আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০১৭ সালের জুনে রামজীবন মুর্মুর ছেলে শিবরাম বললেন, সিপিআইএম নেই, আর মাওবাদী আসবে কেন…
দু’পাশে শাল, অর্জুন গাছের সারি পেরিয়ে একটা গ্রাম। মাটির বাড়ির দেওয়ালে আগের বছর ভোটের আগে আঁকা রাজ্যের শাসক দলের প্রতীক। রামজীবন-শিবরামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার গাড়ি ছুটছে ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে। জামবনির সেই মোহিনী ষড়ঙ্গীর ছেলে প্রসূনের বক্তব্য নিয়েই আপাতত এই দফার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ।
প্রসূন ষড়ঙ্গী
‘১৯৬০ সালে আমার জন্ম। সিপিআইএমের সরকারে আসার বছর ভর্তি হই ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ। ছাত্র পরিষদ করতে শুরু করলাম। কলেজে রাজনীতি করার পরিবেশ তখন ছিল। কিন্তু আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে মাঠে-ময়দানে মারপিট, সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। এরই মধ্যে ১৯৯১ এর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস আমাকে গোপীবল্লভপুর সিটে প্রার্থী করল। তখন গ্রামে-গ্রামে সিপিআইএমের অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। বিরোধী দল করা যাবে না। ভোটের কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তাও প্রচার-কর্মসূচি চালিয়েছিলাম। কিন্তু ভোটের দিন সিপিআইএমকে সামলানোর মতো মেশিনারি আমাদের ছিল না। অনেক ভোটে হারলাম। তবু তারই মধ্যে রাজনীতি চলছিল। তখনও তৃণমূল কংগ্রেস হয়নি। সেই সময় এখানে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে আমরা আর ঝাড়খন্ডিরা লড়াই করছি। বুঝতেই পারছেন সেই লড়াই কত কঠিন ছিল।
এরই মধ্যে এল ২০০২ সাল, ২৬ অক্টোবর। আগেই বলেছি, সেদিন আমি ঝাড়গ্রাম শহরে ছিলাম। সিপিআইএম নেতা দিবাকর মালাকার খুনের বদলায় আমার বাবা এবং আরও দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে কুপিয়ে, গুলি করে, পুড়িয়ে খুন করল বাসুদেব ভকত বাহিনী। সেই ঘটনার পর আর বাড়ি ফিরতে পারিনি। টানা দু’বছর বাড়িছাড়া হয়ে গেলাম। দিবাকর মালাকার খুনে সিপিআইএম আমার নামে এফআইআর করল। আমি আর আমার ভাই পবিত্র, দুজনেই বাড়িছাড়া হলাম। ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের দিন বাসু ভকতের খুনের মামলায় আমার ভাইয়ের নামে এফআইআর হল। যেখানেই সিপিআইএমের বিরুদ্ধে কিছু ঘটছিল, পালা করে আমার আর পবিত্রর নামে এফআইআর করত সিপিআইএম। প্রচুর খরচাপাতি করে দুই ভাই একের পর এক কেস থেকে জামিন নিলাম। তারপর ২০০৪ সালে পাকাপাকি বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম। ২০০৬-০৭ সালে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে পালটাতে শুরু করল। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধীরা এককাট্টা হতে শুরু করে। এরপর তো কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের জোট হয়ে গেল।’
টানা বলে যাচ্ছিলেন প্রসূন ষড়ঙ্গী। ‘আপনি তৃণমূলে যোগ দিলেন কবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘২০১৪ লোকসভা ভোটের সময়। তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা নেতাদের সবাইকেই চিনতাম। সে ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে ছাত্র পরিষদ করেছি। অবিভক্ত মেদিনপুর জেলার ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। ২০১৪ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা নেতারা বলল, যোগ দিতে। যোগ দিলাম তৃণমূলে। ঝাড়গ্রাম, জামবনি, লালগড়, বিনপুরে বেশিরভাগ সিপিআইএম বিরোধীই ২০১১ বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিল। সিপিআইএমের দীর্ঘ দিনের অত্যাচারের জমানা অবসানে এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। যেহেতু সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের জোট ছিল আমি আর দলবদলের কথা ভাবিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসেই গেলাম। সিপিআইএম আমাদের পরিবার আর গোটা এলাকায় বছরের পর বছর যে অত্যাচার চালিয়েছে, তা তো কোনওদিন ভুলতে পারব না। যতদিন তা মনে থাকবে ততদিন তৃণমূল কংগ্রেসই করতে হবে। কংগ্রেস তো আর সিপিআইএমের সঙ্গে লড়বে না।’
প্রসূন ষড়ঙ্গী যা বললেন, অভিজ্ঞতায় দেখেছি, রাজ্যজুড়ে বহু কংগ্রেসিরই এটা মনের কথা। ২০০৬-০৭ সালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম এবং পরে লালগড় এপিসোডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিআইএম বিরোধী আন্দোলন যত তীব্র করেছেন, ততই মেরুকরণ হয়েছে এপার বাংলার রাজনীতিতে। একদিকে সিপিআইএম, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস। এই মেরুকরণের আরও একটা বড় কারণ, ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের পর সিপিআইএম এবং বামেদের সমর্থন নিয়ে দিল্লিতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রথম ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) সরকার গঠন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে যখন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বারবার প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পুলিশি অতিসক্রিয়তা এবং সিপিআইএমের বিরুদ্ধে অধিপত্যবাদের অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন, দিল্লিতে সরকার চালানোর বাধ্যবাধকতায় কংগ্রেস নেতৃত্ব তখন চুপ করে বসে থেকেছেন। রাজ্যস্তরে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো করেনইনি, দিল্লির ইউপিএ সরকারও কোনও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ, নন্দীগ্রামে যা কাণ্ড ঘটছিল ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত, কেন্দ্র প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করতেই পারত। কিন্তু সিপিআইএমের সমর্থনে দিল্লির সরকার চালাতে গিয়ে কংগ্রেস নেতাদের তখন ছুঁচো গেলার অবস্থা। এর ডিভিডেন্ড সুদে-আসলে ঘরে তুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রসের শীর্ষ নেতৃত্ব সিপিআইএমের সঙ্গে থাকলেন, কিন্তু সাধারণ কংগ্রেস কর্মী থেকে ভোটার পুরোপুরি তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে শিফট করতে শুরু করলেন। কংগ্রেসকে সিপিআইএমের বি-টিম বলে সেই যে ১৯৯৮ সালে নতুন দল গড়েছিলেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে একাই রাস্তায় নেমে তা পশ্চিম বাংলার সিপিআইএম বিরোধী মানুষের কাছে খাতায়-কলমে প্রমাণ করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম উত্তর যুগে রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের জঙ্গলমহলে সিপিআইএমের মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী এবং সংহত হল বিরোধী শক্তি। জঙ্গলমহলে ২০০৮ সালের শেষ থেকে লড়াই শুরু হল একটা মহকুমাজুড়ে। যা অল্প দিনেই ছড়িয়ে পড়ল পাশের দুটো জেলায়। ঝাড়গ্রাম মহকুমাকে কেন্দ্র করে জঙ্গলমহলে শাসক দল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শক্তির লড়াই হল অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং রক্তাক্ত। সংঘর্ষ-পাল্টা সংঘর্ষে লাল হয়ে উঠল লাল মাটির জামবনি, বিনপুর, বেলপাহাড়ি, লালগড়ের মাঠ-প্রান্তর।
লালগড় আন্দোলন সব হিসেব-নিকেশ ওলট-পালট করে দিল সিপিআইএমের। কিষেণজির নেতৃত্বে একা মাওবাদীতে রক্ষা নেই, কংগ্রেস, ঝাড়খন্ডি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাধারণ গরিব আদিবাসীর একটা বড় অংশও দোসর সুগ্রীবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। জঙ্গলমহলে সম্মিলিতভাবে বিরোধী শক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল সিপিআইএম নামক এক বাঘের ঘাড়ে। যে এক যুগে বাঘ ছিল ঠিকই, কিন্তু ৩০-৩২ বছর টানা সরকার চালিয়ে ২০০৮-০৯ সালে সেও বৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষেও বাঘ তো! কম-বেশি রক্তাক্ত হল বিরোধীরাও। লড়াইটা চলল প্রায় আড়াই বছর, ২০১১ সালের এপ্রিল-মে মাসের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত। লড়াই যত এগিয়েছে ততই দুর্বল হয়েছে সিপিআইএম, শক্তিশালী হয়েছে বিরোধী শক্তি। রাজ্যে বিরোধী শক্তির নেতৃত্ব চলে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে।
তাই যেদিন বাসুদেব ভকতের পরিবার, শিবরাম মুর্মু কিংবা মোহিনী মোহন ষড়ঙ্গীর উত্তরাধিকারী তৃণমূল কংগ্রেসের মূল শক্তির সঙ্গে যুক্ত হলেন, সেদিনই নিশ্চিত হয়ে গেল সিপিআইএম সরকারের পতন। আর রাজ্যে ক্ষমতার ব্যাটন তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে যাওয়া মাত্রই অনিবার্য হয়ে উঠল জঙ্গলমহলে কিষেণজির জনবিচ্ছিন্ন হওয়া। যে আন্দোলন যে কায়দায় কিষেণজি এ’রাজ্যে করেছেন, তাতে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু, যা ঘটল তৃণমূল সরকার তৈরির ছ’মাসের মধ্যে। কিন্তু কীভাবে দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন হলেন কিষেণজির মতো এক দুর্দান্ত সংগঠক সে কথায় আসব খানিক বাদে, তার আগে আবার একবার যেতে হবে বেলপাহাড়ি। সেই বেলপাহাড়ি, যেখানে নয়ের দশকের শুরু থেকেই যাতায়াত শুরু করলেন কিছু যুবক-যুবতী। যাঁদের শরীরে ঘামের গন্ধ, পরনে সাধারণ জামাকাপড়, পায়ে সাধারণ চটি, সবচাইতে গরিব যা খান, তাই খেয়ে নেন পরম তৃপ্তিতে। তখনও তাঁদের কাঁধে বন্দুক নেই, হাতে নেই বোমার মশলা।
কিন্তু বন্দুক এল, ল্যান্ডমাইনও এল। কীভাবে, কোন জায়গা থেকে এল, এই প্রশ্ন করার কোনও মানে হয় না, কিন্তু কবে রাজ্য প্রশাসন প্রথম তা জানল এবং জেনে কী করল সেই ঘটনায় সরাসরি যাই বরং।
বেলপাহাড়ি
তখন বেলপাহাড়ি থানা এবং ঝাড়গ্রাম মহকুমা পুলিশের কাছে মাঝে-মধ্যে নানা খবর পৌঁছচ্ছে। কখনও শোনা যাচ্ছে, কিছু অপিরিচিত ছেলে-মেয়ে এলাকায় ঘুরছে। কখনও শোনা যাচ্ছে, কাঁকরাঝোড়ে কলকাতা থেকে ট্রেকিং করতে এসেছিল কিছু ছাত্র-ছাত্রী। তারা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝাচ্ছে এই চরম দারিদ্র, অসহনীয় পরিস্থিতির থেকে মুক্তির রাস্তা কী! কিন্তু কোনও প্রমাণ তেমনভাবে পাচ্ছিল না পুলিশ। তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রভীণ কুমার, আইজি পশ্চিমাঞ্চল গৌতম মোহন চক্রবর্তী।
সেই সময় এমসিসি-জনযুদ্ধের মুভমেন্টের খবর পেয়ে বেলপাহাড়ি থানা এবং ঝাড়গ্রাম মহকুমার পুলিশ অফিসাররা মাঝেমাঝেই জঙ্গলের ভিতরের গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। তার একটা বড়ো কারণ এরকম, একদিন বিকেলে পুলিশ খবর পেল এলাকার কিছু দাবি নিয়ে কয়েকটি গ্রামের আদিবাসী মানুষ বাঁশপাহাড়িতে রাস্তা অবরোধ করেছেন। পুলিশ অফিসাররা গেলেন ঘটনাস্থলে। তখন সন্ধে নেমেছে। একুশ শতকের শুরুতে সন্ধে সাতটা এবং এই লেখা যখন লিখছি তখন সন্ধে সাতটার জঙ্গলমহলের মধ্যে ফারাক ছ’য়ের দশকে চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের তফাতের মতোই। চারদিকে ঘন জঙ্গল, দু-তিনটে গাড়িতে কয়েকজন অফিসার হাজির হলেন বাঁশপাহাড়ির অবরোধস্থলে। গিয়ে দেখলেন, অবরোধকারীরা বেশিরভাগই মহিলা। তাঁরা বললেন, বিভিন্ন দাবি দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনকে জানিয়েও কাজ হচ্ছে না, তাই অবরোধ। পুলিশ অফিসাররা সব শুনলেন। কিন্তু দাবিগুলো সবই প্রশাসনিক, উন্নয়নমূলক। পুলিশের বেশি কিছু করার নেই। তবু পুলিশ অফিসাররা আশ্বাস দিলেন, তাঁরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন। তাঁরা দেখলেন, এক মহিলা, বয়স তিরিশের আশপাশে, তিনিই অবরোধকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলছেন। বাকিরা চুপ করে রাস্তায় বসে আছেন। পুলিশ অফিসাররা বেশ কিছুক্ষণ কথার পর মহিলা এবং গ্রামবাসীদের বললেন, অবরোধ তুলে নিতে। পরদিনই তাঁরা দেখবেন বিষয়গুলো। এরপর ঘটল এক কাণ্ড।
‘আপনারা অপেক্ষা করুন’, বলে ওই মহিলা চলে গেলেন অন্ধকার জঙ্গলের ভিতরে। মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে এসে ফের কথাবার্তা শুরু করলেন। পুলিশ অফিসাররা বুঝলেন, ওই মহিলা জঙ্গলের ভেতরে কারও সঙ্গে কথা বলে এলেন, জানিয়ে এলেন তাঁদের বক্তব্য। আরও মিনিট পাঁচেক কথাবার্তার পর মহিলা ফের গেলেন জঙ্গলের ভেতরে। ফিরে এসে বললেন, ‘পুলিশের কেউ একজন আসুন আমার সঙ্গে।’
অফিসাররা সংকটে। এই রাতে জঙ্গলের ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে কি? কে আছে জঙ্গলের ভেতরে জানা নেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করলেন না এক অফিসার। কোমর থেকে সার্ভিস রিভলভার বের করে দিলেন আর এক অফিসারের হাতে। তারপর মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলুন’।
অবরোধের নেতৃত্বে থাকা মহিলার সঙ্গে একা জঙ্গলে ঢুকে অল্প এগোতেই দেখলেন, বসে রয়েছেন কয়েকজন পুরুষ। তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন, আর এক দফা। বললেন, প্রশাসনকে জানাবেন তাঁদের দাবির কথা। অবরোধ উঠল। বাঁশপাহাড়ি থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা আর কিছু প্রশ্ন নিয়ে থানায় ফিরল ঝাড়গ্রাম পুলিশ। কারা বসে জঙ্গলে? কী তাঁদের পরিচয়? কার হাতে এই আন্দোলনের সুতো? কত দূরে আছে তা? এত মানুষকে এতক্ষণ ধরে অবরোধ করার জন্য সংগঠিত করার পেছনে কে?
এরপরই জঙ্গলের ভেতরে প্রায় নিয়মিত ঢুকতে শুরু করল পুলিশ। কিছু সময় সঙ্গে নিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোককে। কারণ, জঙ্গলের অনেক রাস্তাই পুলিশের অচেনা, অজানা। কখনও জঙ্গলে ছাগল, গরু চরাতে আসা বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। একদিন পুলিশ খবর পেল, রাতে জঙ্গলের ভেতরে একটা প্রচণ্ড শব্দ হয়েছে। বেশ কিছুটা দূরের গ্রাম থেকে শোনা গিয়েছে। পুলিশ গেল সেই গ্রামে। লোকজন বলল, শব্দ তারা শুনেছে, কিন্তু কোথায় হয়েছে, কী হয়েছে, তা জানা নেই। তবে শব্দ এসেছে জঙ্গলের ভেতর থেকে। হেঁটে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকল পুলিশ। ঘুরতে-ঘুরতে দেখা মিলল একটি বাচ্চা ছেলের। ছাগল চরাচ্ছে। সে পুলিশকে বলল, কোথায় আওয়াজ হয়েছে। জঙ্গলে আরও খানিকটা ঢুকে একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে চমকে উঠলেন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও, বেলপাহাড়ি থানার ওসি। বড়সড় একটা গর্ত মাটিতে। একেবারে টাটকা কয়েক ফুটের গর্ত। পুলিশের অভিজ্ঞ চোখ বুঝল ল্যান্ডমাইন ফাটানো হয়েছে। কিন্তু এখানে কেন? নাশকতার জন্য তো নয়! তবে কেন ফাটানো হল ল্যান্ডমাইন? জবাব মিলল কিছুক্ষণ বাদেই। গর্তটার এদিক-এদিক ঘুরতে ঘুরতে পুলিশ অফিসাররা দেখলেন, একটা গাছের গায়ে গুলির দাগ, সেটাও টাটকা। এবং কিছু দূরে গুলির প্রচুর খালি খোল। চোখ কপালে উঠে গেল অফিসারদের। তার মানে তো ট্রেনিং চলছে এখানে। পুলিশ অফিসাররা বুঝলেন, ল্যান্ডমাইন ফাটানো হয়েছে টেস্টিংয়ের জন্য, নাশকতার জন্য নয়। জঙ্গলের এই জায়গায় তার মানে রীতিমতো প্রশিক্ষণ শিবির চলছে। নিকটবর্তী গ্রামে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন পুলিশ অফিসাররা। কেউই তেমন কিছু বলতে পারলেন না। পুলিশ অফিসাররা বুঝলেন, বিষয়টা সহজ তো নয়ই বরং রীতিমতো গুরুতর। আরও কিছুক্ষণ এলাকায়, জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে বেলপাহাড়ি থানায় ফিরলেন অফিসাররা। পুরো বিষয়টা জানানো হল জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্তাকে। এবং এরপরই ঘটল এই ঘটনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ডেভেলপমেণ্ট।
পরদিন বেলপাহাড়ি থানায় গেলেন আইজি পশ্চিমাঞ্চল গৌতম মোহন চক্রবর্তী এবং এসপি প্রভীণ কুমার। থানায় দীর্ঘক্ষণ ধরে স্থানীয় অফিসারদের কাছে শুনলেন বেলপাহাড়ির পরিস্থিতি। কী ধরনের খবর আসছে, কেন অফিসারদের মনে নানারকম সন্দেহ দেখা দিচ্ছে, ল্যান্ডমাইন টেস্টিং এবং গুলির তাজা খালি খোল পাওয়ার ঘটনা। থানার ওসির টেবিলের কাচের নীচে বেলপাহাড়ির একটা বড়ো ম্যাপ ছিল। ঠিক কোন জায়গায় ল্যান্ডমাইন ফাটার গর্ত এবং বন্দুক ট্রেনিংয়ের হদিশ মিলেছে ম্যাপে সেই জায়গাটা দেখলেন দুই সিনিয়র অফিসার। তারপর সেই জায়গায় পেন দিয়ে একটা গোল করে দিলেন গৌতম মোহন চক্রবর্তী। তারপর গৌতম মোহন চক্রবর্তী ঝাড়গ্রামের এসডিপিও, বেলপাহাড়ির ওসিকে দেখিয়ে জেলার পুলিশ সুপারকে বললেন, ‘ওরা বোধয় একটু ভয় পেয়ে গেছে। এটা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।’
আইজির কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন জুনিয়র অফিসাররা। এরপর তো আর কোনও কথা হয় না। কিছুক্ষণ বাদে থানা থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন আইজি এবং এসপি। যদিও তখনও এমসিসি এবং জনযুদ্ধের সংযুক্তি হয়নি, কিন্তু এই দুই গোষ্ঠীর কোনও এক দলের এরাজ্যে প্রশিক্ষণের প্রথম হদিশ মেলার পরও কোনও নির্দিষ্ট মামলা দায়ের হল না। সিনিয়র অফিসার যখন বলে গিয়েছেন, ‘এটা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই,’ তখন সেই ঘটনা নিয়ে অতিরিক্ত উৎসাহ বা তদন্ত পুলিশের মতো একটা ডিসিপ্লিনড ফোর্সে কারও পক্ষেই করা সম্ভব নয়। সেদিনই নির্দিষ্ট মামলা রুজু করে পুলিশ অতিরিক্ত তৎপর হলে কী হোতও তা হয়তো বিশ বছর পর নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু ঝাড়গ্রাম এবং বেলপাহাড়িতে কাজ করা অফিসাররা নাশকতার প্রস্তুতির যে হদিশ পেয়েছিলেন, তা আর মহাকরণে পৌঁছয়নি। সেই ঘটনার জেরে নির্দিষ্ট মামলা হয়তো হয়নি, কিন্তু এখনও কেউ বেলপাহাড়ি থানার ওসির ঘরে গেলে দেখতে পাবেন দেওয়ালে ঝুলছে সেই ম্যাপ, যেখানে প্রথম গোল দাগ দিয়ে একটা জায়গা নির্দিষ্ট করেছিলেন গৌতম মোহন চক্রবর্তী। তারপর সেই ম্যাপে অনেক কালির দাগ পড়েছে। একের পর এক ঘটনা ঘটেছে, আর ম্যাপের চেহারা বদলেছে কালির দাগে।
যদিও সেই সময় এমসিসি, জনযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে মাওবাদীদের উত্থান, শক্তিবৃদ্ধি বা আরও পরিষ্কার করে বললে সামাজিক স্বীকৃতি তৈরি হওয়া শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলার বিষয় ছিল না, তা ছিল আপাদমস্তক এক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এবং তাদের বিস্তারের জন্য উর্বর জমি তৈরিই হয়ে ছিল আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে জামবনি, বেলপাহাড়ির বিভিন্ন জায়গায় সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির সংঘর্ষের জেরে। লাল মাটির রুক্ষ, শক্ত পাথুরে জমিতে সিপিআইএম যত শক্তিবৃদ্ধি করেছে, ততই এমসিসি-জনযুদ্ধের ভিত মজবুত হয়েছে। ২০০৪ সালে যখন শেষ পর্যন্ত সিপিআই মাওবাদী গঠিত হল, ততদিনে তাদের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে অনেকটাই।
একদিকে অনুন্নয়ন, অন্যদিকে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনে গ্রামবাসীদের কাছে অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে ফেলে মাওবাদীরা। এবং উপস্থিতি জানান দিতে একের পর এক ঘটনা ঘটাতে শুরু করে তারা। কখনও বান্দোয়ান, বারিকুলের ওসি খুন, কখনও সিপিআইএম নেতাদের খুন, কখনও বা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ। সেই সময় ঠিক কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল জঙ্গলমহলে তা বোঝাতে একটা ঘটনার উল্লেখ করব।
বান্দোয়ান, ২০০৬
২০০৬ সালের মার্চ, কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আমি স্টার আনন্দ চ্যানেলে। কিছুদিন আগেই জঙ্গলমহলে ঘুরে মাওবাদীদের নিয়ে একাধিক খবর করেছি। ওই এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। একদিন বিকেলে অফিসে বসে আছি। পরিচিত এক ব্যক্তি বান্দোয়ান থেকে ফোন করলেন। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা হল। বললেন, ‘পরীক্ষার জন্য বড়ো মিটিং বন্ধ আছে, কিন্তু পরিস্থিতি খুব খারাপ।’
কেন?
‘পুরো আতঙ্কের পরিবেশ। বিধায়কই বাড়িতে থাকতে পারছেন না, আর আমাদের কী হবে?’
তাঁর কথা শুনে একটু অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মানে?
তিনি বললেন, বান্দোয়ানের এমএলএ লুকিয়ে রাতে একটা লাইব্রেরিতে গিয়ে থাকেন মাওবাদীদের ভয়ে।
ফোন ছাড়ার পর ঘটনাটা জানালাম অফিসে। বললাম, ভালো খবর হতে পারে নির্বাচনের আগে বাড়িছাড়া বিধায়ককে নিয়ে। অফিস সঙ্গে সঙ্গে রাজি। পরদিন সকালে কলকাতা থেকে রওনা দিলাম বান্দোয়ানের উদ্দেশে। সঙ্গে ক্যামেরাম্যান শ্যামল জানা। ততক্ষণে জেনে নিয়েছি, বান্দোয়ানের এমএলএ দিনেরবেলা তাও নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে প্রচার করছেন, কিন্তু বিকেলের আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে যান গোপন ডেরায়। তখন বান্দোয়ানের বিধায়ক সিপিআইএমের উপেন হাঁসদা। জানি, খবরটা নিয়ে বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তাহলে সিপিআইএম সতর্ক হয়ে যাবে। পার্টির বিধায়ক লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রচার হয়ে গেলে তা ভালো হবে না দলের পক্ষে।
বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ পৌঁছালাম বান্দোয়ান। গাড়ি থেকে খুলে দিয়েছি প্রেস স্টিকার, যাতে কারও চোখে না পড়ে। বান্দোয়ান বাজারের সামনে গাড়ি রেখে শ্যামলকে বললাম, ক্যামেরা নিয়ে গাড়ি থেকে নামার দরকার নেই। এখনও অঢেল সময় হাতে। কাজ তো আমাদের রাতে। বাজার থেকে কয়েক পা এগিয়েই থানা। থানার বাইরে বিরাট লোহার গেট, এবং গেটে বড় তালা মারা। গেটে তালা দিয়ে ভেতরে পুলিশ বসে আছে। কিছুদিন আগেই এমন গেটে তালা মারা দেখেছি বেলপাহাড়ি থানায়, কিন্তু সেটা তো মাঝরাত ছিল। এখন ঝকঝকে দিনের আলো!
যাঁর সঙ্গে আগের দিন ফোনে কথা হয়, তিনি বলেছিলেন একটা ক্লাব এবং লাইব্রেরির কথা, সেখানে রাতে শুতে আসেন বিধায়ক উপেন হাঁসদা। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে সেই দোতলা বাড়িটা দেখে এলাম। থানা থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেক দূরে। তখনও দিনের আলো আছে। সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে, সময় কাটছে না। শুধু ভাবছি, বিধায়ক আসবেন তো? না আসলে তো সর্বনাশ, এত দূর থেকে এলাম। অফিসে বলা আছে। মনে সংশয় হচ্ছে, যদি প্রচারে অন্য কোনও দিকে চলে গিয়ে থাকেন তিনি! বলেকয়ে তো আসিনি। একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। চা হতে হতে কথা বলছি দোকানদারের সঙ্গে। দোকানদার বললেন, এমএলএ আসবেন সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই জানতে পারলাম আরও এক অদ্ভুত তথ্য। বিধায়ক উপেন হাঁসদা যেমন বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে ক্লাবে থাকেন, তেমনই সিপিআইএমের এক নেতা থাকেন পুলিশ ক্যাম্পে। বলে কী লোকটা? চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে ফোন করলাম বান্দোয়ানের ওই ব্যক্তিকে, যিনি আমাকে খবর দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ঠিকই তো, সিপিআইএমের কোনও বড়ো নেতাই বাড়িতে থাকতে পারছেন না রাতে।
২০০৫ সালের শেষে বান্দোয়ানের সিপিআইআইম নেতা এবং জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবি কর এবং তাঁর স্ত্রীকে রাতে বাড়িতে ঢুকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে খুন করেছিল মাওবাদীরা। এই ঘটনা রাজ্যে তোলপাড় ফেলেছিল। এমন পর্যায়ের নেতাকে এভাবে হত্যা তার আগে হয়নি।
তিনি বললেন, রবি করের খুনের পর থেকেই বান্দোয়ানের সিপিআইএম নেতারা দিনে বাড়িতে যান বা থাকেন হয়তো কিছুক্ষণ, বিকেল হলেই অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেন। এমনই এক অদ্ভুত পরিস্থিতি সেই সময় তৈরি হয়েছিল জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায়। থানায় তালাবন্দি পুলিশ, বাড়িছাড়া শাসক দল সিপিআইএম নেতৃত্ব এবং গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাওবাদী। এবং এটা প্রাক লালগড় যুগ!
সন্ধে সাড়ে ছটার পর থেকেই দোকান, বাজারে আস্তে-আস্তে মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করল। ঝাঁপ পড়তে শুরু করল দোকানের। সাতটার মধ্যে মোটামুটি সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল বান্দোয়ান শহরে। রাস্তা ফাঁকা, দুশো-আড়াইশো মিটার অন্তর হয়তো একটা করে আলো জ্বলছে। তাও সব জায়গায় নেই। রীতিমতো থমথমে পরিবেশ। হেঁটে ঘুরছি এদিক-ওদিক।
ততক্ষণে শ্যামলের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিয়েছি, উপেন হাঁসদা যে ক্লাবে শুতে আসেন তার সামান্য দূরে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করব দু’জন। উনি এলে শ্যামল ছবি নেবে ক্লাবে ঢোকার। তারপর অবস্থা বুঝে কথা বলব তাঁর সঙ্গে। রাতটা কাটাবো গাড়িতে বসেই। তখন মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে আরও একটা জিনিস, সিপিআইএম নেতার পুলিশ ক্যাম্পে থাকার খবরটা যদি করা যায়। মনে মনে ভাবছি, যদি উপেন হাঁসদা না আসেন রাতে, ওই খবরটা যেন করতে পারি!
গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছি দু’জন। আটটা-সাড়ে আটটা হবে, পরপর দুটো গাড়ি এসে থামল ক্লাবের সামনে। টাটা সুমো। প্রথমেই তিন-চারজন পুলিশ নেমে এলেন গাড়ি থেকে, সবার হাতে একে ৪৭, তাঁরা এদিক-ওদিক দেখে নেওয়ার পর গাড়ি থেকে নামলেন আরও দু-তিন জন। দ্রুত ঢুকে গেলেন ক্লাবের ভেতরে। শ্যামল গাড়ি থেকে ছবি নিচ্ছে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তি, বুঝলাম ইনিই উপেন হাঁসদা। তখনও তাঁকে চিনতাম না। তিন-চারজন পুলিশ কনস্টেবল তখন বন্দুক হাতে ক্লাবের দরজায়। গাড়ি থেকে নেমে তাঁদের গিয়ে বললাম, বিধায়কের সঙ্গে দেখা করব। তাঁরা ভেতর থেকে পার্টির লোককে ডাকলেন, আমাদের পরিচয় জেনে ঢুকতে দিলেন। একটা সাধারণ কাঠের বেঞ্চ, তাতে বসে বিধায়ক। ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে আরও দু’জন। শুরু হল কথাবার্তা।
তার আগে এবং পরেও বিভিন্ন জেলায় গিয়ে দেখেছি, সিপিআইএমে এক ধরনের মানুষ আছে, পাঁচ, ছয় বা সাতের দশকে বেড়ে ওঠা, যাঁদের জীবনযাত্রা এবং চরিত্রের দৃঢ়তাকে উদার অর্থনীতি কোনওভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি। তাঁরা তাঁদের মতো, নিজেদের আদর্শের দুনিয়ায় বাস করেন। ভোগবাদের রাস্তা এড়িয়ে চলেন সচেতনভাবে, তাঁদের সবাই হয়তো রাজ্যস্তরের নেতা হন না, বড়ো জনসভায় বক্তৃতা করেন না। তাঁরা নিজেদের সাধারণ, অনাড়ম্বর জীবনযাপনের বিজ্ঞাপন করেন না। বরং মনে করেন, এভাবে জীবন কাটানোই স্বাভাবিক। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই পদাতিক বাহিনীই জেলায়-জেলায় সিপিআইএম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটা ব্যতিক্রমী ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। তাঁদের সংখ্যা যত কমেছে, ততই মানুষের থেকে দূরে সরে গেছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। এমনই একজন উপেন হাঁসদা। ২০০৬ ভোটের পর বিধানসভায় অনেকবার দেখা হয়েছে, একটা-দুটো কথা হয়েছে। মনে হয়েছে, বিধানসভার জাঁকজমক এবং শহুরে, মধ্যশ্রেণির ভিড়ে একটু আড়ষ্ট থাকতেন।
সেদিন সন্ধ্যায় বান্দোয়ানের দোতলা ক্লাব এবং লাইব্রেরির একতলার ছোট্ট ঘরে কাঠের বেঞ্চে বসে তিনি আমায় বললেন এলাকার পরিস্থিতি, কেন বাড়িছাড়া হয়ে থাকতে হচ্ছে, কীভাবে কাটছে দিন, সব। ঘরে একটাও আসবাব নেই, কথা বলতে বলতেই উঠে কোঁচকানো পাঞ্জাবিটা খুলে দেওয়ালে লাগানো একটা পেরেকে ঝুলিয়ে রাখলেন। ছোট্ট একটা ব্যাগ থেকে বের করলেন লুঙ্গি। শ্যামল নানাভাবে ছবি নিচ্ছে। এমন সময় একজন ঘর থেকে বেরিয়ে খানিক বাদে ফিরলেন হাতে দুটো প্যাকেট নিয়ে। পাশের একটা ছোট্ট হোটেল থেকে নিয়ে এসেছেন হাত রুটি এবং সবজি। আমাদের জিজ্ঞেস করলেন খাব কিনা? কোথায় থাকব? জানালাম, হোটেলটায় বলে এসেছি রুটি, তরকা খাব। বানিয়ে রাখবে। আর থাকব গাড়িতে। রাতে আপনি কোথায়, কীভাবে থাকেন তার ছবি করতে হবে। বললেন, নটায় কিন্তু হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে। তবে খেয়ে নিন। বলে গেলাম, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। খেয়ে এসে কথা বলছি আবার।
খেয়ে ফিরে এসে দেখি বান্দোয়ান থানা থেকে আরও দু’জন পুলিশ এসেছেন। উপেন হাঁসদা ক্লাবের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে ফের ঘরের ভেতরে গেলাম। একটা স্টিলের থালায় রুটি, সবজি নিয়ে খেতে বসলেন। হাত দিয়ে রুটির আটা ঝাড়ছেন, তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। মনে মনে ভাবছি, এমন জীবনযাপনে যিনি অভ্যস্ত, যাঁর বাড়িতে ২০০৬ সালে একটা টেলিভিশন সেট পর্যন্ত নেই, যাঁর মোবাইল ফোনের দাম মেরেকেটে দু’হাজার টাকা, পায়ে দেড়শো টাকার চামড়ার চটি, তিনিও মাওবাদীদের শ্রেণিশত্রু? শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণে কোনও গোলমাল হচ্ছে না তো মাওবাদীদের? জোতদার, জমিদার না হোক, অন্তত রেশন ডিলার, রান্নার গ্যাসের এজেন্ট বা ছোটখাট দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে পড়া পূর্ত কর্মাধ্যক্ষকে টার্গেট করলে তাও বুঝি, কিন্তু স্রেফ খুনের জন্য মানুষ খুনের ট্যাকটিকাল লাইন কি কোনও চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে? এই সব মৌলিক প্রশ্নের জবাবেই লুকিয়ে আছে কিষেণজির মৃত্যু রহস্য, যদিও সেদিন রাতে বান্দোয়ানের বিধায়ক উপেন হাঁসদার ছবি, বক্তব্য, রাতে খাওয়া এবং শোবার বন্দোবস্ত দেখার সময় আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল সেই সিপিআইএম নেতার কথা, যিনি কিনা পুলিশ ক্যাম্পে রাতে শুতে যান। জিজ্ঞেস করলাম বিধায়ককে। নাম বললেন, সেই নেতার।
‘কী করবে, ওর বাড়ি রবি করের বাড়ির কাছে। ওই ঘটনার পর থেকেই রাতে বাড়িতে থাকতে পারে না। বিকেলে ছেলে সাইকেল করে ক্যাম্পে দিয়ে যায়, আবার সকালে বাড়ি নিয়ে যায়।’
এখন যতদূর মনে পড়ছে, ওই নেতার বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে একটা সিআরপিএফ বা বিএসএফ ক্যাম্প হয়েছিল। ইএফআর ক্যাম্পও হতে পারে।
রাতের খাবারের পর মাটিতে একটা মাদুর পেতে তার ওপর বাড়ি থেকে আনা ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে পাতলেন বিধায়ক। অ্যাশট্রে নিয়ে তাতে বসে একটা বিড়ি ধরালেন। এটাই রাতে শোওয়ার বিছানা। আরও কিছুক্ষণ গল্প করলাম তাঁর সঙ্গে। তারপর বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে, জানালাম না আমার পরবর্তী পরিকল্পনা। রাত প্রায় সাড়ে দশটা, পুরো বান্দোয়ান শহর অন্ধকারে ডুবে গেছে। গাড়িতে বসে আছি। ততক্ষণে বান্দোয়ানে আমার পরিচিত ব্যক্তিকে ফোনে জানিয়েছি আমার পরবর্তী পরিকল্পনার কথা। তিনিও রাজি, ঠিক হল ভোর চারটের মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়ব ওই ক্যাম্পের উদ্দেশে, যা প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে। ক্যাম্পের বাইরে অপেক্ষা করব ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে। তারপর ওই নেতা বেরোলেই ছবি, বাইট।
সারারাত গাড়িতে বসে কাটিয়ে দিলাম আমি আর শ্যামল। গেটের বাইরে থানা থেকে আসা দু’জন বন্দুকধারী পুলিশ। বাড়ির ছাদে আরও দু’জন। ভেতরে দু’জন পার্টি কর্মীকে নিয়ে ঘুমোচ্ছেন বিধায়ক। গাড়ি থেকে নেমে শ্যামল একাধিক ছবি নিয়েছে। রাতে বাড়িতে থাকতে না পারা বিধায়কের খবর এস্টাবলিশ করতে যতরকমের ভিশ্যুয়াল দরকার।
কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৭
ঠিক পৌনে চারটে নাগাদ গাড়ি স্টার্ট করে পৌঁছালাম আমার পরিচিতের বাড়ির দরজায়। দু’মিনিটের রাস্তা, বলাই ছিল। বেরিয়ে এলেন বাইরে। রওনা দিলাম ঝাড়খন্ড সীমানার দিকে। শহর ছাড়িয়ে পাঁচশো মিটার যেতেই, সে অন্ধকার যে কেমন তার সঠিক বর্ণনা দেওয়ার মতো ভাষার ওপর দখল আমার নেই। ভূতের গল্প পড়িনি, অনুমান করতে পারি ওই সব গল্পে এমন রাতের বর্ণনা থাকে। আমার আবার মাথায় ঘুরছে কিছুদিন আগেই বেলপাহাড়িতে গিয়ে এক অফিসারের বলা এক সাবধানবানী। তিনি বলেছিলেন, রাতে এই সব এলাকায় ট্রাভেল করলে গাড়ির হেডলাইট জ্বালাবেন না। ওরা থাকলে ভাববে পুলিশ মুভমেণ্ট হছে। হয়তো পুলিশ ভেবে আপনাদের গাড়ি টার্গেট করবে। তাই আলো বন্ধ। দুদিকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অন্ধকার রাস্তায় কীভাবে যে চালক গাড়ি চালাচ্ছেন জানি না। কাকে ডাকলে যে ভয় কাটবে তাও ভূতের গল্প না পড়ার মতোই জানা নেই আমার। তবে অঘটন কিছুই ঘটল না, আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ওই ক্যাম্পে। তখনও আলো ফোটেনি, আবার অন্তহীন অপেক্ষা। ক্যাম্প থেকে প্রায় দুশো মিটার দূরে গাড়ি থামিয়ে বসে আছি। শ্যামল গাড়ির সামনের সিটে ক্যামেরার বোতামে হাত দিয়ে বসে, কেউ বেরোলেই ছবি নেবে। ঘণ্টাখানেক বাদে দেখি জওয়ানরা আস্তে আস্তে বেরোচ্ছেন বারাক থেকে। সকাল সাতটা নাগাদ এক যুবক এলেন সাইকেল চালিয়ে। ক্যাম্প থেকে লুঙ্গির ওপর সাধারণ জামা পরা এক ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন। ইনিই সিপিআইএম নেতা, গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেলাম। পরিচয় দিলাম। তারপর তাঁর সঙ্গে গেলাম বাড়ি পর্যন্ত। সাধারণ মাটির বাড়ি। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ড বর্ডার।
বাড়ির বাকিরা দিনের কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। উঠোনে মোড়া পেতে দিয়েছেন নেতার স্ত্রী। কথা বলছি, শ্যামল ছবি নিচ্ছে। তাঁর নাম এতদিন বাদে আর মনে নেই, স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ পাশে দাঁড়িয়ে। মাওবাদীদের ভয়ে কীভাবে দিন কাটছে, বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন স্ত্রী। ক্যামেরার সামনেই বললেন, ‘এভাবে বাঁচা যায়? আর দরকার নেই পার্টি করার, কতদিন ধরে বলছি পার্টি ছাড়ো, পার্টি ছাড়ো।’
‘আঃ, তুমি থামো তো, পার্টি ছাড়ব কেন?’ স্ত্রীকে ধমক দিলেন তিনি। বয়স প্রায় ষাট বছর। স্ত্রী তখনও কাঁদছেন আর শাড়ি দিয়ে চোখ মুছছেন।
মৃত্যুর খাঁড়া মাথায় নিয়ে রাজনীতি করা এই প্রান্তিক মানুষগুলোকে কিছু বলার মতো ভাষা আমার ছিল না। পেশাদার সাংবাদিকের মতো বাইট নিলাম খবরের স্বার্থে। চা খেয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। গাড়িতে উঠে শ্যামলকে জিজ্ঞেস করলাম, অডিও-ভিডিও সব ঠিক আছে তো, আর একবার চেক করে নাও।
সকাল সাড়ে সাতটা-আটটা বাজে, পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড সীমানা থেকে রওনা দিয়ে আমাদের গাড়ি দ্রুত ছুটছে বান্দোয়ানের দিকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে কলকাতা। একটা খবর পেয়ে এসেছিলাম, নিশ্চিত ছিলাম না কতটা কী করতে পারব। নিয়ে যাচ্ছি দুটো খবর। বিধায়ক বাড়িছাড়া হয়ে কড়া নিরাপত্তায় অন্যত্র রাত কাটান, নেতা পুলিশ ক্যাম্পে, তাঁর স্ত্রীর কান্না, বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে রাজ্যে মাওবাদী প্রভাব বোঝানোর জন্য এর থেকে ভালো খবর আর কিছু হয় না, ভাবছি এমন নানা কথা। তখন সাময়িক উত্তেজনায় মাথাতেই আসেনি আমার এই দেখা, খবর করা কোনওটাই সম্পূর্ণ ছিল না সেদিন। ছিল একমাত্রিক। কেন, সেই প্রশ্নেই আসব এবার। সেই প্রশ্নের জবাবেই মিলবে কিষেণজির মৃত্যুর কারণ।
পরে অনেকবার ভেবেছি, তখন যতটা সংবেদনশীলভাবে বাড়িতে থাকতে না পারা বিধায়ক, শাসক দলের নেতাকে নিয়ে খবর করা দরকার ছিল কিংবা মাওবাদীদের এই ত্রাস সৃষ্টির সমালোচনা করার দরকার ছিল, তা তো করিনি আমার খবরে। মাওবাদীদের প্রভাব বোঝাতে হয়তো এমনভাবে খবর করেছি, যেন মনে হয় সিপিআইএম নেতাদের বাড়িছাড়া হয়ে থাকা যথেষ্টই যুক্তিযুক্ত। যেন সিপিআইএম করা অপরাধেরই শামিল। মুদ্রার একটা পিঠই দেখেছি খবর করার সময়। হয়তো সেই খবর দেখে অনেক মানুষেরই মনে হয়েছে, দেখেছো কত অত্যাচার করেছে যে, বাড়িতেও থাকতে পারে না। কিন্তু তা তো ঠিক নয় সব ক্ষেত্রে, সবাই তো সমান নন। সিপিআইএম করার জন্য যে বয়স্ক ব্যক্তি বাড়ি থাকতে পারেন না, সাতসকালে বাইরের লোকের সামনে তাঁর স্ত্রীর কান্না তো আমাদের অনেক খবরের মতো বানানো নয়, রং চড়ানো নয়। পরে একাধিকবার অপরাধবোধ হয়েছে। ভেবেছি, ভুল স্বীকার করতে হবে কোথাও। তা করা হয়নি। কিন্তু ইতিহাসের কী বিচিত্র গতি, শেষ পর্যন্ত মানুষের দরবারে গিয়ে ভুল স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নিতে হল কিনা মাওবাদীদের! কিন্তু কবে, কেন?
কারণ, অনুন্নয়ন ছিল, কিছু নেতা খারাপ ছিলেন, কেউ কেউ পুলিশকে খবর দিতেন মাওবাদীদের সম্পর্কে তা ঠিক! কিন্তু এটা আরও বড় সত্য যে, কিছু কিছু হত্যা একটা সময় পর্যন্ত হয়তো নানান কারণে যৌক্তিকতা পেয়ে যায়, কিন্তু নির্বিচারে হত্যা, নৃশংস ত্রাস সৃষ্টি করা কখনও দীর্ঘমেয়াদিভাবে সামাজিক স্বীকৃতি পায় না। তখন মূল্য চোকাতে হয় অনেক বড়ো ক্ষতিপূরণ দিয়ে।
চলবে
(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)
Comments are closed.