জনপ্রিয়তা, প্রভাব বাড়তে শুরু করে। ২০০৮ সালের মে মাসে যখন পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল তখনও কিন্তু লালগড় আন্দোলন শুরু হয়নি। সিপিআইএমের বিরুদ্ধে তীব্র জনমতও গড়ে ওঠেনি। তখন কিন্তু দাদা এখানে একাই সিপিআইএমকে হারিয়ে দিয়েছিল।
২০০৯ সালের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হিসেবে ঝাড়গ্রামে এলেন। দাদা তাঁর সঙ্গে দেখা করল। তিনি দাদাকে বলেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিতে। এরপরই দাদা পুরোপুরি তৃণমূল করতে শুরু করে। সারাদিন পঞ্চায়েতে কাজ করত। মোটর সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে।’
২০১৭ সালের মাঝামাঝি যখন ঝাড়গ্রামের বাড়িতে বসে স্নেহাশিস ভকত সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় ৩০। স্নেহাশিসের মুখে তাঁর পরিবার, সিপিআইএমের সঙ্গে লড়াই-ভালোবাসার নানান ঘটনা থেকে শুরু করে একটা আপাদমস্তক সিপিআইএম পরিবারের তৃণমূল কংগ্রেসে বিবর্তনের ইতিহাস শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, সত্যিই বড়ো বহুমাত্রিক এই ঝাড়গ্রাম মহকুমার প্রতিটা বাঁক। লালগড়, বেলপাহাড়ির ঘন জঙ্গলেও তবু হারানো রাস্তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু এখানকার রাজনৈতিক টানাপোড়েন, লড়াই, সংঘর্ষ এবং রক্তপাতের বিভিন্ন জটিল রহস্য পুরোপুরি উদ্ধার করা কি আদৌ সম্ভব আমার মতো সাধারণ লোকের পক্ষে? সাধ থাকতে পারে, কিন্তু সাধ্যে কুলোবে কি?
‘আপনার দাদা তো তৃণমূল কংগ্রেস করতে শুরু করল। তারপর? জিজ্ঞেস করলাম স্নেহাশিসকে।
‘ভালোই চলছিল সব। আমাদের পরিবার এবং আমার দুই জেঠুর দীর্ঘ রাজনৈতিক কাজকর্মের একটা প্রভাব জামবনি, ঝাড়গ্রামে ছিলই। দাদাও তার সূত্র ধরে কয়েক মাসের মধ্যে যথেষ্ট পরিচিতি তৈরি করে ফেলেছিল। সিপিআইএমও তখন অনেকটা কোণঠাসা হতে শুরু করেছে। পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব বাড়তে শুরু করে জঙ্গলমহলে। দাদার পরিচিতি যুক্ত হল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে। ২০০৯ সালজুড়ে জঙ্গলমহলে যে খুনোখুনির পরিবেশ ছিল তা থেকে বেরোতে চাইছিল এখানকার মানুষ। কিন্তু মাওবাদীদের ভয়ে প্রায় সব দলেরই রাজনৈতিক কাজকর্ম এক রকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দাদা তৃণমূলে যোগ দিয়ে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করে দিল। আর তারই চড়া মাশুল দিতে হল। ২০১০ সালের মাঝামাঝি খুন হয়ে গেল দাদা।

 

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৫

 

১১ জুলাই ২০১০, দাদা পঞ্চায়েতের কাজ দেখতে ফুলবেড়িয়া গ্রামে গিয়েছিল। মোটরসাইকেল চালিয়ে। একাই। রাস্তা থেকে মাওবাদীরা তুলে নিয়ে গেল দাদাকে। গুলি করে, গলা কেটে খুন করল। পরদিন দাদার মৃতদেহ পাওয়া গেল।’
একটাই শেষ প্রশ্ন করার ছিল ঝাড়গ্রাম, জামবনির বুদ্ধদেব ভকত, বাসুদেব ভকতের পরিবারের উত্তরাধিকারীকে। ‘অনেকে বলে বাসুদেব ভকতের অত্যাচার এবং একাধিপত্যের জন্যই এই এলাকায় বহু মানুষ সিপিআইএম বিরোধী হয়েছে। সেই পরিবার কিনা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ নিল শেষমেশ?’
‘কে বলে? কারা বলে? তারা সংখ্যায় কতজন? তারা জানে যত লোক বাসু ভকতের বিরোধী ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষ তাঁর পাশে ছিল? সেই কারণেই তাঁর এই জনপ্রিয়তা মানতে পারছিলেন না জেলার সিপিআইএম নেতারা। আপনি জানেন, যে পার্টির জন্য বাসু ভকত বাড়ি, পরিবার সব ছেড়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর কেউ খোঁজ পর্যন্ত করতে আসেনি। জামবনিতে সাধন দণ্ডপাট নামে একজনের বাড়িতে সিপিআইএমের পার্টি অফিস ছিল। বাসু ভকত সেই পার্টি অফিসে থাকতেন। বিয়ে করেননি। পার্টির জন্য পরিবার ছেড়েছিলেন। বছরে হয়তো এক-দু’বার বাড়ি আসতেন নিজের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। যে পার্টি অফিসে থাকতেন সেখানে তিনটে আলমারিতে জেঠুর সব জিনিসপত্র ছিল। ব্যক্তিগত কাগজপত্র, বাড়ির জমির কাগজ। ঠাকুমা জেঠুকে সোনার আংটি, চেন দিয়েছিলেন। জেঠু কোনও দিন পরেননি। জেঠু মারা যাওয়ার তিন-চারদিন বাদে সিপিআইএমের দু’জন বাড়িতে এল। দুটো পুটলির মধ্যে জেঠুর কিছু প্যান্ট, জামা আর একটা কম্বল নিয়ে। বুদ্ধ জেঠু তখন বাড়িতে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বাসুর সব জিনিসপত্র কোথায়? ঘড়ি, চেন, আংটি, কাগজপত্র?’’ ওরা বলল, ‘‘আমরা কিছু জানি না। আমাদের এইগুলোই পৌঁছে দিতে বলেছে।’’
এই তো সিপিআইএম পার্টি! আর আপনি বলছেন, দাদা কেন তৃণমূল হল? আমি কেন সিপিআইএম বিরোধী হলাম? বুদ্ধদেব ভকত কেন পার্টি ছাড়লেন? পার্টি জানে, যে বুদ্ধ ভকত দু’বারের বিধায়ক, তাঁর ছেলে মাদার ডেয়ারির দুধ বিক্রি করে? স্ত্রী প্যারালাইজড?’
যে পরিবার বছরের পর বছর যে রাজনীতি করেছে, তাদের উত্তরাধিকারীরা কেন উলটো রাস্তা ধরল, তাই জানতে গিয়েছিলাম বুদ্ধ ভকত, বাসু ভকতদের বাড়িতে। কিন্তু সাক্ষীই যদি পালটা প্রশ্ন করতে শুরু করেন, যার জবাব আমার জানা নেই, তবে তো আর সাক্ষ্য নেওয়ার মানে হয় না।

চলবে 

(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)

Comments are closed.