বাম-তৃণমূল-বিজেপি: ডুয়ার্সের কোহিনূর চা বাগানে বেনজির শ্রমিক ঐক্য, লাগাতার আন্দোলনের চাপে বকেয়া কোটি টাকার পিএফ দিতে রাজি বাগান মালিক
রাজধানী কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ারের দূরত্ব ৭৩৪ কিলোমিটার। সেখান থেকে শামুকতলার কোহিনূর টি এস্টেট আরও ২০ কিলোমিটার। রাজ্য রাজনীতির লাইম লাইট থেকে বহুদূরে এই কোহিনূর চা বাগানে তৈরি হলো শ্রমিকদের দাবি আদায়ে বেনজির রাজনৈতিক ঐক্যের বিরল ছবি। বাম-তৃণমূল-বিজেপির ত্রিফলার কাছে হার মানল মালিকপক্ষ। এক মাসের নাছোড় আন্দোলন ছিনিয়ে আনলো বকেয়া পিএফের টাকা দেওয়ার মালিকের অঙ্গিকার।
কম্পিউটারে ওয়াল পেপার করার মতো তার রূপ। গাছের সবুজে আর আকাশের নীলে যে বিভ্রম তা হাতেকলমে বুঝতে আপনাকে আসতে হবে আলিপুরদুয়ার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শামুকতলার কোহিনূর টি এস্টেটে। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দোসর প্রবল দারিদ্র। এলাকার অন্যতম প্রাচীন বাগান কোহিনূরে এখন ৮৮৮ জন স্থায়ী কর্মী। অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৩০০। যৎসামান্য বেতনে যেখানে সংসার চালানোই কঠিন, তখন শ্রমিকরা জানতে পারেন, বেতন থেকে প্রভিডেন্ড ফান্ড বাবদ যে টাকা কাটা হচ্ছে, তা জমা পড়ছে না পিএফ অ্যাকাউন্টে।
বাগানের মোট কর্মীর ৯০ শতাংশের বেতন দৈনিক ১৭৬ টাকা। পিএফ কাটা হলে তা নেমে আসে ১৫০ য়। শ্রমিকদের অভিযোগ, গত ২৩ মাস ধরে তাদের মায়না থেকে কাটা হচ্ছে পিএফ কিন্তু জমা পড়ছে না। অগাস্ট মাসের ১০ তারিখ থেকে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। একে একে তাতে সমর্থন দেয় বামপন্থীদের সিটু, বিজেপির জন বার্লা গোষ্ঠীর বিটিডব্লুইউ এবং তৃণমূল প্রভাবিত আইএনটিটিইউসি। শুরু হয় সর্বাত্মক আন্দোলন। কিন্তু আর পাঁচটা আন্দোলনের সঙ্গে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ডুয়ার্সের চা বাগান শ্রমিকদের আন্দোলনের ফারাক আছে। আলোচনায় ঠিক হয়, প্রতিদিন সকাল ৭ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত এস্টেটের মূল গেটের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান। তাতে যোগ দেবেন সমস্ত শ্রমিক। এভাবেই টানা একমাস আন্দোলন চলেছে। প্রতিদিন সকালে ২ ঘণ্টা গানে-স্লোগানে-বক্তৃতায় হকের দাবি জানিয়েছেন চা বাগান শ্রমিকরা।
আন্দোলনকারী শ্রমিকদের অভিযোগ, মালিকপক্ষ প্রতিদিন ২ ঘণ্টা কাজ না করার জন্য টাকা কাটতে চেয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভের মুখে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, আলোচনা করেই এই সময় বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ এখন কেমন কাজ হচ্ছে তার উপর নির্ভর করছে সারা বছর ব্যবসা কেমন গড়াবে। তাই এই সময় আমাদের হকের দাবি জানাতে বেছে নিয়েছি।
শেষ পর্যন্ত মালিকপক্ষের টনক নড়ে। আলিপুরদুয়ারের ডুয়ার্সকন্যায় শ্রম কমিশনারের উপস্থিতিতে ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম ত্রিপাক্ষিক বৈঠক বয়কট করেন শ্রমিকরা। ৪ সেপ্টেম্বর ফের ডাকা হয় মিটিং। সেখানে শ্রমিকদের যৌথ নেতৃত্ব সিটুর পক্ষে বিদ্যুৎ গুণ, আইএনটিটিইউসির প্রভাত মুখার্জি ও বিটিডব্লুইউয়ের নেতা কিশুন মণ্ডল দাবিদাওয়া পেশ করেন। দীর্ঘ আলোচনায় শ্রমিকপক্ষ আপোসে রাজি ছিল না। রাতের দিকে সব দাবি মেনে নেন কোহিনূর চা বাগানের মালিক কেশব সিনহা।
বৈঠকে উপস্থিত সিটু নেতা বিদ্যুৎ গুণ জানিয়েছেন, ৫ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া ২৩ মাসের পিএফ জমা করে দেওয়া হবে। চলতি মাস থেকেই গ্র্যাচুইটির বকেয়া দেওয়া শুরু হবে। সংস্থায় রিপ্লেসমেন্টের কাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা হবে। বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
হক আদায়ের খবর বাগানে এসে পৌঁছতেই উল্লাসে মাতেন সবাই। একই সাথে ঠিক হয়ে যায় পরবর্তী লক্ষ্যের কথা। বাগানের ১০ বেডের হাসপাতালে বহুদিন আউটডোর বন্ধ। ডাক্তার-নার্স থেকে ওষুধ, নেইয়ের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। সদ্য হক আদায়ে সফল শ্রমিকরা এবার লড়বেন হাসপাতালের জন্য। সেই উচ্ছ্বাসের লাল-নীল-গেরুয়া… আরও কত রঙ
Comments are closed.