আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: লালগড় আন্দোলন নিয়ে মাওয়িস্ট কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে সমালোচিত হলেন কিষেণজি। ২০১১ মার্চের সকালে পুলিশের কাছে নির্দিষ্ট খবর এল শশধর মাহাতোর লোকেশনের…
এনকাউণ্টার: শশধর মাহাতো
২০১১ সালের মার্চ, সকালবেলা খবরটা এল ঝাড়গ্রাম পুলিশের এক অফিসারের কাছে। এমন খবর আগের ছ’মাসে একাধিকবার এসেছে কয়েকজন অফিসারের কাছে। কোনও খবর কিছুটা ঠিক, কোনওটা নয়। ২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকেই ঝাড়গ্রাম পুলিশ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। একদম জেনুইন মাওয়িস্ট লিডার ছাড়া অন্য কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। এমনকী অচেনা, সাধারণ কোনও স্কোয়াড মেম্বার সম্পর্কে খবর এলেও তা অ্যাভয়েড করা হবে আরও বড় টার্গেটের লক্ষ্যে। যদি সম্ভব হয় সাধারণ স্কোয়াড মেম্বারকে না গ্রেফতার করে বুঝিয়ে দিতে হবে, তাঁকে গ্রেফতার করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি। এতে তাঁর মধ্যে কনফিডেন্স তৈরি হবে। এভাবেই পুলিশ যথেষ্ট বিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছিল বহু পিসিপিএ নেতা এবং মাঝারি মাপের স্কোয়াড মেম্বারের। তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন পুলিশের সোর্স।
ঝাড়গ্রামের এমনই মাওয়িস্ট স্কোয়াডের এক সদস্য এক অফিসারের সোর্স হয়ে উঠেছিলেন। সোর্স কীভাবে তৈরি হয় এবং কীভাবে তাঁকে মেইনটেইন করতে হয়, তা লিখে শব্দসংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এটাই, রাজ্যে পরিবর্তনের বছরে বিধানসভা ভোটের মাসখানেক আগে এক অফিসারের কাছে ফোন এল, ‘স্যার শশধর আজ চাঁনসরা গ্রামে আছে। কাল গেছে ওখানে, আজ সারাদিন থাকবে।’
কিষেণজিকে বাদ দিলে শশধর মাহাতো সেই সময় তো বটেই, তার আগেও সবচেয়ে প্রমিনেন্ট মাওবাদী নেতা। আকাশ, মদন মাহাতোর বয়স হয়েছে, লালগড় আন্দোলন চলাকালীন যত বড়ো ঘটনা মাওবাদীরা ঘটিয়েছে, তার বেশিরভাগেরই নেতৃত্বে ছিলেন শশধর মাহাতো। তাঁর সম্পর্কে খবরটা পেয়েই প্ল্যানিংয়ে বসলেন ওই অফিসার, জানালেন শুধুমাত্র এক সুপিরিয়র অফিসারকে। আলোচনা করে দুপুর আড়াইটে-তিনটে নাগাদ অপারেশনের প্ল্যান করলেন তাঁরা। দুপুরে গ্রাম কিছুটা ফাঁকা থাকে। ঠিক হল, একদম সাদা পোশাকে অল্প কয়েকজন যাবেন চাঁচসরা গ্রামে। বড়ো গাড়ি নয়, মোটরসাইকেলে। সেই অনুযায়ী সিআরপিএফের বাছাই করা কয়েকজন জওয়ানকে নিয়ে এসডিপিও অম্লান কুসুম ঘোষ এবং বিনপুর থানার ওসি সুকোমল দাস রওনা দিলেন চাঁনসরার দিকে। আটটা মোটরসাইকেলে ষোলজন, সবাই সাদা পোশাকে। তখন দুপুর প্রায় ৩ টে। বিনপুর থেকে চাঁনসরা যাওয়ার সময় পথে নামল প্রচণ্ড বৃষ্টি। মোটরসাইকেল থামিয়ে রাস্তার ধারে এক স্কুলে অপেক্ষা করলেন অফিসাররা। তিরিশ-চল্লিশ মিনিট বাদে বৃষ্টি একটু কমতেই রওনা দিলেন তাঁরা। প্রায় ৪ টে নাগাদ এক সঙ্গে আটটা মোটরসাইকেল ঢুকে পড়ল চাঁনসরা গ্রামে। ছোট গ্রাম চাঁনসরা। সব মিলিয়ে ৩০-৩৫টা বাড়ি। বড়ো রাস্তা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম ভৌগোলিক ভাবেও মাওয়িস্টদের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল জায়গা ছিল সেই সময়। চাঁনসরা গ্রামে মাওবাদীদের প্রভাব ছিল যথেষ্টই। গ্রামের অনেকেরই বাড়িতে আগেও আশ্রয় নিয়েছেন শশধর সহ একাধিক নেতা। তাঁরা যে জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাত কাটাতেন, তার মধ্যে একটা ছিল চাঁনসরা। আগের রাতেই সেখানে পৌঁছেছিলেন শশধর, তাঁর স্ত্রী সুচিত্রা এবং আরও তিন-চারজন। গ্রামে ঢোকার মুখেই ছিলেন সেন্ট্রি, গ্রামেরও দু’একজন অন্যান্যবারের মতোই দায়িত্বে ছিলেন, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই তাঁদের সতর্ক করার জন্য। কিন্তু সেদিন দুপুরে এক ঘণ্টার প্রবল বৃষ্টি সব গোলমাল করে দিল। সেন্ট্রি থেকে পাহারার দায়িত্বে থাকা গ্রামবাসী, সকলেই একটু ছন্নছাড়া হয়ে যান। প্রবল বৃষ্টির জন্য ঘরে ছিলেন তাঁরা। হয়তো ভাবতে পারেননি, এই বৃষ্টিতে দুপুরে পুলিশ চলে আসতে পারে! কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক সঙ্গে আটটা মোটরসাইকেল গিয়ে থামল চাঁনসরা গ্রামে। গ্রামের রাস্তা-মাঠ তখন অলমোস্ট ফাঁকা।
গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন শশধর, সুচিত্রা এবং আরও তিন-চারজন। এতগুলো মোটর সাইকেলের আওয়াজে চমকে উঠলেন তাঁরা। বুঝে গেলেন পুলিশ এসে গেছে তাঁদের খোঁজে। গ্রামের অল্প কিছু লোক বাইরে ছিলেন, হাতে রাইফেল, সাধারণ প্যান্ট, টি-শার্ট পরা পনেরো-ষোলজনকে হুড়মুড় করে মোটরসাইকেল থেকে নামতে দেখে ভয়ে ঢুকে গেলেন ঘরে। চরম কিছু একটা ঘটবে, এই আশঙ্কায় ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা হেস্তনেস্ত হবে আজ।
এদিকে গ্রামে তো ঢুকে পড়েছেন, কিন্তু অফিসাররা নিজেরাও জানেন না, কোথায় বা কোন বাড়িতে আছে স্কোয়াড। গ্রামে ঢুকে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন ষোলজন। তারপর নিলেন এক পরিচিত কায়দা। যেখানে বোঝা যাচ্ছে না মাওবাদীরা কোথায় আছে, তা জানার জন্য পরিচিত ছক। আসলে আচমকা এনকাউণ্টার জলে নেমে সাঁতার শেখার মতোই, তা বই পড়ে হয় না। সেখানে নিজে বাঁচা এবং অপারেশন সাকসেসফুল করার জন্য কতগুলো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখনও তা কাজে লাগে, কখনও লাগেও না।
পুলিশ এবং সিআরপিএফের দলটা মোটরসাইকেল থেকে নেমে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পাঁচ-ছ’টা দলে। সবাই নিয়ে নিলেন পজিশন। এক একটা দলে দু-তিনজন। তারপর একজন শূন্যে একটা গুলি চালালেন। দেখার জন্য, কোনও জবাব আসে কিনা। এনকাউণ্টারের মানসিক যুদ্ধে এই কৌশল অনেক সময়েই কাজে দেয়। লুকিয়ে থাকা লোক ভাবে, তারা কোথায় আছে তা লোকেট করে ফেলেছে পুলিশ। এটাই যে কোনও লুকিয়ে থাকা মানুষের সাধারণ ইন্সটিঙ্কট বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া। পুলিশ অপারেশনে এমন বহুবার হয়, গুলির আওয়াজ শুনে বাঁচার জন্য পালটা গুলি চালিয়ে জবাব দেয় তারা। আর সেই গুলির আওয়াজ শুনেই পুলিশ বুঝে যায়, লুকিয়ে থাকা লোকের নির্দিষ্ট লোকেশন। তাই ঘটল সেদিন বিকেলেও। পুলিশ শূন্যে গুলি চালানোর পর কয়েক সেকেন্ড চুপ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কয়েক সেকেন্ড বাদে পুলিশের আর একটা দলও কিছুটা দূরে পরপর গুলি চালাল শূন্যে। শশধররাও বুঝে গেলেন, ঘেরাও হয়ে গেছেন তাঁরা। পাল্টা গুলিয়ে চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করা ছাড়া রাস্তা নেই কোনও। শুরু হয়ে গেল এনকাউণ্টার। যা স্থায়ী হল সাকুল্যে পাঁচ থেকে সাত মিনিট।
পালানোর জন্য গুলি চালাতে চালাতে শশধর মাহাতো সহ সবাই বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। চার-পাঁচজন আলাদা হয়ে গেলেন, এক একজন পালানোর চেষ্টা করলেন এক একদিকে। এটাও তাঁদের একটা কৌশল, সবার একসঙ্গে না থাকা। সবচেয়ে খারাপ কিছু হলেও সবাই যেন ধরা পড়ে না যান।
ছোট্ট গ্রাম চাঁনসরা, পরপর বাড়ি, তারই মাঝে গোয়াল ঘর, সরু রাস্তা, হাঁস-মুরগি, ছাগল-গরু বাঁধা। একটা ছোট মাঠ। গুলির শব্দে কেঁপে উঠল এলাকা। ততক্ষণে বাড়ির আড়ালে পুলিশ, সিআরপিএফের দু-তিনজনের ছোট ছোট দলগুলো সেফ পজিশন নিয়ে নিয়েছে। চারদিক থেকে ফায়ারিং করছে পুলিশ। মাঝখানে পড়ে গেল শশধর, সুচিত্রার ছোট্ট স্কোয়াডটা। গুলি চালাতে চালাতে পালানোর সময় পুলিশ-সিআরপিএফের ছোট্ট একটা দলের নিশানার মধ্যে চলে এলেন শশধর মাহাতো। যদিও দলটা জানতো না, মাঝবয়সী যে লোকটা হাতে এ কে ৪৭ নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে দৌড়চ্ছেন, তিনিই এই স্কোয়াডের লিডার, লালগড় আন্দোলনে কিষেণজির পর মোস্ট ওয়ান্টেড! এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে চালাতে দৌড়নোর সময় শশধর দেখতেও পেলেন না, তিনি চলে এসেছেন টার্গেটের মধ্যে। নাগাড়ে গুলি চালাচ্ছেন জওয়ানরা। সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা মাটির রাস্তা কাদায় থিকথিক করছে। শশধর যখন বুঝলেন টার্গেটের মধ্যে চলে এসেছেন, তখন টার্ন নিতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে পড়ে গেলেন তিনি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পড়লেন, না কাদায় পা পিছলে পড়ার মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ হলেন, তা কোনওদিনই জানা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রায় আধঘণ্টা পর মৃতদেহের সামনে পৌঁছে অফিসাররা ভালো করে দেখেন কাদায় পিছলে পড়ার চিহ্ন। দুটো বাড়ির মাঝখানে মাটির দেওয়ালে হেলান দিয়ে পড়ে আছে শশধর মাহাতোর মৃতদেহ। হাতে এ কে ৪৭। হাতে-পায়ে কাদা আর রক্ত। বুক থেকে শরীরের ওপরের অংশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
এদিকে, শশধর যেখানে জওয়ানদের গুলির মুখোমুখি, ঠিক সেই সময়ই কম-বেশি একশো মিটার দূরে একটা বাড়ির আড়াল দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন সুচিত্রা মাহাতো। তাঁরও হাতে রাইফেল। এক বাড়ির আড়াল থেকে অন্য বাড়ির আড়ালে যেতে পেরোতে হবে ৫০-৬০ ফুট একটা ফাঁকা জায়গা। সেটা পেরোতে গিয়েই সুচিত্রা মুখোমুখি পড়ে গেলেন বিনপুরের ওসি সুকোমল দাসের। সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু, রিভলভার হাতে পুলিশ অফিসার, এক সেকেন্ডের জন্য থমকালেন সুচিত্রা মাহাতো। হাতের রাইফেল তাক করারও সময় পেলেন না। আর একশো হাতের মধ্যে রাইফেল হাতে সুচিত্রাকে দেখে যেন মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল বিনপুর থানার ওসি সুকোমল দাসের স্নায়ু বেয়ে। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে রিভলভার তাক করলেন সুকোমল দাস। ট্রিগার টিপলেন, খট করে একটা আওয়াজ হল মাত্র। গুলি বেরোল না, লক হয়ে গেল বন্দুক। এমন বন্দুক লক হয়ে যাওয়া একদম অস্বাভাবিক নয়, এক হাজারবারে কয়েকবার হয় হয়তো। হল তো হল, সুচিত্রাকে নাগালের মধ্যে পেয়েই হল তা। যতক্ষণে সুকোমল দাস বুঝলেন গুলি বেরোয়নি, ততক্ষণে সুচিত্রা ৫০ ফুট রাস্তাটা পেরিয়ে চলে গিয়েছেন অন্য বাড়ির আড়ালে। আশ্চর্য নার্ভের জোর সুচিত্রা মাহাতোর। নিশ্চিত মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখেও থামেননি এক সেকেন্ড! নিজেও হয়তো বুঝেছেন, তাঁকে তাক করে থাকা বন্দুক লক করে গেছে, কিন্তু সেটা তো এক সেকেন্ডের কয়েক ভাগ মাত্র সময়, দৌড় থামালেন না তিনি। এই বাড়ি, সেই বাড়ির ফাঁক দিয়ে জল-কাদা পেরিয়ে পালিয়ে গেলেন এ কে ৪৭ হাতে সুচিত্রা মাহাতো। যতক্ষণে সেকেন্ড ফায়ার করতে যাবেন সুকোমল দাস, ততক্ষণে চোখের আড়ালে বাইরে চলে গেছেন সুচিত্রা। বেশি দূর যেতে পারেননি নিশ্চিত, তাড়া করলেন বিনপুর থানার ওসি। কিন্তু এর নাম এনকাউন্টার! রিয়েল লাইফ গুলির লড়াই, এখানে কোনও অ্যাকশন রিপ্লে নেই। কোনও স্ক্রিপ্ট নেই। এখানে প্রতিপক্ষের হাতেও এ কে ৪৭। জীবন নেওয়া এবং জীবন যাওয়া দুইই নির্ভর করে কিছু চান্স ফ্যাক্টরের ওপর। তখনও জল জমে গ্রামের অনেক জায়গায়। দৌড়তে গিয়ে কাদায় পা পিছলে মাটিতে পড়ে গেলেন সুকোমল দাস। লালগড় থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রামগড়ের গ্রামে ঝড়ে-জলে মাঠে দৌড়ে, গাছে চড়ে বড় হওয়া সুচিত্রা ওই কাদা মাটিতে দৌড়ে গ্রামের এই রাস্তা, সেই রাস্তা পেরিয়ে বেরিয়ে গেলেন পুলিশের নাগালের বাইরে। মাটি থেকে উঠে ফের গুলি চালিয়েছিলেন বিনপুর থানার ওসি, কিন্তু ততক্ষণে সুচিত্রা নাগালের বাইরে। পুলিশ, সিআরপিএফের গুলি এড়িয়ে পালিয়ে গেলেন শশধরের বাকি বাকি সঙ্গীরাও। সব মিলে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের অপারেশন। থেমে গেল গুলির আওয়াজ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৬ জন পুলিশ এবং সিআরপিএফ অফিসার-জওয়ান নিজের নিজের জায়গায় অপেক্ষা করলেন মিনিট পনেরো। গ্রামে কোনও কিছুর কোনও শব্দ নেই, ভয়ে গ্রামের গরু, মুরগিগুলোও নিঃশব্দ। গ্রামের সব লোক বাড়ির ভেতরে বন্দি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কয়েকশো রাউন্ড ফায়ারিংয়ের শব্দের ঘোর তখনও কাটেনি। দিনের আলো তখনও পরিষ্কার, একে একে অফিসার ও জওয়ানরা জড়ো হলেন এক জায়গায়।
অপেক্ষা করলেন কয়েক মিনিট। বুঝতে পারলেন, আর নেই কেউ। দেখলেন, একটা বাড়ির আড়ালে মাটিতে কাত হয়ে পড়ে আছেন মৃত শশধর মাহাতো। হাতের বন্দুক শক্ত করে ধরা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন শীর্ষ মাওবাদী নেতা। শরীরের ওপরের অংশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বুকে, গলায় গুলির ক্ষত। যদিও তিনিই যে শশধর মাহাতো তা সেই সময় নির্দিষ্ট ভাবে বোঝার কোনও উপায় ছিল না। তবে অফিসাররা আন্দাজ করেছিলেন। পরে এক সোর্সকে ডাকিয়ে এনে তাঁকে মৃত ব্যক্তিকে দেখিয়ে পুলিশ কনফার্ম হয়, লালগড়ের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে তখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অপারেশন সাকসেসফুল। সেদিন শশধরের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল মোবাইল ফোন, কিছু সিম কার্ড। যে বাড়িতে শশধররা আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে পরে সার্চ করে মিলেছিল আরও কিছু বন্দুক।
জঙ্গলমহলে কাজ করা সমস্ত পুলিশ অফিসার থেকে রাজনৈতিক নেতা কিংবা সাংবাদিক জানতেন, কোনও সাধারণ স্কোয়াড মেম্বার ছিলেন না শশধর মাহাতো। তিনি ছিলেন জেনুইন লিডার এবং কিষেণজির পরেই মোস্ট ওয়ান্টেড নেতা। সিদু সোরেন বা আরও অনেকের মতো লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর হাতে বন্দুক নিয়ে মানুষকে স্রেফ ভয় দেখিয়ে নেতা হননি শশধর মাহাতো। সমস্ত বড়ো অ্যাকশনে নেতৃত্ব দিতেন শশধর। যদিও কয়েক মাস বাদে কিষেণজির যখন পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়, তখন যে প্রশ্ন উঠেছিল এবং এখনও যে প্রশ্ন মাঝে-মাঝেই উত্থাপন করেন অনেকে, একই প্রশ্ন কিন্তু সেভাবে ওঠেনি শশধর মাহাতোর এনকাউন্টারের পরও। কী সেই প্রশ্ন?
কীভাবে এনকাউন্টারে একা কিষেণজির মৃত্যু হল, অথচ সুচিত্রা বেঁচে গেলেন? এই প্রশ্ন তো আট মাস আগে চাঁনসরার গ্রামে ওঠেনি সেভাবে! আমার মতে এর কারণ মূলত দুটো।
প্রথম কারণ, শশধরের এনকাউণ্টার হয়েছিল সিপিআইএম জমানায়। আর কিষেণজির ক্ষেত্রে তা ঘটেছিল রাজ্যে সরকার বদলের পর তৃণমূল আমলে। যে সিপিআইএম মাসের পর মাস বলে এসেছে, মাওবাদী আর তৃণমূল সব এক, তাদের পক্ষে তো আর নিজের সরকারের আমলে পুলিশের এনকাউণ্টারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সম্ভব ছিল না! সেই কারণেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের রাজনৈতিক এবং কৌশলগত লাইন সিদু সোরেন, শশধর মাহাতো বা উমাকান্ত মাহাতোর এনকাউণ্টারকে ছাড়পত্র বা প্রকৃত গুলির লড়াইয়ের মর্যাদা দেয়, আর তৃণমূল জমানায় কিষেণজির এনকাউণ্টারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর এই প্রশ্নের মধ্যে একজন মহিলার নাম যুক্ত করতে পারলে যে তা নিয়ে চর্চা এবং রহস্য দুইই বৃদ্ধি পায়, তা চৌত্রিশ বছর সরকার চালিয়ে তো না বোঝার কিছু নেই। এত বছর সরকার চালাতে হলে সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব তো খানিকটা বুঝতেই হয়! আর এটাই আমার মতে দ্বিতীয় কারণ।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেই ২০১১ সালের ১০ মার্চ চাঁনসরা গ্রামের এনকাউণ্টারের পর প্রশ্ন তোলেনি, শশধর মাহাতোর অন্য পুরুষ সঙ্গীরা কীভাবে বেঁচে পালিয়েছিলেন! প্রশ্ন তোলেনি, শশধর মাহাতোর সেন্ট্রিরা কী করছিলেন পুলিশ অভিযানের মুহূর্তে! ঠিক সেভাবেই সে বছরের নভেম্বর মাসেও কেউ প্রশ্ন তোলেননি, কীভাবে কিষেণজির সেন্ট্রি মঙ্গল মাহাতো বেঁচে পালিয়েছিলেন এনকাউণ্টারের সময়? প্রশ্ন উঠেছে স্রেফ সুচিত্রা মাহাতোকে নিয়ে! কারণ, সুচিত্রা মাহাতো যে মহিলা! আত্মসমর্পণ করা সুচিত্রা মাহাতো বা জাগরী বাস্কের যে চরিত্র মূল্যায়ন আমাদের সমাজ করে থাকে, তা করে না আত্মসমর্পণ করা পুরুষ মাওবাদী সুমন মাইতি ওরফে সাঁওতা বা জাগরী বাস্কের স্বামী রাজারামের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে!
কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কেন সফট টার্গেট হিসেবে বারবার এনকাউণ্টারের পর স্কোয়াডে থাকা মহিলাদের চরিত্র মূল্যায়নে এত সময় ব্যয় করে, তা নিয়ে কিন্তু মাথাব্যথা ছিল না মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্বের। তাঁদের কাছে শশধর এবং কিষেণজি, দুই মৃত্যুই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেন এনকাউণ্টার হল, কীভাবে হল, কে খবর দিল পুলিশকে, সবই পরে তদন্ত করে দেখে মাওয়িস্ট নেতৃত্ব এবং তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তে দু’বারই ক্লিনচিট পেয়েছেন সুচিত্রা মাহাতো। কেন এবং কীভাবে, সেই প্রসঙ্গে আসব পরে।
আপাতত এই কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের প্রায় শেষ লগ্নে এসে আলোকপাত করার চেষ্টা করব এক গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক রাজনৈতিক প্রশ্নের ওপর। এবং তারপরই আবার ফিরব, সেই ২০১১ সালের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে কিষেণজির এনকাউণ্টারের ঘটনায়। যেখানে বুড়িশোলের জঙ্গলে সন্ধ্যায় গাছে ফেরা হাজার-হাজার পাখিরও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লাগাতার গুলির শব্দে! ঠিক কী ঘটেছিল সেই সন্ধ্যায়, সেই ঘটনায় ফিরব আবার, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই লেখা।
বিপুল ধৈর্য নিয়ে যে অসংখ্য মানুষ সাধারণ এক সাংবাদিকের লেখা এই কিষেণজি মৃত্যু রহস্য এতটা বরদাস্ত করেছেন, তাঁরা এতদিনে নিশ্চিতভাবেই জেনে গিয়েছেন এই লেখার উদ্দেশ্য। এই লেখার উদ্দেশ্য সাংবাদিক হিসেবে বারেবারে জঙ্গলমহলে গিয়ে যে সব প্রশ্নের জবাব মেলেনি তা খোঁজা নেওয়া কিংবা যে প্রশ্নের জবাব খোঁজার মতো সময় চব্বিশ ঘণ্টার চ্যানেলে প্রতিদিনকার সাংবাদিকতা অনুমোদন করে না, তার হদিশ করা।
যে প্রশ্ন বারবার মাথায় এসেছে, কী কারণে এবং কোন প্রেক্ষাপটে মাওয়িস্টরা এরাজ্যে এতটা শক্তি অর্জন করেছিল? লালগড় আন্দোলনকে কি সত্যিই শ্রেণি সংগ্রাম বলা যায়? সেই সময় এই আন্দোলন নিয়ে যে বহুল প্রচার হয়েছিল দেশজুড়ে, তা কি মাওয়িস্টদের মূল রাজনৈতিক লাইনের প্রসারে কোনওভাবে সহায়ক হয়েছে? এবং শেষমেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এই আন্দোলন কি রাজ্যে প্রথমে এমসিসি-জনযুদ্ধ এবং পরে মাওয়িস্টদের বিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে যে প্রভাব বিস্তার, তার কোনও উপকার করেছে না ক্ষতি করেছে? এই শেষ প্রশ্নটাই আমার মাথায় বারবার ধাক্কা দেয় ২০১০ সাল থেকে ২০১১ র নভেম্বরের শেষে কিষেণজির এনকাউণ্টার পর্যন্ত। এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে পিসিপিএ নেতা, এমনকী স্কোয়াড মেম্বার পর্যন্ত কেন বারবার পুলিশকে ফোন করে মাওয়িস্ট নেতাদের ধরিয়ে দিচ্ছিলেন, সেই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কিষেণজির মতো পলিটব্যুরো সদস্যের মৃত্যু রহস্য।
জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক পালাবদল
জঙ্গলমহলের জীবন এতটাই বহুমাত্রিক এবং কাঁসাই, ডুলুং নদীর গতিপথের থেকেও তাতে এত বেশি বাঁক, তা বারবার প্রভাবিত এবং বিস্মিত করেছে আমার ভাবনাচিন্তাকে। এবং এই কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের সন্ধান করতে গিয়ে মনে হয়েছে, আটের দশকে সিপিআইএমের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনিবার্য পরিণতিই যেন ঝাড়গ্রাম মহকুমা এবং পাশের দুই জেলা বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বারিকুল, বান্দোয়ান, বলরামপুরে মাওবাদের উত্থান। আবার লালগড় আন্দোলন এবং তার আগে কিছু ক্ষেত্রে মাওবাদীদের যে হিংসার রাজনীতি, সেটাই তাদের সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বারবার মনে হয়েছে, বান্দোয়ানের সেই যে সাধারণ সিপিআইএম নেতা, যিনি রাতে ঘুমোতে যান বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরের পুলিশ ক্যাম্পে, কিংবা উপেন হাঁসদা, বান্দোয়ানের দু’টার্মের বিধায়ক, যিনি বাড়ি ছেড়ে ক্লাবের মাটিতে মাদুর পেতে শোন, তাঁদের মতো লোককে খুন করে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে মাওবাদীরা। একই কথা মনে হয়েছে, লালগড়ের শালকু সোরেন বা তাঁর মতো সাধারণ গরিব মানুষকে খুনের পর। কিন্তু শুধু যুক্তি বা কথার মারপ্যাঁচই তো যথেষ্ট নয় এটা প্রমাণ করতে যে, ২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে কতটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল মাওবাদীরা!
আমার স্থির বিশ্বাস, হিংসা, নির্বিচারে ব্যক্তি হত্যা এবং আদর্শহীন কিছু লোককে দলের সঙ্গে যুক্ত করার ফলে কিষেণজির নেতৃত্বে থাকা মাওবাদী বাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার, তারই ফলশ্রুতি, তাদের সম্পূর্ণভাবে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজন মাওবাদী শীর্ষ নেতার খবর পুলিশকে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই তো প্রমাণিত হয় না, সাধারণ মানুষ মাওয়িস্টদের থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছিলেন, বরং তার অনেকটাই হদিশ মেলে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলে।
কী ফল হল ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে? ঝাড়গ্রামের চারটি আসন। ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর এবং বিনপুর। প্রথম তিনটি কেন্দ্রে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী। শুধুমাত্র বিনপুর আসনে তৃণমূলের জোটসঙ্গী কংগ্রেস সমর্থিত ঝাড়খন্ড পার্টি নরেন দলের প্রার্থী চুনিবালা হাঁসদা। এ কথা সবারই মনে থাকবে, ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের বছরে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হয়েছিল এবং ঝাড়গ্রামে কংগ্রেসের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টি নরেনের জোট বহুদিনের। এবং এখন অন্তত গোটা দুনিয়ার মানুষ যেমন মানেন, সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে, তেমনই ঝাড়গ্রামের মানুষ মাত্রই জানেন, সিপিআইএম বিরোধিতার ট্যাকটিকাল লাইন হিসেবে ঝাড়খন্ড পার্টিকে বিভিন্ন নির্বাচনে কীভাবে সাহায্য করেছে এমসিসি-জনযুদ্ধ বা মাওবাদীরা।
তো কী হল সেই নির্বাচনে? ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম এবং গোপীবল্লভপুরে সহজেই জিতলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা। নয়াগ্রাম এবং গোপীবল্লভপুরে তৃণমূল কংগ্রেস পেল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট। ঝাড়গ্রামেও ৪৪ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ১৫ হাজার ভোটে হারাল সিপিআইএমকে। কিন্তু জঙ্গলমহলের প্রকৃত পরিবর্তন হল বিনপুরে। মাওয়িস্টদের সমর্থনে ২০০৬ সালেও নির্বাচনে জেতা ঝাড়খন্ড নরেনের চুনিবালা হাঁসদা হেরে গেলেন ২০১১ সালে! এবং হেরে গেলেন সিপিআইএমের দিবাকর হাঁসদার কাছে। যে বিনপুর এমসিসি-জনযুদ্ধ এবং পরে মাওবাদীদের অন্যতম ঘাঁটি, সেখানে কেন গ্রামের পর গ্রাম মানুষ সিপিআইএমকে জেতালেন, যেখানে তাঁরাই বছরের পর বছর কখনও নরেন হাঁসদা, কখনও চুনিবালা হাঁসদাকে জিতিয়েছেন? এটাই গোটা লালগড় আন্দোলন পর্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শিক্ষা। কারণ, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে যেভাবে অদল-বদল হয়েছে, তা সম্পূর্ণ প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন নির্বাচনের ফলে।
১৯৭৭ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রামের তিনটি আসনে জয়লাভ করে সিপিআইএম, গোপীবল্লভপুর আসনে জেতেন নকশাল নেতা সন্তোষ রাণা। আটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই এই মহকুমার কিছু কিছু এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয় সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির মধ্যে। গোটা মহকুমায় ঝাড়খন্ডিরা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল বিনপুরে। এবং তা বারবার প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন ভোটে। নয়ের দশক থেকেই এমসিসি-জনযুদ্ধ অ্যাক্টিভিটি শুরু করে বেলপাহাড়ির বিভিন্ন এলাকায়, যা বিনপুর বিধানসভার অন্তর্গত। ঝাড়খন্ড পার্টির মতোই তাদেরও রাজনৈতিক লাইন ছিল সিপিআইএম বিরোধিতা। তো এর কী প্রভাব পড়ল এই এলাকায়?
১৯৯১ সাল, দেশে উদার অর্থনীতি চালুর বছর, রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম এবং গোপীবল্লভপুর কেন্দ্রে সিপিআইএম জিতল ৫৪ থেকে ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে। উল্টো রাস্তায় হাঁটল বিনপুর, ৫৮ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে সিপিআইএমকে প্রায় ২০ হাজার ভোটে হারালেন ঝাড়খন্ড পার্টি নরেন দলের প্রার্থী নরেন হাঁসদা। এর পুনরাবৃত্তি ১৯৯৬ সালেও। মহকুমার তিনটি আসনেই জিতল সিপিআইএম, বিনপুরে ফের জিতল ঝাড়খন্ড পার্টি নরেন।
২০০১ সালে বিধানসভা ভোটে ছবিটা পালটাল কয়েকটা এক্সটার্নাল ফ্যাক্টরের জন্য। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরির পর গোটা রাজ্যের মতোই পশ্চিম মেদিনীপুরে রাজনৈতিক ভারসাম্য অনেকটাই বদলে যায়। বিনপুরে তৈরি হয় একটা বিচিত্র অবস্থা। যদিও সেটা এই লেখায় খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়, তবুও কিছুটা উল্লেখ থাকা দরকার। ১৯৯৮-৯৯ সালের পর থেকেই এমসিসি-জনযুদ্ধ অনেকটা সক্রিয় হয়ে ওঠে বেলপাহাড়ি সহ বিনপুরের বিভিন্ন জায়গায়। তখনও সেভাবে খুনের রাজনীতি শুরু হয়নি ঠিকই, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় ভোট বয়কটের ডাক দেয় তারা। ২০০১ সালে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সবথেকে কম ভোট পড়ে বিনপুর কেন্দ্রে, মাত্র ৭০ শতাংশ। যা গ্রাম বাংলায় সাধারণ ভোট পড়ার যে হার তার থেকে বেশ খানিকটা কম। ভোট বয়কটের ডাক খানিকটা প্রভাব ফেলে গ্রাম এবং জঙ্গল এলাকায়। যেখানে ঝাড়খন্ডিদের প্রভাব বেশি। এই কেন্দ্রের শহরাঞ্চলে সিপিআইএমের ভোট ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। পাশাপাশি, বাঁশপাহাড়িতেও রাজ্যের শাসক দলের জোর বেশি ছিল।
কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৯
২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে অনেকটাই শক্তিবৃদ্ধি করে ফেলে মাওয়িস্টরা। এবং তার সুফল সুদে-আসলে যায় ঝাড়খন্ড পার্টির ঘরে। ২০০৬ নির্বাচনে রাজ্যে বামেদের প্রবল সাফল্য, ২৩৫ আসন। কিন্তু বিনপুর আসনে ফের জিতলেন চুনিবালা হাঁসদা। সেই নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে প্রায় ৪৯ হাজার, নয়াগ্রামে প্রায় ৪০ হাজার এবং গোপীবল্লভপুরে প্রায় ৫০ হাজার ভোটে জিতলেও মাওয়িস্ট প্রভাবিত বিনপুরে হেরে গেল সিপিআইএম। এবং এই নির্বাচনের ফলগুলোই বারবার প্রমাণ করেছে, বিনপুরের বিস্তীর্ণ অংশে মাওয়িস্টদের ইলেকটোরাল ট্যাকটিকাল লাইন কী ছিল।
কিন্তু ইতিহাসের কী বিচিত্র গতি, কী নিদারুণ শিক্ষা! যে বিনপুরে বাড়ি বাড়ি প্রচার করে নিজস্ব সংগঠন বিস্তার করেছিল এমসিসি-জনযুদ্ধ, যেখানে ২০০৪ সালের পর থেকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল মাওয়িস্টরা, সেই কেন্দ্রেই লালগড় আন্দোলনের পর কিনা জিতে গেল সিপিআইএম! কেন ২০১১ সালে গোটা রাজ্যে পরিবর্তনের বছরে টানা আড়াই বছর লালগড় আন্দোলন চলার পরও জঙ্গলমহলে মাওয়িস্ট কার্যকলাপের এপিসেণ্টার বিনপুরে সিপিআইএম জিতল, এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে রয়েছে কিষেণজির মৃত্যু রহস্য! বিনপুরে ভোটের রেজাল্ট ২০১১ সালে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, কিষেণজির নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে কী চোখে দেখছিলেন জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষের একটা বড়ো অংশ। আমার এখনও বিশ্বাস, বিনপুর কেন্দ্রে এক সময় মাওয়িস্টদের মদতে জেতা চুনিবালা হাঁসদা প্রার্থী না হয়ে তৃণমূলের কেউ প্রার্থী হলে, ওই আসনেও ২০১১ সালে সিপিআইএম হারতো। জঙ্গলমহলের মানুষ ২০১১ সালের নির্বাচনে সিপিআইএমকে হারাতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঝাড়খন্ডিদের জেতাতে চাননি তাদের সঙ্গে মাওয়িস্টদের অতীত সম্পর্কের কারণে।
কিষেণজি মৃত্যু রহস্য
এই বিনপুরেই কয়েক মাস আগে এনকাউণ্টারে মৃত্যু হয়েছে লালগড় আন্দোলনের অন্যতম নেতা শশধর মাহাতোর। বিনপুর কেন্দ্রেই কয়েক মাস আগে ভোটে জিতেছে সিপিআইএম। না, কোনও কিছু থেকেই শিক্ষা নিলেন না কিষেণজি। শিক্ষা তো তিনি নেননি আগের বছর নিজের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে তাঁর যে সমালোচনা হয়েছিল, তা থেকেও। মাওয়িস্ট নেতৃত্ব একটা কথা বারবারই বলেন, ‘জলে যেভাবে মাছ থাকে, সেভাবেই মানুষের মধ্যে মিশে থাকতে হবে আমাদের। সেটাই আমাদের প্রভাব এবং সংগঠন বিস্তারের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক।’
২০১১, রাজ্যে পরিবর্তন উত্তর জঙ্গলমহলে ফের এলেন কিষেণজি। এবং ফের আশ্রয় নিলেন সেই বিনপুরেই। লালগড়ে নয় কিন্তু। হয়তো জানতেন, লালগড়ে তাদের সেই সাংগঠনিক শক্তি নেই। পোড়খাওয়া সংগঠক কিষেণজি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আড়াই বছরে বন্দুকের নল উঁচিয়ে আন্দোলন করেছেন ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে দুর্ভেদ্য সংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি লালগড়ে। হয়তো ভরসা ছিল দীর্ঘ বছর ধরে হাতের তালুর মতো চেনা বিনপুরের জঙ্গলকে, ভরসা ছিল সেখানে স্রেফ খুনোখুনি না করেও মানুষের মধ্যে যে বিশ্বাস গড়ে তোলা গিয়েছিল তার ওপর। কিন্তু পাল্টে যাওয়া বিনপুরকে কি চিনতেন কিষেণজি? চিনতেন সুচিত্রা মাহাতো? খোঁজ রাখতেন, কেন পাল্টে গিয়েছিল বিনপুরের জঙ্গল?
২৪ নভেম্বর, ২০১১। খাবার নিয়ে এক্স পৌঁছলেন বুড়িশোল জঙ্গল লাগোয়া উই ঢিবিটার কাছে। ভয়ে শুকিয়ে আসছে গলা, কত তাড়াতাড়ি যাবেন এলাকা ছেড়ে ভাবছেন। খাবারটা রাখলেন মাটিতে পাতা কম্বলের ওপর। চোখ চলে গেল হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে। সাপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাচ্চা ছেলেটা, আঙুল ট্রিগারে! বুড়ো লোকটা মাথা উঁচু করে তাকাল একবার। চোখে অন্ধকার দেখলেন এক্স। চোখ নামিয়ে নিলেন, দ্রুত ধরলেন ফেরার রাস্তা। মনে ছিল অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দেওয়া জিপিএসটার কথা, কিন্তু ভয়ে ফেলতে পারলেন না জঙ্গলের মধ্যে!
চলবে
(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)
Comments are closed.