কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #পাঁচ

আইপিএস সুনীল কুমার: কিষেণজির খোঁজ  

সুনীল কুমার আইপিএস অফিসার। ২০১৬ সালের শেষে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর কলকাতার অফিসে। লালগড় আন্দোলন শুরু হল ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে। সেই সময় থেকে ২০১১ সালের নভেম্বরে কিষেণজির মৃত্যু পর্যন্ত পাক্কা তিন বছর, এই সময়জুড়ে একাধিক পুলিশ অফিসার কাজ করেছেন পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামে। আবার রাজ্য পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) কিংবা কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সও (এসটিএফ) বিভিন্ন সময় লালগড়ের মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ে একই সঙ্গে অফিশিয়ালি এবং আনফিশিয়ালি তদন্ত করেছে। লালগড়ের মাওবাদী মুভমেন্ট নিয়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন এমন দু’-তিনজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলি আমি। যেহেতু তাঁরা সকলেই এখনও চাকরি করছেন, তাই আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁদের একটাই শর্ত ছিল, লেখায় তাঁদের নাম ব্যবহার করা যাবে না। এই দু’তিনজন পুলিশ অফিসার আমাকে যা বলেছেন হুবহু তাঁদের নামেই লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় কাল্পনিক একটা নাম বাছতে হল। ধরা যাক সেই কাল্পনিক নাম সুনীল কুমার। আসলে যে দু’তিনজন অফিসারের সঙ্গে আমি কথা বলেছি তাঁদের বক্তব্যই আমি লিখব সুনীল কুমারের নামে। নাম পরিবর্তিত, ঘটনা নয়।
আমি যখন সুনীল কুমারের সঙ্গে কথা বললাম তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বয়স পাঁচ বছরের বেশি।
‘২০০৯ সালের মোটামুটি শুরু থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, লালগড় আন্দোলনের নেতৃত্বে বড়সড় কেউ আছে। শালবনিতে চিফ মিনিস্টারের কনভয়ে ব্লাস্ট হল। পুলিশ গ্রামে গেল তল্লাশি চালাতে, কয়েজনকে মারধোর করল, আর স্পন্টেনিয়াস মুভমেন্ট শুরু হয়ে গেল, ইটস নট সো ইজি। তাছাড়া গ্রামের কয়েকজন মানুষ মিলে পুলিশ, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখাতেই পারেন, কিন্তু সেটাকে একটা মাস মুভমেন্টে কনভার্ট করা সোজা নেই। শালবনি ব্লাস্টের কয়েক দিন বাদেই যখন পুলিশ সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি তৈরি হল এবং তারা থানায় গেল ডেপুটেশন দিতে, তখনই তাদের ডিমান্ডের প্যাটার্ন দেখে বোঝা গিয়েছিল মাওয়িস্টরা এর পেছনে আছে। কিন্তু বোঝা যায়নি এর লিডারশিপ কে দিচ্ছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম শশধর মাহাতোর কথা। শশধর তখন লালগড়ে মাওয়িস্টদের প্রমিনেন্ট লিডার। কিন্তু দু’এক মাসের মধ্যেই মুভমেন্টের ক্যারেক্টার দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল, আরও ম্যাচিওরড ব্রেন আছে এই লালগড় মুভমেন্টের পেছনে। এটা শুধুমাত্র শশধর মাহাতো, তাঁর স্ত্রী সূচিত্রা বা স্থানীয় মাওয়িস্টদের ব্যাপার নয়। মুভমেন্টের কিছু কিছু সিম্পটম দেখে মনে হচ্ছিল, এর সঙ্গে ছত্তিসগঢ়, ঝাড়খন্ডের লিবারেটেড জোনের মাওয়িস্ট অ্যাক্টিভিটির মিল আছে। কিন্তু মাওয়িস্টদের কোন লেভেলের লিডারশিপ এখানে অপারেট করছে বোঝা যায়নি। ইন ফ্যাক্ট শুরুতে আমরা জানতে পারিনি, মাওয়িস্ট পলিটব্যুরো মেম্বার কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি ঝাড়গ্রামে এসেছেন এবং এই মুভমেন্টের প্ল্যানিং তাঁরই। এখানে কিষেণজির থাকার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ আমরা প্রথম হাতে পেলাম মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে। সময়টা একটু এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে লোকসভা ভোটের আগে।’
‘কীভাবে?’
‘বেলপাহাড়ি এলাকার চাকাডোবার কাছাকাছি প্রায় পাশাপাশি দুটো গ্রাম লালজল এবং মাজুগাড়া। পিচ রাস্তার দু’দিকে। ২০০৯ এর লোকসভা ভোটের বেশ কিছুদিন আগে এক দুপুরে ওই এলাকা থেকে সিপিআইএমের দুজন সাধারণ লিডারকে অপহরণ করল মাওবাদীরা। তখন বেলপাহাড়ি, বিনপুর, লালগড়ে মাওয়িস্টদের প্রভাব প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। অপহরণের কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা খবর পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর ফোর্স পাঠালাম। জঙ্গলে সার্চ অপারেশন শুরু হল। এক দেড় ঘন্টার মধ্যে ফোর্স জঙ্গলের অনেকটাই ঘিরে ফেলল। তখন দুপুর। তাছাড়া তখনও বর্ষা নামেনি, জঙ্গল ছিল অনেকটাই ফাঁকা। ক্লিয়ার ভিসিবিলিটি ছিল। মাওবাদী অপহরণকারী দলটার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল ফোর্স। মাওয়িস্টরাও আইডিয়া করতে পারেনি এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে আমরা হিউজ ফোর্স জঙ্গলে মোবিলাইজ করতে পারব। যদিও তার একটা কারণ ছিল। যখন ওরা ফোর্সের মুভমেন্ট টের পেল তখন আমরা ওদের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এক্সচেঞ্জ অফ ফায়ার হল। টানা প্রায় দু’ঘন্টা চলল গুলির লড়াই। বাধ্য হয়ে অপহৃত দুজন সিপিআইএম লিডারকে জঙ্গলে ফেলে আরও ভেতর দিকে মুভ করে গেল মাওয়িস্ট গ্রুপটা। বিকেল নাগাদ অপহৃত দুজনকেই জখম অবস্থায় উদ্ধার করলাম আমরা। মাওবাদীরা ওদের ফেলে পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু পালানোর সময় ওরা দুটো ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল। সেটা অবশ্য আমরা সেই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি, বুঝেছিলাম কিছুক্ষণ বাদে মোবাইল ফোন ইন্টারসেপ্ট করে।
জঙ্গলের ভেতরে যখন আমাদের ফোর্সের সঙ্গে মাওবাদীদের গুলির লড়াই চলছে, সেদিনই বিকেলে তার থেকে মাত্র দু-তিন কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি বাঁকুড়া হাইওয়েতে জনসাধারণের কমিটির (পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি, যা ২০০৮ সালের নভেম্বরে লালগড়ে তৈরি হয়) একটা মিছিল ছিল। তখন লোকসভা ভোট আসছে। ঝাড়গ্রামের নানা জায়গায় প্রায় রোজ জনসাধারণের কমিটির মিছিল লেগেই থাকত। সেদিনের ওই মিছিলের জন্য বেলপাহাড়ি-বাঁকুড়া মেন রোডে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। এর জন্য আমাদের একটা সুবিধে হয়েছিল সেদিন। জঙ্গলের ভেতরে মাওয়িস্টদের সঙ্গে এনকাউন্টার শুরু হওয়া মাত্রই মিছিলের জন্য ডেপ্লয় করা রাস্তার ফোর্সকেও আমরা অ্যালার্ট করলাম। কারণ, জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ের সময়ই আমাদের মনে হচ্ছিল, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ স্কোয়াড মেম্বারকে গ্রেফতার করা সম্ভব। অপহৃত দু’জন সিপিআইএম লিডারকে উদ্ধার করার পরে জঙ্গলে সার্চ অপারেশন শুরু হয়। যেহেতু জঙ্গলে ফোর্স ঢুকে গিয়েছিল এবং রাস্তাতেও পুলিশ ছিল ওরাও বুঝতে পারছিল না কোনদিকে পালাবে। কারণ, রাস্তার ফোর্সও আস্তে আস্তে জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করছে তখন। আমাদের টার্গেট ছিল, যা করার দিনের আলোতেই করতে হবে। একবার সন্ধে নেমে গেলে মাওয়িস্টরা ফেভারেবল সিচুয়েশনে চলে যাবে।
আরও ঘন্টাখানেক পর, বিকেল প্রায় চারটে। মেদিনীপুর শহরে পুলিশের মোবাইল ট্র্যাকিং সিস্টেমে আমরা প্রথম ফোন কল ইন্টারসেপ্ট করলাম। সেই সময় গ্রামের ভেতরে আমাদের হিউম্যান সোর্স সেভাবে ডেভেলপ না করলেও নানা সূত্র থেকে পাওয়া কিছু ফোন নম্বর ধরে আমাদের মোবাইল ট্র্যাকিং চলত। ওই এলাকার এমনই সন্দেহজনক কিছু নম্বর আমরা ট্র্যাক করতে শুরু করেছিলাম এনকাউন্টার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। হঠাৎই একটা ফোন কল হল ওই অপারেশন স্পটের টাওয়ার লোকেশন থেকে। একজন ফোন করল। দু’তিনবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল এক মহিলা।
‘দিদি, আমরা মাজুগাড়া জঙ্গলে আটকে গিয়েছি। পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। এনকাউন্টার হয়েছে। এখন কী করব?’
‘কোথায় তোমরা? ক’জন আছ?
‘পাঁচজন আছি। পুলিশ জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। একদম কাছাকাছি আছে কোথাও। রাস্তার দিকে গিয়েছিলাম, ওদিকেও পুলিশ আছে।’
‘রাস্তার দিকে যাওয়ার দরকার নেই, ফোর্স আছে। পারলে আস্তে আস্তে কাঁকড়াঝোড়ের দিকে যাও। আর সাবধানে। বিকাশরা কোথায়।’
‘ওরা ঠিক আছে দিদি। আমরা দুটো গ্রুপে ভাগ করে আলাদা হয়ে গেছি। ফোর্সটা আমাদের দিকে চলে এসেছে।’
‘আচ্ছা। পুলিশ ফায়ারিং করলেও, একদম মুখোমুখি না হলে গুলি চালাবে না।’
জাস্ট ৩০-৪০ সেকেন্ডের কথার পর ফোন কেটে গেল। আমরাও বুঝে গেলাম ফোর্স ঠিক জায়গায় আছে। সঙ্গে সঙ্গে খবর পাঠানো হল ফোর্সের কাছে। রাস্তার আরও ফোর্সকে জঙ্গলে ঢোকানোর ডিসিশন হল। তখনও কিছু সময় আছে হাতে। দিন তখন অনেকটাই বড়। জঙ্গলে অপারেশনের এটা একটা বড় সুবিধে। আধ ঘন্টা বাদে আবার ফোন। একই লোক আগের নম্বর থেকেই ফোন করল ওই মহিলাকে।
‘দিদি, এদিকেও পুলিশ আছে। আমরা গুলি চালাইনি। কিন্তু পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। কী করব?’
বুঝতে পারলাম, পাঁচজনের দলটা আটকে পড়েছে। বারবার ফোন করে জানতে চাইছে কী করবে? এই ফোনটা আসার পর দু’পাঁচ সেকেন্ড মহিলার দিক থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই। আমরা বুঝতে পারছি না, ওই মহিলা কে, যাকে ওরা বারবার ফোন করে জানতে চাইছে কী করতে হবে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ইমপরটেন্ট কেউ হবে। ফোন ট্র্যাকিং মনিটরিং সিস্টেমে দু’জনেরই এক টাওয়ার লোকেশন দেখাচ্ছে।
পাঁচজনের দলটাকে মহিলা কী নির্দেশ দেয় জানার জন্য অপেক্ষা করছি, হঠাৎ ওদিক থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ। মহিলার বদলে ভারী গলায় একজন লোক কথা শুরু করল পাঁচজনের ওই দলটার সঙ্গে। বুঝলাম, কী করবে বুঝতে না পেরে তার সঙ্গে থাকা সিনিয়ার কোনও নেতাকে ফোনটা দিয়েছে ওই মহিলা। মোটামুটি স্পষ্ট বাংলা, ভারী গলায় কথা শুরু করল লোকটা। বলল, ‘অন্ধকার হয়ে গেছে, জঙ্গলে বেশি মুভ করার দরকার নেই। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ এমনিই বেরিয়ে যাবে। আরও দেড়-দু’ঘন্টা ওখানেই ওয়েট কর, তারপর সাবধানে কাঁকড়াঝোড়ের দিকে চলে যাবে। খুব দরকার না হলে গুলি চালাবে না।’ লোকটা সবকটা শব্দ বাংলায় বললেও গলায় একটা টান স্পষ্ট। পরে বুঝেছিলাম, ওই লোকটাই কিষেনজি, কোটেশ্বর রাও। ওদের লোকেশন দেখাল নিগুড়িয়া মোবাইল টাওয়ার। ঝাড়গ্রামে কিষেণজির থাকার প্রথম প্রমাণ আমরা সেদিন রাতে নিশ্চিতভাবে পেলাম। যে মহিলা মোবাইল ফোনটা কিষেণজিকে দিয়েছিল কথা বলতে তার পরিচয় আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভারী গলার ওই লোকটাই যে কিষেণজি তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। আমাদের এক স্পেসিফিক সোর্সকে ওই টেলিফোনের গলা শোনানো হল, সে কনফার্ম করল। তারপর আপনাদের এবং অন্য চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় এই গলাই আমরা শুনেছি বারবার।’
‘তারপর কী হল?’
‘সেদিন মাওবাদীদের কাউকেই আমরা ধরতে পারিনি। রাত বেড়ে যাওয়ায় ফোর্স বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় জঙ্গল থেকে। পাঁচজনের দলটা কাছাকাছির মধ্যেই আছে, রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, বোঝার পরও আমরা ঝুঁকি নিতে পারিনি। প্রথমত, জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা পুলিশের জানা ছিল না। ফোর্স ট্র্যাপড হয়ে যেতে পারত। তাছাড়া ওদের দু’জন, তিনজনকে ধরতে গিয়ে আমাদের বেশি ক্যাজুয়ালটি হতে পারত। আর সেই পরিস্থিতিতে ভোটের আগে সেটা পুরো ফোর্সের মনোবলের পক্ষে খারাপ হোত। তাই আরও কিছুক্ষণ দেখে আমরা ফোর্সকে জঙ্গল থেকে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সেদিনই শুরু হয়ে গেল কিষেণজিকে গ্রেফতারের ব্লু-প্রিন্ট তৈরির কাজ।
ইন ফ্যাক্ট কিষেণজি এবং তার বাহিনীর হাতে আমরা জঙ্গলের ভেতরে ট্র্যাপড হয়েও গিয়েছিলাম তার কয়েক মাস বাদেই। লোকসভা ভোটের পরে। তখন সেন্ট্রাল ফোর্সও পৌঁছে গিয়েছে এলাকায়।
২০০৯ সালের জুলাই কিংবা অগাস্ট হবে। ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে, কিষেণজিই লালাগড় মুভমেন্টের নেতৃত্বে। কয়েকবার প্রেস কনফারেন্সও করে ফেলেছেন। একদিন সকাল ১০টা-সাড়ে ১০টা নাগাদ অনেক সাংবাদিক মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম থেকে লালগড়ের দিকে মুভ করতে শুরু করে। কেন এতজন সাংবাদিক যাচ্ছে একসঙ্গে? কিছুক্ষণের মধ্যেই সোর্স মারফত খবর পেলাম, কিষেণজি ইন্টারভিউ দেবেন। তাই মিডিয়াকে ফোন করে ডাকা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স রেডি করা হল। সাংবাদিকদের মুভমেন্ট ট্র্যাক করলেই কিষেণজি এবং মাওবাদীদের কোর গ্রুপকে লোকেট করা যাবে। কোন কোন সাংবাদিকের সঙ্গে কিষেণজি কিংবা অন্য মাওয়িস্ট লিডাররা প্রায় রোজ কথা বলতেন তাও আমরা জানতাম। কিন্তু সেদিন কিষেণজির ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা জানতে পেরে আমরা প্ল্যান করলাম, সাংবাদিকরা যেদিকে যাবে তার কাছাকাছিও কোথাও ফোর্স পাঠানো হবে না। সাংবাদিকদের ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ফোর্সের মুভমেন্ট শুরু হলে কিষেণজির কাছে তার খবর ঠিক পৌঁছে যাবে। ওরা সতর্ক হয়ে যাবে। মাওবাদীরা ভাবতে পারে, কোনও সাংবাদিক পুলিশকে খবর দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে তারা আর সাংবাদিকদের বিশ্বাস করবে না। আমরা চাইছিলাম, সাংবাদিকদের সঙ্গে মাওবাদীদের ভালো সম্পর্কটা বজায় থাকুক। সাংবাদিকদের সঙ্গে মাওবাদীদের ভালো সম্পর্ক পরে আমাদের অনেক কাজে দিয়েছে।
সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টা-একটা নাগাদ আমরা কিষেণজির লোকেশন বুঝে ফেলেছিলাম। যে জায়গায় কিষেণজি সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করেন তা চিহ্নিত করার পর আমরা ম্যাপ নিয়ে বসি। সেদিন বড়পেলিয়া (লালগড় থানা-কাঁটাপাহাড়ি রাস্তার মাঝামাঝি বড়পেলিয়া মোড়) দিয়ে সাংবাদিকরা জঙ্গলে ঢুকেছিল কিষেণজির সঙ্গে দেখা করতে। বড়পেলিয়া মোড় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের ভেতরে একটা জায়গায় সাংবাদিকদের মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন দুপুর ১২টা। সাংবাদিকরা পৌঁছানোর আধ ঘন্টার মধ্যে ওই লোকেশন চিহ্নিত করে ফেলি আমরা। আর সঙ্গে সঙ্গে ফোর্সকে মুভ করানো হয় ঠিক উল্টোদিকের লালগড় থেকে ধেড়ুয়া যাওয়ার রাস্তায়। আমরা নিশ্চিত জানতাম, ইন্টারভিউ দিয়ে কিষেণজি দলবল নিয়ে আর লালগড়ের দিকে যাবে না। কারণ, বড়পেলিয়া, কাঁটাপাহাড়ি এলাকায় সাংবাদিকদের অনেক গাড়ি রয়েছে। বাইরের লোক রয়েছে। মাওবাদীদের পক্ষে এটা ভাবা খুব স্বাভাবিক ছিল, যেহেতু লালগড়ের দিকে এত সাংবাদিক এবং বাইরের লোকের মুভমেন্ট হচ্ছে, ফোর্সও কিছু সন্দেহ করে সেদিকে চলে আসতে পারে। মাওবাদীরা এমনটা ভাবতে পারে আন্দাজ করে আমরা ফোর্স পাঠালাম পুরো উল্টোদিকে। লালগড়-ধেড়ুয়া রাস্তার দিকের জঙ্গলে। পুরোপুরি চান্স নেওয়া। মিলে গেলে ভাল, নয়তো কিছু করার নেই।
সেদিনই বিকেলে কিষেণজির নেতৃত্বে মাওবাদীদের সঙ্গে আমাদের প্রথম এনকাউন্টার। বিকেল ৫টা নাগাদ। জঙ্গলে যে ফোর্স লুকিয়ে অপেক্ষা করছে তা কিষেণজি আন্দাজ করতে পারেননি। দূর থেকে মাওয়িস্টদের মুভমেন্ট আন্দাজ করে পুলিশ গুলি চালায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওরাও পালটা গুলি চালায়। কিষেণজিদের বেশ কিছুটা পেছনে মাওবাদীদের আরও একটা দল ছিল। সেটা আমাদের জানা ছিল না। কিষেণজি পেছনের দলটাকে নির্দেশ দেন, পুলিশকে অ্যাটাক করতে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাওবাদীদের অন্য দলটা পেছন থেকে আমাদের অ্যাটাক করে। দু’দিকে মাওবাদী স্কোয়াড, মাঝখানে পড়ে যায় ফোর্স। এটাও মাওয়িস্টদের জঙ্গলে মুভ করার একটা ট্যাকটিক্স। সব সময় ছোট ছোট দলে মুভ করা। লালজল, মাজুগাড়াতেও আমাদের একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে মাওয়িস্টরা কাউন্টার অ্যাটাক না করলেও এদিন ওরা তাই করল। কিষেণজির মতো লিডার রয়েছে বলেই ওরা হয়তো কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি।
আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে। কিষেণজিকে ধরার একটা চান্স ছিল। কিন্তু পেছন থেকে কাউন্টার অ্যাটাক হওয়ায় পুলিশ অন্য দলটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইন ফ্যাক্ট প্রথমে বোঝাও যায়নি কোন দলটায় কিষেণজি নিজে রয়েছেন। একসঙ্গে দুটো দলের সঙ্গে লড়াই করা ওই জঙ্গলে সম্ভব ছিল না। সাময়িকভাবে ফোর্স একটু কনফিউজডও হয়ে যায়। পুলিশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে পেছনের দলটাকে নিয়ে। যখন মাওবাদীদের পেছনের দলটার সঙ্গে ফোর্সের এক্সচেঞ্জ অফ ফায়ার চলছে, ততক্ষণে সামনের দলটা পালিয়ে যায়। পরে আমরা বুঝতে পারি, সামনের দলটাকে পালানোর সুযোগ করে দিতেই পেছনের দলটা পুলিশকে এমন ডেসপারেট অ্যাটাক করেছে। সন্ধে প্রায় সাড়ে ৬টা-৭টা নাগাদ গুলির লড়াই থামে সেদিন। সেদিনও কাউকে ধরা গেল না। দুটো দলই অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে গেল নাগালের বাইরে। শূন্য হাতে ফিরতে হল আমাদের। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম, ধৈর্য ধরে জঙ্গলে পড়ে থাকলে সাফল্য আসবেই। একটা কনফিডেন্স সেদিন পেয়েছিলাম আমরা, কিষেণজির কাছাকাছি যখন একবার পৌঁছনো গিয়েছে, তার মানে এটা সম্ভব আছে। শুধু লেগে থাকতে হবে।
কিন্তু সেই সময় কিষেণজিকে গ্রেফতার করা কিংবা মাওয়িস্টদের বিরুদ্ধে অপারেশন করা ছাড়াও অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছিলাম আমরা। সেটা হচ্ছে, মাওয়িস্টদের এলাকা বিস্তার। বেলপাহাড়ি, বিনপুরে মাওয়িস্টদের একটা বেস অনেক দিন ধরেই ছিল। কিন্তু লালগড় কোনওদিনই সেভাবে ওদের শক্ত ঘাঁটি ছিল না। বরং লালগড় ছিল অনেক শান্ত এলাকা। সেই লালগড়েরই একটা বড় অংশকে ওরা প্রায় লিবারেটেড জোনে কনভার্ট করার চেষ্টা করছিল। ইন ফ্যাক্ট লালগড়ের একটা বড় এলাকাকে লিবারেটেড জোন করেই ফেলেছিল ওরা। যে জিনিস কোনওদিনই বেলপাহাড়ি কিংবা বিনপুরে করে উঠতে পারেনি। কীভাবে হঠাৎই মাওয়িস্টদের এই জনভিত্তি লালগড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল সেটাও তখন চিন্তার ব্যাপার ছিল প্রশাসনের কাছে।’
সুনীল কুমারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভাবছিলাম, সত্যিই, এ’রাজ্যে মাওবাদী কার্যকলাপের এপিসেন্টার হিসেবে বারবারই উঠে এসেছে বেলপাহাড়ি, জামবনির কথা। লালগড়েও যে মানুষের মনে সরকার বিরোধিতার এমন তীব্র বারুদ জমা হচ্ছিল তার হদিস তো তেমনভাবে পাইনি আগে।

ঝাড়গ্রাম ১৯৯৫-৯৬

নয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখনও না ভেঙেছে মেদিনীপুর জেলা, না ভেঙেছে রাজ্য কংগ্রেস। সেই সময় এপার বাংলায় সিপিআইএম এবং সরকারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। একাধিপত্য বলাই যথার্থ। কিন্তু কোচবিহার থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, রাজ্যজুড়ে সিপিআইএমের একাধিপত্য বিস্তারের এই মসৃণ সড়কে একমাত্র গলার কাঁটা তখন ঝাড়গ্রাম মহকুমা। এই মহকুমার আদিবাসী মানুষের আস্থা কিছুতেই অর্জন করতে পারছে না সিপিআইএম। বরং দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী মানুষেরা যেন দিন দিনই আরও সরে যাচ্ছে সিপিআইএমের থেকে। দ্রুত সমর্থন বাড়ছে ঝাড়খন্ড পার্টির। মাওবাদী সমস্যা তখনও সেভাবে সামনে আসেনি। কিন্তু প্রায় পুরো ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে রাজ্যে শাসক দলের সংঘর্ষ তখন চরমে। সংঘর্ষ, খুনোখুনি লেগেই রয়েছে দু’দলের। বিশেষ করে জামবনি, বিনপুর এবং বেলপাহাড়িতে তখন একেবারে যুদ্ধের পরিস্থিতি। ঝাড়গ্রাম মহকুমার বাইরে আরও একটা এলাকা ছিল, কেশপুর। মেদিনীপুর শহর থেকে ২০-২২ কিলোমিটার দূরে। এই কেশপুরেও সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টির সংঘর্ষ নিয়ে তখন নাজেহাল অবস্থা পুলিশ-প্রশাসনের। ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে লাগাতার এই রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি যে কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, কীভাবে একটা শান্ত এলাকাকে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত করতে পারে, তার বিন্দুমাত্র আঁচও তখন পাননি রাজ্যের সিপিআইএম নেতারা। ঝাড়খন্ডিদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার রাস্তা খোঁজার দায়িত্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টির হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্তে বসেছিলেন ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। তলিয়ে ভাবেননি, যে আদিবাসীরা ঝাড়খন্ডিদের হয়ে অস্ত্র ধরছেন, আর যে আদিবাসীরা সিপিআইএমের হয়ে অস্ত্র হাতে তার মোকাবিলা করছেন, দু’দলেরই শ্রেণি চরিত্রে এক ছটাকও ফারাক নেই। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে, জান-মালের মায়া ত্যাগ করে গরিবতর একদল মানুষ নাগাড়ে কেন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে, এই যুদ্ধে কার লাভ হচ্ছে, তা তখন ভাবেনইনি মুজফফর আহমেদ ভবনের নেতারা।

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #চার

২০০৬ সালে সেই যে বেলপাহাড়ি গেলাম পুলিশ কনভয়ে মাওবাদী ব্লাস্টের খবর করতে, তারপর থেকে ২০১১ সালের নভেম্বরে কিষেণজির মৃত্যু পর্যন্ত বহুবার অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছি ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। যতবার গিয়েছি বারবার বোঝার চেষ্টা করেছি, ঠিক কী কারণে, কোন প্রেক্ষাপটে এবং কোন সময় থেকে মাওবাদীদের এই প্রভাব বিস্তার শুরু হল ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। শুধুই কি দারিদ্র, শুধুই পাশের রাজ্যে পালিয়ে যাওয়ার ভৌগলিক সুবিধে, শুধুমাত্র ‘অত্যাচারী’ সিপিআইএম নেতৃত্ব? শুধুই কি বঞ্চনা কিংবা পুলিশি দমনপীড়ন? মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মাওবাদী সমস্যা নিয়ে অধিকাংশ আলোচনায় এই কথাগুলোই বারবার শুনেছি। যতবার শুনেছি, ভেবেছি, এই কারণগুলো কি বড্ড একমাত্রিক হয়ে যাচ্ছে না? দারিদ্র, ভৌগলিক সুবিধে, অত্যাচারী শাসক দল কিংবা বঞ্চনা, এই সমস্ত ফ্যাক্টর কি রাজ্য কিংবা দেশে আর কোথাও ছিল না? তাছাড়া এই ফ্যাক্টরগুলো যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ও, তবেও তো একটা সূচনা লগ্ন থাকবে। একটা সূচনাকাল তো থাকবে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালিত রাজ্যের এই প্রান্তিক মহকুমায় অতি বামপন্থী এক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র কার্যকলাপ অনুশীলনের। বারবার মনে হয়েছে, উপযুক্ত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কোনও কারণ ছাড়া কি সত্যিই মাওবাদীদের এই প্রভাব বিস্তার সম্ভব?
অনেকে এমনও বলেছেন, ‘১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরুর সময় তা দক্ষিণবঙ্গের আরও কয়েকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম মেদিনীপুর জেলার ডেবরা এবং গোপীবল্লভপুর। সশস্ত্র জমি আন্দোলন হয়েছিল জোতদার, জমিদারদের বিরুদ্ধে। ফলে অতিবাম আন্দোলনের একটা বেস এই জেলায় ছিলই।’ তাছাড়া নকশালবাড়ির ধাঁচে শুধু ডেবরা, গোপীবল্লভপুর কেন, জমি দখলের আন্দোলন হয়েছিল বর্ধমানের কাঁকসা, আউসগ্রাম এবং বীরভূমেও। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরেও। তাছাড়া ছয়ের দশকের শেষে এক-দেড় বছরের যে আন্দোলন হয়েছিল ডেবরা, গোপীবল্লভপুরে, তার সঙ্গে একুশ শতকের শুরুতে বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনি কিংবা লালগড় মাওবাদী কার্যকলাপের এপিসেন্টার হয়ে ওঠার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কী, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাইনি বারবার অ্যাসাইনমেন্টে জঙ্গলমহলে গিয়ে।
বরং একুশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় বারবার গিয়ে শুনেছি, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা। কেমন পরিস্থিতি ছিল বছর দশেক আগে এই সব এলাকায়, তা জানা না গেলে কিষেণজির মৃত্যু রহস্যের সন্ধান করা অসম্ভব। ইন ফ্যাক্ট, কিষেণজির মৃত্যু রহস্যের উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে অতীতের ছোটখাট বহু জানা-অজানা ঘটনার মধ্যেই।
তাই, ব্যাক টু ১৯৯৫-৯৬। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার তখন দেবকুমার বসু। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অপারেশন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।

 

চলবে

(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)

Comments are closed.