আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: শশধর মাহাতোর এনকাউণ্টার নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, কিন্তু সেই প্রশ্নই উঠল কিষেণজির ক্ষেত্রে…
উপসংহার
২০০৯ সালের অক্টোবর মাস। কিছু আদিবাসী মহিলাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। যার বদলা নিতে সাঁকরাইল থানায় ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালালো মাওবাদীরা। অপহরণ করে নিয়ে গেল থানার ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্তকে। কিষেণজি দাবি করেন, আদিবাসী মহিলাদের ছাড়া হলে তবেই মুক্তি দেওয়া হবে ওসিকে। সেই ঘটনায় রাজ্যজুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। তার দু’দিন বাদে, ঝাড়গ্রামের এক সাংবাদিককে সকালে কিষেণজি ফোন করে জানালেন, সেদিনই ছাড়া হবে ওসিকে। কিন্তু পুলিশ পৌঁছে গেছে তাঁদের প্রায় কাছাকাছি। ফোর্স উইথড্র না করা হলে তাঁরা মেরে দেবেন ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্তকে। একই কথা জানিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই একাধিক বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে ফোনে ইন্টারভিউ দেন কিষেণজি। ঝঁকি নিতে পারেনি প্রশাসন। ফোর্স তুলে নেওয়া হয়।
সারাদিন ঝাড়গ্রামে অপেক্ষার পর বিকেলে ওই সাংবাদিকের কাছে ফের ফোন আসে কিষেণজির। বলেন, লালগড়ের বামাল গ্রামের কাছে সংবাদমাধ্যমের সমস্ত প্রতিনিধিকে পৌঁছতে। তড়িঘড়ি ঝাড়গ্রাম শহর থেকে সাংবাদিকদের কয়েক গাড়ির কনভয় রওনা দেয় বামালের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে তাঁরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ফের ফোন করেন কিষেণজি। বলেন, জিরাপাড়া নামক এক জায়গায় গাড়ি ছেড়ে হেঁটে যেতে ভুলাগেঁড়ার দিকে, ওখানে তাঁর লোক থাকবে। সাংবাদিকরা তাই করেন নির্দেশ মতো। পায়ে হেঁটে একটু এগিয়ে তাঁরা দেখেন একাধিক সশস্ত্র স্কোয়াড মেম্বার অপেক্ষা করছেন। সেখানেই রাস্তার ধারে ছিল মাঠ। সেখানে থামানো হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সমস্ত প্রতিনিধিকে। যাঁর সঙ্গে কিষেণজির কথা হচ্ছিল তাঁকে বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত সাংবাদিককে মোবাইল ফোন সেই মাঠেই রেখে যেতে বলেন স্কোয়াড মেম্বাররা। সেই অনুযায়ী একজন বাদে সমস্ত সাংবাদিক সেখানে মোবাইল ফোন জমা রাখেন। তারপর তাঁদের রাস্তা দেখিয়ে পাঁচশো-সাতশো মিটার দূরের ভুলাগেঁড়া প্রাথমিক স্কুলে নিয়ে যান একজন। দিনের আলো তখন পড়ে আসছে। তবে পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। ভুলাগেঁড়া প্রাথমিক স্কুলের মাঠে পৌঁছে অপেক্ষা করতে থাকেন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা।
ভুলাগেঁড়া প্রাথমিক স্কুলের মাঠে তখন অনেক মানুষের ভিড়। আচমকাই গ্রামের দিক থেকে ১০-১২ জনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন কিষেণজি। সঙ্গে ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্ত। সবার মুখ ঢাকা, হাতে রাইফেল। একমাত্র কিষেণজির মুখ খোলা। হঠাৎ করে সঙ্গীদের নিয়ে কিষেণজিকে বেরিয়ে আসতে দেখে নিজেদের আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি কয়েকজন ক্যামেরাম্যান। ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেন কিষেণজি এবং তাঁর সঙ্গীদের। আর এতেই ঘটে ছন্দপতন। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন মাওয়িস্ট পলিটব্যুরো সদস্য এবং সেই সময় দেশের মোস্ট ওয়ান্টেড কোটেশ্বর রাও। তার আগে একাধিকবার পছন্দের সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করেছেন কিষেণজি। কেউই তাঁর মুখের ছবি তোলেননি কখনও। কিন্তু সাঁকরাইলের ওসির মুক্তির জন্য তাঁর অচেনা একাধিক সাংবাদিক এবং ক্যামেরাম্যান সেদিন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কিষেণজির খোলা মুখের ছবি ওঠা মাত্রই ক্যামেরাম্যানদের দিকে তেড়ে আসেন তাঁর সঙ্গীরা। সমস্ত সাংবাদিককে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঠের এক পাশে।
দ্রুত অন্ধকার নামছে জঙ্গলমহলে। অতীন্দ্রনাথ দত্ত কোথায় কেউ জানেন না, তার মধ্যে কিষেণজির খোলা মুখের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যান সহ সমস্ত সাংবাদিকের ওপরই ক্ষুব্ধ সশস্ত্র মাওবাদীরা। কী হবে কেউ জানে না। মাঠের পাশে ততকক্ষণ কয়েকজন ক্যামেরাম্যানকে চিহ্নিত করে নিল ডাউন করিয়েছেন কিষেণজির সঙ্গীরা। অজানা আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে আছেন বাকি সাংবাদিকরা। টেনশনে সময় কাটছে না যেন। অতীন্দ্রনাথ দত্তকে ছাড়ার ব্যাপারে যে সাংবাদিকের সঙ্গে সকাল থেকে কথা হচ্ছিল কিষেণজির, যিনি একমাত্র অনুমতি পেয়েছিলেন মোবাইল ফোন নিয়ে সেখানে যাওয়ার, আচমকা তাঁর নাম ধরে ডাকলেন মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য। তারপর কী ঘটল? তা লিখব সেই সাংবাদিক আমাকে পরে যা জানিয়েছিলেন।
‘কিষেণজি আমার নাম ধরে ডাকার পর একটু চমকে উঠি। তারপর এগিয়ে যাই তাঁর দিকে। দেখি, সমস্ত ক্যামেরাম্যানকে নিল ডাউন করে রাখা হয়েছে। পাশে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে তিন-চারজন। পাশে দাঁড়িয়ে কিষেণজি। আমাকে বললেন, “তোমাদের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই? আমার মুখ খোলা, তাও ছবি তুলে নিল।”
আমি কী বলব, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ফের বললেন, তাঁর খোলা মুখের ছবি তুলে অন্যায় করেছে ক্যামেরাম্যানরা। এরপর কিষেণজি আমাকে ক্যামেরাম্যানদের বলতে বললেন তাঁর ছবি ডিলিট করে দিতে। সবাই সিনিয়র ক্যামেরাম্যান। আমি বললাম, আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা রাখা উচিত। আর আমাকে কিছু বলতে হয়নি, কিষেণজির এই কথা শুনে একজন ক্যামেরাম্যান সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা খুলে ছবি ডিলিট করতে শুরু করলেন। দেখাদেখি বাকিরাও। এক সেকেন্ডও হয়নি, কিষেণজি ফের বললেন, ঠিক আছে ছাড়ুন, আমার ছবি দিয়ে কীই বা করবে? আমাকে তো পুলিশ জীবিত ধরতে পারবে না, মরতেই তো হবে একদিন! এরপর সব ক্যামেরাম্যানকে উঠে পড়তে বলেন কিষেণজি।’
২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় কিষেণজির। যিনি মৃত্যুর প্রায় দু’বছর আগে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে ছাড়ুন, আমার ছবি দিয়ে কীই বা করবে? আমাকে তো পুলিশ জীবিত ধরতে পারবে না, মরতেই তো হবে একদিন!’
কিষেণজি মৃত্যু রহস্য আর দীর্ঘায়িত করার কোনও উদ্দেশ্য আমার ছিল না। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া লালগড় আন্দোলন এবং সেই সময় ঘটা আরও বহু ঘটনাই হয়তো এই লেখায় যুক্ত করা যেত। যে ঘটনাগুলির সাক্ষী আমার মতোই আরও অনেক সাংবাদিক। অনেক সাংবাদিক আছেন, যাঁরা এই আন্দোলনের আড়াই বছরে আমার থেকে অনেক বেশি সময় জঙ্গলমহলে যাতায়াত করেছেন। আমার থেকে অনেক বেশি খবর করেছেন এই ধারাবাহিক আন্দোলন নিয়ে। তাঁদের মধ্যে চিত্রদীপ চক্রবর্তী, সপ্তর্ষি সোম, প্রণব মন্ডল, সুরবেক বিশ্বাস, সঞ্জয় ভদ্র, সৌগত মুখোপাধ্যায়, রাজর্ষি দত্তগুপ্ত, সম্বিত পালের নাম না করলেই নয়। এর বাইরেও আছেন আরও অনেকে, বিশেষ করে অমিতাভ রথ, সৌরভ চৌধুরীর মতো ঝাড়গ্রামের অনেক সাংবাদিক, যাঁদের জীবনের সমস্ত রুটিন চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল এই আড়াই বছরে। লালগড় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সাংবাদিকরা দিনরাত পরিশ্রম করে জঙ্গলমহলে অ্যাসাইনমেন্ট করেছেন, তাঁদের সবাইকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। কারণ, তাঁদের নানা খবর আমাকে ঋদ্ধ করেছে বিভিন্নভাবে।
যাঁদের সাক্ষী হিসেবে এই লেখায় আমি হাজির করেছি, তার বাইরেও বহু ব্যক্তি আছেন, কেউ হয়তো পুলিশ অফিসার, কেউ সাধারণ মানুষ, কেউ রাজনৈতিক নেতা, যাঁদের নাম তাঁদের অনুরোধে উল্লেখ করতে পারছি না, তাঁদেরও ধন্যবাদ জানাতে চাই লেখার শেষ প্রান্তে এসে।
জঙ্গলমহলে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা কিষেণজি মৃত্যু রহস্য এখানেই আমার শেষ করার ইচ্ছে ছিল। ইন ফ্যাক্ট এই লেখা যখন আমি লিখেছি, এখানেই তা শেষ ছিল। সেভাবেই লেখা পাঠানো হয়েছিল প্রকাশককে বইয়ের জন্য। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা কাটলে তা হয়তো বই হিসেবে প্রকাশিত হবে। কিন্তু এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার সময় অনেক পাঠকের কাছ থেকে নানারকম প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। যা বই হিসেবে প্রথমে প্রকাশিত হলে হয়তো পাওয়া সম্ভব হোত না। যেহেতু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাৎকক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া যায়, বহু পাঠক এই লেখার বিভিন্ন পর্বে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। প্রতিটি মন্তব্য আমি লেখক হিসেবে গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। এবং প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ এই দীর্ঘ লেখা পড়ে মতামত জানানোর জন্য। যিনি ভালো বলেছেন, কিংবা যিনি সমালোচনা করেছেন, দুইই আমার মতো সাংবাদিকের কাছে বড়ো প্রাপ্তি।
অনেকের মন্তব্য থেকে আমার একটা ধারণা হয়েছে, কিষেণজির মৃত্যুর মধ্যে কোনও রহস্য আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন, ভুয়ো এনকাউণ্টারে মাওয়িস্ট নেতার মৃত্যু হয়েছে। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং দু’দিন আটকে রেখে কিষেণজিকে মেরে দেওয়া হয়েছে। লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সাংবাদিক হিসেবে এই তত্ত্ব কোনও দিন আমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। জঙ্গলমহলে বারবার গিয়ে আমার কখনও মনে হয়নি, ব্যাপারটা এত সহজ, সরল।
আমার মনে হয়েছে, দেশের যে সমস্ত রাজ্যে পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী কথায়-কথায় গুলি চালায়, তেমন রাজ্যে না হয়ে পশ্চিমবঙ্গে কিষেণজির মৃত্যুতে বাড়তি তাৎপর্য রয়েছে। মনে হয়েছে, এটা সত্যিই সত্যিই রহস্য যে, কীভাবে লালগড় আন্দোলন এমন ব্যাপক আকার ধারন করল, কেন তা ধরে রাখা গেল না, কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ রাজ্যে মাওবাদীরা এমন প্রভাব বিস্তার করল এবং কীভাবে তারা জনবিচ্ছিন্ন হল? এই সবের ওপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি আমি।
কিন্তু যেহেতু কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, তাই একটি অতিরিক্ত পর্ব এই লেখায় আমি যুক্ত করছি, যা মূল লেখায় ছিল না। কিন্তু সেই পর্বে যাওয়ার আগে সমস্ত পাঠকের কাছে একটি আবেদন করব, কিষেণজির মৃত্যু, মানে এনকাউণ্টার পর্ব নিয়ে কারও কাছে যদি নির্দিষ্ট কিছু তথ্য থাকে, নিজস্ব কোনও বিশ্লেষণ থাকে, তবে তিনি তা লিখিত ভাবে আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। সেই লেখা হতে হবে অন্তত ৭০০-৮০০ শব্দের। তাঁর লেখা অপরিবর্তিত ভাবে আমাদের পোর্টালে প্রকাশ করব। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হয়তো এই লেখাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। তাঁর মত বা তথ্য আমার বিশ্বাসের থেকে ভিন্ন হতে পারে, কিংবা একও হতে পারে, সম্পূর্ণ উল্টোও হতে পারে, তাতে কিছু এসে যায় না। প্রত্যেকের লেখা The Bengal Story পোর্টালে প্রকাশিত হবে।
লেখা পাঠানোর ই-মেইল আইডি: [email protected]
কিষেণজির মৃত্যু: ময়নাতদন্ত
মৃত্যুর প্রায় দু’বছর আগে বহু সাংবাদিক এবং সহযোদ্ধার সামনে সেই যে কিষেণজি বলেছিলেন, ‘আমাকে তো পুলিশ ধরতে পারবে না, মরতেই তো হবে একদিন’, এও তাঁর এক অসম সাহসেরই পরিচয়। দুর্দান্ত যোদ্ধা কিষেণজির নিজের ওপর এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, তিনি জানতেন, তাঁকে গ্রেফতার করা অসম্ভব। যে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের ওপর ভরসা করেই জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন বিনপুরে।
২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় এনকাউণ্টার শেষ করে পুলিশ বাহিনী যখন কিষেণজিকে নিয়ে ব্যস্ত, ততকক্ষণে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকটাই পালিয়ে গেছেন সুচিত্রা মাহাতো। পেটে গুলি নিয়ে সুচিত্রা হাজির হন এক পরিচিতের বাড়িতে। সেই ব্যক্তির সাহায্যে পালিয়ে যান সেই রাতেই। অন্যদিকে, একাই অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে একজনের কাছে নিজের বন্দুক জমা রেখে রাতের অন্ধকারে রাজ্য ছাড়েন মঙ্গল মাহাতোও। পরে মঙ্গল মাহাতোর বন্দুক আর সুচিত্রার ফেলে যাওয়া লেডিজ ব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ সেটা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল, এই এনকাউণ্টারের এক সপ্তাহের মধ্যে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মুখোমুখি হন কিষেণজির সেন্ট্রি মঙ্গল মাহাতো। সুচিত্রাকে নিয়ে কিছুটা সংশয় হয়তো তৈরি হয়েছিল মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্বের কয়েকজনের মধ্যেও, কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তে কঠিন জেরার মুখে পড়েন মঙ্গল। তাঁর মুখে ২৪ নভেম্বর এবং তার চারদিন আগে থেকে ঘটা সমস্ত ঘটনা শুনে মাওয়িস্ট নেতৃত্ব নিশ্চিত হন, পুরো এনকাউণ্টার নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা কিষেণজির মতো নেতার মৃত্যুর পর এটাই যে, দেশের কোনও আদালতে মাওয়িস্ট মনোভাবাপন্ন কোনও ব্যক্তি বা কোনও মানবাধিকার সংগঠন ভুয়ো এনকাউণ্টারের মামলা করেননি। যেখানে তার আগের বছরই অন্ধ্রপ্রদেশ-মহারাষ্ট্র সীমান্তে এনকাউণ্টারে আর এক মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতা রাজকুমার বা আজাদের মৃত্যুর পর একাধিক মামলা হয়। সেই মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত।
কিন্তু কিষেণজির মতো এক দুর্দান্ত সংগঠক, সাহসী নেতার মৃত্যুর পর প্রথম দু’তিন দিন ভুয়ো এনকাউণ্টারের অভিযোগ তুলেও পরে কেন চুপ করে গেলেন মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্ব? শুধুই কি মঙ্গল মাহাতোর বয়ান?
কেউ কেউ অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন সুচিত্রার মাহাতোর বিরুদ্ধে। কিন্তু কেউ যদি পুলিশকে খবর দিয়ে কিষেণজিকে ধরিয়েই দেন, তিনি কি নিজে সেখানে থাকবেন এনকাউণ্টারের সময়? যেখানে তাঁর নিজেরও মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে? সুচিত্রার পেটে গুলি লাগা এবং কোথায়, কবে অস্ত্রোপচার হয়েছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্বও আর তাঁর সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেননি।
কিন্তু শুধু মঙ্গল মাহাতোর বয়ানে বা সুচিত্রার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সত্যসত্য বিচার করেই তো কিষেণজির মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতার মৃত্যুর ইন্টারনাল এনকোয়ারি শেষ হয়ে যায় না। আমরা বহিরাগতরা অনেকেই হয়তো বিস্তারিত জানি না, কীভাবে প্রতিটা ছোট-বড়ো ঘটনার মূল্যায়ন করেন মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্ব। কিষেণজির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পরিবারের কোনও সদস্য ভুয়ো এনকাউণ্টারের অভিযোগ করলেও, প্রাথমিক খোঁজখবর নিতে মাওয়িস্ট নেতৃত্বের সময় লেগেছিল, চার-পাঁচ দিন, বিস্তারিত ইন্টারনাল তদন্ত শেষ করতে লাগে প্রায় এক মাস।
কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #২০
থানা: জামবনি
আনন্যাচারাল ডেথ কেস নম্বর: ১৩/১১, তারিখ- ২৫/১১/১১
২৪ নভেম্বর ২০১১, সাত-আট মিনিটের গুলির লড়াই শেষ হল বুড়িশোলের জঙ্গলে। মিনিট পনেরো-কুড়ি মাটিতে শুয়েই অপেক্ষা করলেন জওয়ানরা। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করেছে বাইরের ফোর্স। ক্যানেলের পাশে অপেক্ষা করা সিনিয়র অফিসাররাও পৌঁছলেন সেখানে। মাঠ থেকে জঙ্গলের ভেতরে দেড়শো-দুশো মিটার ঢুকেই উই ঢিবিটা। পাশে একদিকে কাৎ হয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত মৃতদেহ।
পরনে নীল রঙের ফুল শার্ট, তার ওপরে ধূসর জ্যাকেট। জ্যাকেটের চেন খোলা, শার্ট শতচ্ছিন্ন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীরের সামনের দিক। ফুল প্যান্টেও রক্ত লেগে, তবে তুলনায় কম। পাশে পড়ে আছে এ কে ৪৭ রাইফেল। যেভাবে পড়ে আছে নিহত মাওয়িস্ট নেতার দেহ তাতে পরিষ্কার, পালানোর কোনও চেষ্টা করেননি তিনি। প্রায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহের পিছনের দিকে, অর্থাৎ পিঠে রক্তের কোনও দাগ নেই। মৃতদেহ পড়ে থাকার ধরন থেকে খোলা চোখে পরিষ্কার, অসমসাহসী যোদ্ধা কিষেণজি জওয়ানদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত।
পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা, ৫৭ কিলোগ্রাম ওজন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়িস্টের পলিটব্যুরো সদস্য কোটেশ্বর রাওয়ের মৃতদেহ মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে পৌঁছল পরদিন, ২৫ তারিখ দুপুর সওয়া তিনটে নাগাদ। তারপরের দিন, ২৬ তারিখ কিষেণজির দেহের ময়নাতদন্ত হল। শরীরে ৩২ টি ক্ষত, অধিকাংশই বুলেট ইনজ্যুরি, কিছু স্প্লিন্টারের। শরীর থেকে বেরোল ছ’টি বুলেট। চার পাতার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমি এখানে পেশ করতে চাই না একটাই কারণে, এই সায়েন্টিফিক এভিডেন্সের গুরুত্ব আদালতে থাকলেও, মানুষের দরবারে ততটা নেই। বরং আমি সংক্ষেপে পেশ করব কিষেণজির ব্যালেস্টিক রিপোর্ট, দু’একটি তথ্য তুলে ধরার জন্য। ব্যালেস্টিক রিপোর্টও হয়তো সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে, কিন্তু তার দু’একটি তথ্য লেখার কারণ, ব্যালেস্টিক রিপোর্ট সাধারণভাবে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের মতো পরিচিত নয়।
কোনও এনকাউণ্টারের ঘটনায় যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকেন, সাধারণত তাঁদের দু’হাতের চারটি জায়গা, গালের দু’দিক এবং শরীরের পিছনের অংশ থেকে GSR বা ‘গান শট রেসিডিউ’ (জিএসআর) সংগ্রহ করা হয়। কী এটা? জিএসআর হচ্ছে গুলি ছোড়ার সময় বন্দুকের ট্রিগারের ওপরের অংশ থেকে বেরনো বারুদের কণা। যা অত্যাধুনিক বন্দুকের নলের সামনের দিকে যে ফুটো থাকে তা থেকেও বেরোয়। যে বন্দুক থেকে যত ফায়ারিং হবে জিএসআর তত বেশি পরিমাণে বেরবে।
এই জিএসআর কালেক্ট করে যে পরীক্ষা হয় তাকে বলা হয়, নিউট্রন অ্যাক্টিভেশন টেস্ট। এটা এতই উন্নতমানের পরীক্ষা যে, তা হয় মূলত ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে।
কিষেণজির শরীরের সাতটি জায়গা থেকে জিএসআর সংগ্রহ করে (ডান হাতের তালুর ভেতরের অংশ, ডান হাতের কনুই থেকে আঙুল, বাঁ হাতের তালুর ভেতরের অংশ, বাঁ হাতের কনুই থেকে আঙুল, ডান গাল, বাঁ গাল এবং শরীরের পিছন) ২৫ নভেম্বর ২০১১ কলকাতায় সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়, যার কেস নম্বর ৪৬/১১, ২৫/১১/১১।
চূড়ান্ত ব্যালেস্টিক রিপোর্টে (রিপোর্ট নম্বর: CFSL (K)/EE/2011(WB))-1295, dated 14.12.2011 সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি জানাল, কিষেণজির ডান গালে এবং বাঁ হাতের তালুর ভেতরের অংশে প্রচুর জিএসআর মিলেছে। বাকি জায়গাগুলোতে অত্যন্ত কম, শরীরের পিছনের অংশে শূন্য।
ডান হাতি ব্যক্তি যখন রাইফেল দিয়ে গুলি চালান, তখন তাঁর ডান গাল বন্দুকের সঙ্গে লেগে থাকে, আর বন্দুকের নলের সামনের অংশ বাঁ হাত দিয়ে শক্ত করে ধরা থাকে। তাই এই দুই জায়গায় সবচেয়ে বেশি জিএসআর মেলে। এই রিপোর্ট জানায়, মৃত ব্যক্তি গুলি চালিয়েছেন কিনা।
কিন্তু পাঠকের দরবারে এই সায়েণ্টেফিক এভিডেন্স পেশ করে আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাই না। কিষেণজির মৃতদেহ পড়ে থাকার ছবি দেখে সেই প্রমাণ প্রাথমিক ভাবেই পেয়েছিলেন মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁরা জানতেন, পালানোর লোক নন অসমসাহসী কোটেশ্বর। তাঁরা জানতেন, সুদক্ষ সংগঠক সারা জীবন নেতৃত্ব দিয়েছেন, কোথাও সহযোদ্ধাদের আড়াল করে পালাননি। একবার জঙ্গলের মধ্যে অসুস্থ এক সহযোদ্ধাকে পিঠে চাপিয়ে সারারাত হেঁটেছিলেন কোটেশ্বর রাও। মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্ব জানতেন, কোটেশ্বরের পিঠে রক্তের দাগ থাকতে পারে না।
মাওয়িস্ট শীর্ষ নেতৃত্ব জানতেন, ভুয়ো এনকাউণ্টার হয়নি ২৪ নভেম্বরের সন্ধ্যায়। তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন ছিল একটাই, গ্রামের মানুষ কেন খবর দিলেন পুলিশকে। যদিও সেই প্রশ্নের উত্তরও জানতেন তাঁরা। আগের বছরই তো তাঁরা কোটেশ্বরকে বলেছিলেন, এভাবে ব্যক্তি হত্যা ঠিক হচ্ছে না, মানুষের মধ্যে খারাপ বার্তা যাচ্ছে। সংগঠনের ক্ষতি হচ্ছে। ঠিক করেছিলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে এর জন্য ক্ষমা চাইবেন তাঁরা। কিন্তু সেই সময় আর মেলেনি, কিষেণজির মৃত্যুই প্রমাণ করেছে, সংগঠনের কতটা ক্ষতি তাদের জঙ্গলমহলে হয়েছে।
একটি শেষ তথ্য শুধু লিখতে চাই, তা হয়তো অনেকের জানা নেই। সেই এনকাউণ্টারে যেমন কিষেণজি তাঁর সঙ্গীদের পালিয়ে যেতে দিয়ে নিজেই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনই এক ঘটনা ঘটান এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। তিনি ঝাড়গ্রামের অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া, যাঁর নেতৃত্বে সেদিন অপারেশন হয়েছিল। এনকাউণ্টার পর্ব মিটে যাওয়ার পর রাত সাড়ে ১০ টা নাগাদ আইপিএস অফিসার অলোক রাজোরিয়া নিজে কিষেণজির মৃত্যুর এফআইআর লিখেছিলেন। এফআইআরে সইও তাঁরই। এও এ রাজ্য তো বটেই, দেশের ইতিহাসেই এক বিরলতম ঘটনা, যেখানে একজন আইপিএস পদমর্যাদার উচ্চপদস্থ অফিসার নিজে এফআইআর করছেন। যে কোনও ঘটনায় স্থানীয় থানার কোনও সাব ইন্সপেক্টর এফআইআর করেন, এটাই যেখানে রেওয়াজ, সেখানে অন্যের ঘাড়ে বন্দুক না রেখে আইপিএস অফিসারের এফআইআর করাও এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।
শেষ
শেষে ফের আবেদন, কিষেণজির এনকাউণ্টার, যা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছেন, তা নিয়ে কারও কাছে নির্দিষ্ট তথ্য থাকলে তা তিনি লিখতে পারেন। সেই লেখা আমরা প্রকাশ করব।
লেখা পাঠানোর ই-মেইল আইডি: [email protected]
Comments are closed.