কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৯

গোপীবল্লভপুরের মোরগ লড়াই 

জঙ্গলমহলে প্রথমবার গিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে। এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি, আজকাল পত্রিকা থেকে ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের প্রিভিউ করতে ঝাড়গ্রাম গিয়েছিলেন সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম আমি। ছিলাম ঝাড়গ্রাম জেলের ঠিক পিছনে ডুলুং নামের এক ছোট হোটেলে। সেই সময় ঝাড়গ্রামে আর বেশি হোটেলও ছিল না। যেদিন দুপুরে ঝাড়গ্রাম পৌঁছালাম, সেদিনই বিকেলে গেলাম গোপীবল্লভপুর। কেন জামবনি, বিনপুর ছেড়ে গোপীবল্লভপুর বেছেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, এত বছর বাদে মনে নেই। হয়তো গোপীবল্লভপুরের নকশাল আন্দোলনের ইতিহাসের কথা ভেবে। তখনও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়িস্ট তৈরি হয়নি, সেই সময় জামবনি, বেলপাহাড়ি, বিনপুরে এমসিসি-জনযুদ্ধের আন্দোলনও সেভাবে শুরু হয়নি। তখন তো লালগড়ের নামও জানতেন না অনেকে।
১৯৯৮ এর এপ্রিল মাসের কাঠফাটা গরমে বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ পৌঁছেছিলাম গোপীবল্লভপুরে। সেদিন সন্ধ্যায় সিপিএমের কোনও জনসভা ছিল পঞ্চায়েত ভোটের জন্য। দেখেছিলাম আপাদমস্তক লাল পতাকায় মোড়া গোপীবল্লভপুর। রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের এই রুক্ষ এলাকায় মানুষমাত্রই জানতেন, নয়ের দশকের শেষে গোপীবল্লভপুর মানে কী? তখন গোপীবল্লভপুর মানে সিপিএমের বাধাহীন আধিপত্য। লোকসভা, বিধানসভা ভোটে তাও বিরোধী দলের কিছু ফ্ল্যাগ, পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে সিপিআইএম তখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
গোপীবল্লভপুরে কাজকর্ম করতে করতেই রাস্তার ধারে হাট দেখে গাড়ি থামিয়েছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, একটা এলাকার, সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝার আসল জায়গার নাম বাজার। সাধারণ মানুষের কেনাকাটা, জিনিসপত্রের দাম, দোকানদারের চেহারা, ক্রেতা-বিক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা দেখে মানুষের স্বভাব-চরিত্র, জীবনবোধ বোঝার চোখ ছিল তাঁর। আর ছিল বিভিন্ন পেশার নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলার অসম্ভব কৌতুহল। সেই কারণেই সেদিন রাস্তার ধারের হাট দেখে নেমে পড়েছিলেন গাড়ি থেকে।
সেই হাটে বাজার করতে আসা সাধারণ মানুষ রাজনীতি নিয়ে, জীবন-জীবিকা নিয়ে ঠিক কী বলেছিলেন, সব মনে নেই এত বছর বাদে। তবে মনে আছে, সেই হাটের ঠিক পাশে দেখেছিলাম একটা গোল মতো ভিড়। আর সেই ভিড় থেকে চিৎকার আসছে ক্ষণে-ক্ষণে। এগিয়ে গিয়ে দেখি, মোরগ লড়াই হচ্ছে। বিশ-পঞ্চাশজন বা আরও বেশি মানুষের ভিড়টা গোল করে ঘিরে আছে একটা ছোট্ট জায়গা। তার ভেতরে দুটো মোরগ, পায়ে ব্লেড বা ছোট ধারাল ছুরি বাঁধা, ঝাঁপিয়ে পড়ছে একে অন্যের ওপর। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক যুদ্ধ-প্রস্তুত মোরগ। নিজের নিজের মালিকের কাছে। আমাদের শহুরে চোখ, দেখার অভ্যাস নেই, তাই বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনি সেই মোরগ লড়াইয়ের দিকে। একটা হিংস্রতা আছে এই লড়াইয়ের মধ্যে। দুটো তাগড়াই চেহারার মোরগ রক্তাক্ত হচ্ছে, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে ব্লেডের ঘায়ে। লড়াইয়ের নিয়ম এক কথায় খুবই সিম্পল। লড়তে লড়তে যে মোরগটা সম্পূর্ণ ঘায়েল হয়ে পড়বে বা মরে যাবে সেটি পাবে জেতা মোরগের মালিক। আর গোল হয়ে ঘিরে যে ভিড়টা এই লড়াই দেখছে, সে এক-দু’টাকা করে বাজি ধরছে কোনও একটা মোরগের ওপর। জেতা মোরগের ওপর বাজি ধরলে টাকা জিতবে লড়াই শেষে।
সেদিন দেখেছিলাম, পাঁচ থেকে পনেরো-কুড়ি মিনিট চলে এক একটা লড়াই। লড়াই শেষে যুদ্ধে জেতা মোরগের মালিক নিজের জখম, রক্তাক্ত এবং প্রতিপক্ষের মৃত বা মৃতপ্রায় মোরগকে কাঁধে নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। ভালো করে দেখবেও না, নিজের মোরগ জিতেছে বটে, কিন্তু হেরে যাওয়া মৃত বা মৃতপ্রায় মোরগের থেকে খুব কম ক্ষত-বিক্ষত হয়নি। পরাজিত মোরগের থেকে কম রক্তাক্ত হয়নি জেতা মোরগটা।
২০০৬ সাল থেকে অ্যাসাইনমেন্টে জঙ্গলমহলে গিয়েছি বারবার। আর যতবার গিয়েছি জঙ্গলমহলের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে, যতবার দেখেছি মাওবাদীদের হাতে সিপিআইএম নেতা-কর্মী বা একেবারে সাধারণ মানুষের খুনের ঘটনা, ততবারই শুধু মনে পড়েছে ১৯৯৮ সালে এপ্রিলের লম্বা বিকেলে গোপীবল্লভপুরের হাটে দেখা সেই মোরগ লড়াইয়ের কথা। পায়ে ব্লেড, ছুরি বেঁধে তাগড়াই দুটো মোরগ লড়তে নামছে, রক্তাক্ত হচ্ছে, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। শেষমেশ পরিণাম দু’জনেরই এক। হেরে যাওয়া মোরগটাকে কেটে রান্না হবে সেদিনই রাতে, জিতলে আজ হয়তো বেঁচে গেল সেটা! হয়তো আজকের জেতা মোরগটাকে কেটে রান্না করার পালা আসবে এক বা দু’সপ্তাহ বাদে! ওই ক্ষত নিয়ে আর কতদিনই বা বেঁচে থাকা সম্ভব?
জঙ্গলমহলের এই গরিব, আদিবাসী মানুষগুলো এভাবেই রক্তাক্ত হচ্ছিল, খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছিল সিপিএম-মাওবাদীদের ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের মাঝে পড়ে। যা চরমে উঠল ২০০৮ সালে লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর।
২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে ২ তারিখ শালবনিতে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের কনভয়ে বিস্ফোরণের পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জঙ্গলমহলে ধারাবাহিকভাবে কী ঘটেছে, তা এই লেখায় খুব একটা আনতে চাইনি আমি। তার কারণ প্রধানত দুটো।
প্রথমত, ২০০৮ সালের শেষ থেকে লালগড় আন্দোলন, রাজ্যে সিপিআইএম সরকার বদল এবং শেষমেশ কিষেণজির মৃত্যু, এই সমস্ত ঘটনাই বহুল প্রচারিত এবং গোটা মাওবাদী আন্দোলনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র বলেই আমি মনে করি। আমি এও বিশ্বাস করি, যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপটে মাওবাদী আন্দোলন ঝাড়গ্রাম মহকুমায় শুরু হয়েছিল এবং যে ব্যপ্তিতে পৌঁছেছিল, তার একটা পর্যায় শেষ হয়েছে কিষেণজির মৃত্যুতে। এর আর পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। আগামী দিনে, দশ-বিশ-ত্রিশ বছর কিংবা তারও পরে এরকম বা এর থেকে বড়ো বা ছোট আকারে কোনও আন্দোলন হবে কিনা তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বানীর মানে হয় না। কিন্তু এটা নিশ্চিত, এই আন্দোলনের ইতি ২০১১ সালে রাজ্যে সিপিআইএম সরকারের পতন এবং কিষেণজির মৃত্যুতে। এবং আমার মতে লালগড় আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার ছিল না। আটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই ঝাড়গ্রাম মহকুমায় এলাকার রাজনৈতিক দখলকে কেন্দ্র করে লাগাতার সংঘর্ষে জড়িয়েছে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টি। সেই লড়াইটাই একুশ শতকের শুরু থেকে কনভার্ট করেছে সিপিআইএম এবং মাওবাদীর লড়াইয়ে। সিপিআইএমের শক্তিবৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আধারেই লুকিয়ে ছিল মাওবাদীদের প্রভাব বিস্তারের উপাদান। সিপিআইএমের বিরুদ্ধে অত্যাচারের যত অভিযোগ উঠেছে, ততই মাওবাদীদের রাজনীতি জঙ্গলমহলে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সিপিআইএমের বিরোধিতা করাই এলাকার বহু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে মাওবাদীদের। আমার বিশ্বাস, লাগাতার এই সিপিআইএম-মাওবাদীদের লড়াইয়ের একটা পরম্পরা লালগড় আন্দোলন, যা হঠাৎ করে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়নি। এই আন্দোলন শুরুর অবজেকটিভ কন্ডিশন বা বাস্তব সহায়ক পরিস্থিতি একটা ছিলই। তাই লালগড় আন্দোলন চলাকালীন রোজকার মিটিং-মিছিল, মাওবাদীদের লাগাতার খুন করা, সিপিআইএমের পাল্টা ক্যাম্প তৈরি এবং সরাসরি দু’দলের সংঘর্ষ বা পুলিশ-আধা সামরিক বাহিনীর একাধিক অপারেশনের বিবরণ লিখতে আমি চাইনি। চেয়েছি লালগড় আন্দোলন এবং মাওবাদীদের ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধির কারণ খুঁজতে। কোন পরিস্থিতিতে, কেন মাওবাদীরা পায়ের তলার জমি এত শক্ত করতে পারল যার জন্য লালগড় আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যেতে পারল আড়াই বছর, সেই কারণই খুঁজতে চেয়েছি আমি। আর এই আন্দোলনের নেতা কিষেণজির মৃত্যুর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার রহস্য।
দ্বিতীয়ত, কিষেণজি যতই লালগড় আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় নকশালবাড়ি’ বলে আখ্যা দিন না কেন, প্রথম যুক্তফ্রন্ট আমলে দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়িতে যে আন্দোলন ছ’য়ের দশকের শেষে শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে ২০০৮-০৯ সালে ঝাড়গ্রামে মাওবাদী শক্তি প্রদর্শনের কোনও সম্পর্ক ছিল না। তার কারণ, মৌলিক। নকশালবাড়ি আন্দোলন মূলত কৃষকের জাগরণ, যা ছিল জোতদার, জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে। তা দার্জিলিং জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার চা বাগানের বঞ্চিত শ্রমিকদেরও প্রভাবিত করেছিল। সেই আন্দোলনকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রামে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন নেতৃত্ব। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক লড়াই। এর কোনও বাস্তব উপাদানই ২০০৮-০৯ কিংবা ২০১০ সালে ছিল না লালগড়কে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম মহকুমার কিছু এলাকায়। নিরন্ন, ভূমিহীন কৃষকের কোনও শ্রেণি সংগ্রাম ছিল না একুশ শতকের প্রথম দশকে লালগড় আন্দোলন। সেখানে যুক্ত ছিল না উদার অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রায় বিশ বছর বাদে আরও বৈষম্যের মুখে পড়া কৃষক-শ্রমিকের মৌলিক দাবিদাওয়া। কৃষক-শ্রমিকের রাজনৈতিক দাবি না হোক, অন্তত অর্থনৈতিক স্বল্পমেয়াদী দাবিও লালগড় আন্দোলনে তোলেননি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়িস্টের পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজি। লালগড় আন্দোলন ছিল মূলত পুলিশের কিছু অতিসক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া। এবং দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গলমহলে সিপিআইএমের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি গ্রামের কিছু মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। তার সঙ্গে এটাও ঠিক, গ্রামের মানুষকে এই ঐক্যবদ্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বন্দুকের নলকে, সাংগঠিক শক্তিবৃদ্ধিকে নয়। আর সেই কারণেই সংগঠন বৃদ্ধির নামে যে বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন কিষেণজি, তার প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল যথেচ্ছ হত্যা চালিয়ে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করা। কিষেণজি নিজে যাই দাবি করুন না কেন, তাঁর প্রশ্রয়ে যে বাহিনী লালগড়, সারেঙ্গা, গোয়ালতোড় থেকে জামবনির গ্রামে কিছু মাসের জন্য চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাকে গণমিলিশিয়া বলে মানতে রাজি হননি খোদ সিপিআই মাওবাদী নেতৃত্ব। যার জন্য ২০১০ সালে দলের সেন্ট্রাল কমিটির মিটিংয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল কিষেণজিকে। কী হয়েছিল মাওবাদীদের সেই শীর্ষ কমিটির মিটিংয়ে এবং কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে যাব একটু বাদেই। মোদ্দা কথা, লালগড় আন্দোলনে প্যান্ট-শার্ট পরা অনেক কৃষক সন্তান অংশ নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা কৃষক-শ্রমিকের মৌলিক দাবি আদায়ের কোনও সংগ্রাম ছিল না। যে আন্দোলনের ভিত্তি ছিল কয়েকটি পরিবারের ওপর পুলিশি অত্যাচারের মধ্যে নিহিত, তা কিষেণজির মতো এক দুর্দান্ত সংগঠকের হাতে চালিত হয়েও শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেওয়ার লাগামছাড়া প্রতিযোগিতায় পরিণত হল।
লালগড় আন্দোলন শুরুর সময় থেকে এবং তার আগেও একাধিকবার জঙ্গলমহলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে আমি শুধু অনুসন্ধান করতে চেয়েছি, কেন এই শান্ত, সহজ-সরল এলাকাগুলো এভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল! বারবারই জঙ্গলমহলের অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে, এই খুনোখুনির ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেছি সাধারণ মানুষের মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। প্রশ্ন জেগেছে, সাধারণ মানুষ কি সত্যিই এই খুনোখুনি, রক্তপাত চায়?
প্রায় বারো-পনেরো বছরে বেলপাহাড়ি, জামবনি, বান্দোয়ান, বারিকুল সহ বহু এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করেছি, কীভাবে এত শক্তিবৃদ্ধি করেছিল মাওবাদীরা। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি এই প্রশ্নেরও যে, এই শক্তিবৃদ্ধির মধ্যে কোনও ফাঁকি ছিল না তো? এই যে যখন-তখন যাকে, তাকে খুন করছে, রাস্তায় পোস্টার মিলছে, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে পুলিশের মৃত্যু হচ্ছে, সিপিআইএম বিধায়ক রাতে বাড়ি থাকতে পারছেন না, এই যে আমরা কলকাতা থেকে যাওয়া সাংবাদিক কাটা রাস্তা পেরোতে মোটরসাইকেলে চেপে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় খবর করতে যাচ্ছি, সেখানে পুলিশ যেতে পারছে না, এগুলোই কি যথেষ্ট শক্তি বা প্রভাব বিস্তারের প্রতিফলন? পাল্টা এই প্রশ্নও মাথায় এসেছে, যদি সত্যি মানুষের মধ্যে এতই প্রভাব বিস্তার করে থাকে মাওবাদীরা, তবে রাষ্ট্রের সমান্তরাল জনতা সরকার নেই কেন? কেন নেই গণমিলিশিয়া? কেন নেই নিজস্ব সেনাবাহিনী?

 

লালগড়ের মূল্যায়ন 

কিন্তু আমার মতো বহিরাগত নয়, লালগড় আন্দোলন এবং কিষেণজিকে নিয়ে কী ভাবতেন মাওবাদীদের শীর্ষ নেতৃত্ব? তা বোঝার জন্য আমার পরবর্তী সাক্ষী এক প্রবীণ মাওয়িস্ট নেতা, যদিও তাঁকে প্রাক্তন নেতা বলা যায় না। নাম লিখব না, এই শর্তেই তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে গিয়ে বারবার কথা বলেছি ২০১৭ সালে। তিনি ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়িস্টের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য এবং পূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে।
২০১১ সালের এপ্রিল মাসে বিহারের কাটিহার থেকে এই মাওয়িস্ট নেতা গ্রেফতার হন এবং কয়েক বছর বিহারের জেলে থাকেন। তারপর শারীরিক কারণে জামিন পান ২০১৬ সালে। জামিন পাওয়ার পর কলকাতায় বাড়িতেই থাকেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম ২০১৭ সালের শেষে। বেশ কয়েকবার কথা বলি তাঁর সঙ্গে। তাঁর সাক্ষ্যর প্রধান বিষয় কিষেণজি এবং লালগড় আন্দোলন নিয়ে মাওয়িস্টদের মূল্যায়ন।
‘দেখুন কোটেশ্বরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ২০১০ সালে। আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে। সেই মিটিংয়ে লালগড় আন্দোলন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়, কাঁটাছেড়া হয়। এবং প্রায় সব কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যই কোটেশ্বরের সমালোচনা করেন। যে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে লালগড় আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যেভাবে এগোচ্ছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়ে। তার জন্য কোটেশ্বরের সমালোচনা করেন সবাই। কোটেশ্বরের সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস নিয়ে আমাদের কারও কোনও সংশয় ছিল না, কিন্তু ও অনেক ভুল করেছে, যা পশ্চিমবঙ্গে দলের তীব্র ক্ষতি করেছে।
আমাদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য তিনটি। দলের সংগঠন বৃদ্ধি, গণমিলিশিয়া তৈরি করা এবং আর্মি তৈরি করা। কোনওটাই লালগড়ে গড়ে ওঠেনি। আমরা মূল্যায়ন করেছি, লালগড়ের আন্দোলনে পার্টি কী পেল? গণমিলিশিয়া কেন তৈরি করা গেল না? কেন আর্মি তৈরি করা গেল না?’ ২০১০ সালের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে লালগড়ের এই সব ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।’
কী ছিল লালগড় আন্দোলন নিয়ে আপনাদের মূল্যায়ন? সমালোচনা শুনে কিষেণজি কী বললেন? প্রশ্ন করেছি মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্যকে।
‘কিছু বলেনি। শুনেছে সব কিছু। এমনকী ওই কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে কোটেশ্বরের স্ত্রীও ওর সমালোচনা করেছে। তাও মুখ বুজে শুনেছে কোটেশ্বর। তাছাড়া আপনারা ওকে কিষেণজি বলতেন বা বলেন, আমরা কিন্তু পার্টিতে ওর এই নাম নেওয়ারও যথেষ্ট সমালোচনা করেছিলাম।’
কেন?
‘আমাদের পার্টিতে যখন কেউ অন্য কোনও নাম নেন বা কাউকে অন্য নামে ডাকা হয়, তার একটা বড় কারণ অবশ্যই তাঁর পরিচয় আড়াল করা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই নতুন নামকরণের পেছনে একটা নির্দিষ্ট কারণও থাকে। আমাদের দলে একজনকেই কিষাণ নামে ডাকা হোত, তিনি প্রশান্ত বসু। তাঁর এই নাম নেওয়ার পেছনে একটা প্রতীকি কারণ ছিল। সরকার, জোতদার এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মাওবাদীদের নেতৃত্বে কৃষকদের আন্দোলনের কথা মাথায় রেখেই প্রশান্ত বসুর নামকরণ হয়েছিল ‘কিষাণ দা’। যা ছিল সরকার এবং সাধারণ গরিব কৃষকের কাছে একটা বার্তা। কিষাণ মানে কৃষক শ্রেণির প্রতিনিধি। হঠাৎই কোটেশ্বর নিজের নাম ‘কিষেণজি’ করে নেওয়ায় তা দলের অনেকেই ভালোভাবে নেননি। সেটা ওই কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে ওকে বলাও হয়। কোটেশ্বর চুপ করে শোনে সব কিছু।’
এই যে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে এতজন লালগড় আন্দোলনে কিষেণজির ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করলেন, কী জবাব দিয়েছিলেন তিনি? ফের প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে।
‘দেখুন আমাদের সমালোচনা ছিল মূলত দু’তিনটে জায়গায়। কোটেশ্বরের সাংগঠনিক ক্ষমতা, পার্টির প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনও কথা নেই। ওর মতো সাহসী সংগঠক পাওয়া মুশকিল। কিন্তু লালগড় আন্দোলনে ও সংযম রাখতে পারল না, তাই পার্টির মূল কাজ থেকে অনেকটা সরে গেল। ওকে আমরা বলেছিলাম, ভুল করছ। এভাবে মানুষ খুন করা ঠিক হচ্ছে না। যথেচ্ছভাবে মানুষ খুন করে দলের সংগঠনে বৃদ্ধি হবে না। বরং আমাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া সংগঠনের বিস্তার করতে হবে গোপনে। গোপন পার্টিকে টেলিভিশন চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়ে, ফোনে ইন্টারভিউ দিয়ে প্রকাশ্যে এনে দিয়েছিল কোটেশ্বর। যা আমাদের পার্টির অনেক ক্ষতি করেছে। বলেছিলাম, টিভিতে, ফোনে এত ইন্টারভিউ কেন? এতে সংগঠনের কী উপকার হবে? মিটিংয়ে নিজের ভুল মেনেও নিয়েছিল কোটেশ্বর। তারপরই ওই কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে লালগড় আন্দোলন নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করা হয়। যেখানে স্বীকার করা হয়েছিল, ”এভাবে ব্যক্তি হত্যা করা ঠিক হয়নি। চরম ভুল হয়েছে। এবং তার জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে পার্টির পক্ষ থেকে। কিন্তু সেই ক্ষমা চাওয়ার সময় আর পাওয়া যায়নি।”
সেদিন কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ের পর রাতে কোটেশ্বরের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়। ওকে পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, লালগড় এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করতে। কারণ, ওর অত্যাধিক এক্সপোজার হয়ে গিয়েছিল, যা ওর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলাম, অন্তত কিছুদিনের জন্য লালগড় ছাড়তে। পুলিশ ওর পেছনে পড়ে গিয়েছিল। কোটেশ্বর বুঝতেও পারছিল, ওর বিপদ হতে পারে। কিন্তু কথা শুনল না। বলল, ”দাদা, এতদিন ওদের সঙ্গে ছিলাম। এখন ওদের ছেড়ে গেলে ওরা ভাববে আমি ভয়ে পালিয়ে গেছি। সেটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। তাই ওখানকার মানুষকে ছেড়ে যেতে পারব না। তাছাড়া লালগড়ের পার্টির পক্ষ থেকে যদি আমার সরে যাওয়ার কথা ওঠে তবে ঠিক আছে, কিন্তু এই অবস্থায় আমার নিজের পক্ষে লালগড়ের পার্টি এবং ওখানকার মানুষকে ছেড়ে আসা সম্ভব নয়।”
এরপর আপনি কী বললেন কিষেণজিকে?
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, লালগড়ের স্থানীয় নেতৃত্ব কি ওখানে আন্দোলন চালাতে পারবে না? কারণ, আমাদের মনে হচ্ছিল, কোটেশ্বর যেভাবে লালগড় এলাকায় মুভ করছে, ওর যে কোনও সময় বিপদ হতে পারে। কিন্তু কোটেশ্বর বলল, ”না, দাদা ওরা নিজেরা পারবে না, ওখানকার পার্টি আমাকে ছাড়া ভাবতেই পারে না। তাই আমার লালগড় ছাড়া সম্ভব নয়।”
প্রবীণ মাওয়িস্ট নেতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুধু মনে পড়ছে ২০১১ সালের নভেম্বরে বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষেণজির এনকাউন্টারের কথা। সেই যে কিষেণজি উই ঢিবির আড়াল থেকে বেরিয়ে ফোর্সকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করলেন, গার্ড করলেন সুচিত্রা মাহাতো এবং নিজের দেহরক্ষী মঙ্গল মাহাতোকে। দু’জনকেই পালানোর নির্দেশ দিলেন। দু’জনে দু’দিকে পালালো, মিনিট কয়েক সিআরপিএফের সঙ্গে অসম যুদ্ধ চালিয়ে পড়ে গেলেন কিষেণজি। হাত থেকে পড়ে গেল এ কে ৪৭। প্রথম ম্যাগাজিনের গুলি শেষ করে দ্বিতীয় ম্যগাজিনটা সবে ভরেছিলেন বন্দুকে। তা আর পুরো চালাতে পারলেন না ।

 

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৮

 

অনেকবার ভেবেছি, কেন এমন করেছিলেন মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজি। এ তো অনেকটা আত্মহত্যার শামিল! কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাইনি কখনও। সেই প্রশ্নেরই যেন একটা জবাব মিলল কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের সাক্ষ্যগ্রহণের একদম শেষ পর্বে এসে। ২০১০ সালের শেষ থেকেই পার্টি নেতৃত্ব বারবার কিষেণজিকে বলেছে লালগড় ছাড়তে। এমনকী ২০১১ সালে রাজ্যে সরকার বদলের পরও তাঁকে পার্টির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল, জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, লালগড় ছাড়তে। কিন্তু কারও কথা শোনেননি তিনি। হয়তো অহঙ্কারে লেগেছিল তাঁর। এত বছরের পোড়খাওয়া যোদ্ধা, নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছিলেন, লালগড়ে থাকলে বিপদ হতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। কিন্তু তিনি মাল্লুজোলা কোটেশ্বর রাও। তাঁর একটা আত্মসম্মান আছে, পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে পালানোর বান্দা নন তিনি। সে আত্মসম্মানবোধেই হয়তো জীবনের শেষ যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে পালাননি তিনি। হয়তো ভেবেছেন, দুই সঙ্গীকে ফেলে পালিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বীরের মৃত্যু অনেক ভালো। হয়তো ভেবেছেন, গুলির লড়াই থেকে পালিয়ে বেঁচে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবেন দলের নেতৃত্বের কাছে! ফের একাধিক প্রশ্ন উঠবে, কী জবাব দেবেন তার?
যদিও প্রশ্ন উঠেছিল সুচিত্রা মাহাতোর বেঁচে থাকা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছিল, কিষেণজি মারা গেলেন, অথচ সুচিত্রা কীভাবে বেঁচে গেলেন তা নিয়ে? প্রশ্ন উঠেছিল, সুচিত্রাই কি ধরিয়ে দিয়েছেন কিষেণজিকে? প্রশ্নটা আরও জোরদার হয়েছিল তারই মাস আষ্টেক আগে ঘটে যাওয়া অন্য একটা এনকাউন্টারের সূত্র ধরে। যে এনকাউন্টারে ২০১১ সালেরই মার্চ মাসে মৃত্যু হয়েছিল শশধর মাহাতোর। সুচিত্রার স্বামী এবং পুলিশ সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির মুখপাত্র ছত্রধর মাহাতোর দাদা শশধরের আসল পরিচয়, তিনি জঙ্গলমহলের প্রথম সারির মাওবাদী নেতা।

 

এনকাউণ্টার শশধর মাহাতো 

সেটা ২০১১ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ঝাড়গ্রাম পুলিশের কাছে গ্রামের এক সোর্স মারফত খবর এল, এক অখ্যাত চাঁদসোড়া গ্রামে এসেছেন শশধর মাহাতো। এসডিপিও বেলপাহাড়ি অম্লান কুসুম ঘোষ, বিনপুর থানার ওসি সুকোমল দাস খবরটা পেয়েই পড়িমড়ি রওনা দিলেন, সঙ্গে সিআরপিএফের এক অফিসার সহ কয়েকজন। মোট আটটা মোটরসাইকেলে রওনা দিলেন ষোল জন, সবাই সাদা পোশাকে। তখন দুপুর প্রায় ৩ টে। বিনপুর থেকে চাঁদসোড়া যাওয়ার সময় পথে নামল প্রচণ্ড বৃষ্টি। মোটরসাইকেল থামিয়ে রাস্তার ধারে এক স্কুলে অপেক্ষা করলেন অফিসাররা। তিরিশ-চল্লিশ মিনিট বাদে বৃষ্টি একটু কমতেই রওনা দিলেন তাঁরা। প্রায় ৪ টে নাগাদ এক সঙ্গে আটটা মোটরসাইকেল ঢুকে পড়ল চাঁদসোড়া গ্রামে।

 

চলবে

Comments are closed.