Kolkata Biryani History : বিরিয়ানির সৃষ্টি নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ! কিন্তু জানেন, কীভাবে বিরিয়ানি এল কলকাতায় ?
বিরিয়ানি শব্দটা উচ্চারণ করলেই, থুড়ি শব্দটা উচ্চারণ শেষ করার আগেই জিভটা জলে ভরে যায়। এটা অবশ্য বাঙালির সহজাত বৈশিষ্ট্য। তবে কলকাতা তথা ভারতবাসীর বিরিয়ানির প্রতি প্রেম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সে প্রেম টেম যাই থাক না কেন, আসল কথা হল এই বিরিয়ানি নামক খাবারটি আমাদের হেঁসেলে ঢুকল কোথা থেকে ?
Kolkata Biryani History অবশ্য একাধিক তথ্য সরবরাহ করছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবেন, তাই নিয়ে আবার দ্বন্দ্ব না লাগে। সেই দ্বন্দ্বে যাওয়ার আগে জেনে রাখা ভালো, বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ শব্দ থেকে। যার অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া।
প্রথম ব্যাখ্যা অনুযায়ী তামিল সাহিত্যে ‘ওন সরু’ নামক একপ্রকার খাদ্যের নাম জানা যাচ্ছে। এই খাবার আসলে ভাত, ঘি, মাংস এবং বিভিন্ন প্রকার মশলা সহযোগে বানানো হত, আর এর সময়কাল সম্ভবত দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। এর পরে অবশ্য আরব বণিকদের হাত ধরে দক্ষিণ ভারতে বিরিয়ানির প্রবেশ।
অন্যদিকে, আবু রাইহান অলবেরুনি সুলতানি আমলে রাজপ্রাসাদের যে খাদ্যের তালিকা দিয়েছেন, সেখানে অবশ্য বিরিয়ানি জাতীয় খাবারের উল্লেখ রয়েছে। তবে এই খাদ্য আদপে কতটা বিরিয়ানির কাছাকাছি ছিল সেই নিয়ে দ্বিধা রয়েছে।
এর পাশাপাশি ১৩৯৮ সাল নাগাদ তৈমুর ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন এবং ঠিক এই সময়ে তিনি তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীর জন্য রাঁধুনিকে ভাত-মাংস সহযোগে এক সুষম খাবার তৈরির নির্দেশ দেন। সেই খাবার আদৌ সুষম হয়েছিল কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, সেটি বিরিয়ানির কাছাকাছি পৌঁছেছিল সেই নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে একটা বিষয় মোটামোটিভাবে পরিষ্কার, তা হল আরব, তুর্কিদের হাত ধরে বিরিয়ানির ভারতে প্রবেশ হয়েছিল।
ওহ, আসল কথাটাই তো বলা হল না। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের উদ্যোগে নির্মিত তাজমহলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি। ইতিহাস বলছে, এই বিরিয়ানির সঙ্গে মমতাজেরও এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কথায় আছে, মুঘল সেনাবাহিনীর হাল হকিকত জানার জন্য একদা স্বয়ং সম্রাজ্ঞী সেনাবাহিনীর হেঁসেলে ঢুকে পড়লেন। হেঁসেলের শোচনীয় অবস্থা দেখে বিস্মিত মমতাজ মুঘল বাবুর্চিকে সেনাবাহিনীর জন্য ভাত, মাংস, মশলা সহযোগে এক সুস্বাদু খাবার তৈরির নির্দেশ দিলেন। যেমন নির্দেশ, তেমন কাজ। সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে গিয়ে রাঁধুনি যেটা বানিয়ে ফেললেন সেটা আজকের বিরিয়ানির চেহারা নিল।তারপরেই সম্ভবত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল বিরিয়ানি। স্থানভেদে স্বাদের পার্থক্যও দেখা দিল।
আর এই শহর কলকাতা? বাঙালি অবশ্য তার খাবার নিয়ে বেশ ওয়াকিবহল। স্মৃতিকার ভট্ট ভবদেব থেকে শুরু করে শ্রীনাথাচার্য সব্বাই বাঙালির মাংসের প্রতি প্রেমের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার নীহাররঞ্জন রায় বা সুকুমার সেন প্রত্যেকেই বাঙালির খাদ্যদ্রব্যের এক বিশাল তালিকা দিয়েছেন।
বিরিয়ানি বলতে পাগল আপামর কলকাতাবাসী। তবে এই শহরবাসীর বিরিয়ানির প্রতি এত্তোটা প্রেম এল কোথা থেকে? শুধু কি প্রেম, দূর থেকে বিরিয়ানির গন্ধ নাকে আসলে জাস্ট হামলে পড়ি আমরা। শুধু গন্ধ? আর ওই লাল কাপড়ে মোড়া বড় হাড়িটা যদি ভুল করেও চোখের সামনে এসে পড়ে, ব্যস তাহলে আর রেহাই নেই।
কলকাতায় বিরিয়ানির সূত্রপাত
এবার না হয় একটু দেড়শো বছর খানেক পিছিয়ে যাওয়া যাক। ঠিক সিপাহি বিদ্রোহের আগে ৬ মে ১৮৫৬ সালে লখনউয়ের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতা এসে পৌঁছালেন। আসলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। তাই তিনি চেয়েছিলেন কলকাতা হয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হবেন রানির কাছে আবেদনের জন্য। কিন্তু নির্মম পরিহাস, শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁর লন্ডন যাওয়া হল না। তাই তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে পাকাপাকিভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে অবশ্য কলকাতাবাসীর শাপে বর হল। তা না হলে হয়ত কলকাতাবসীর বিরিয়ানির খাওয়ার স্বাদ মিটত না।
ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতায় যখন বসবাস করতে শুরু করলেন, তখন বিভিন্ন নবাবী আদব কায়দা চালু করলেন। কলকাতা শহর প্রথম দেখেছিল রং বেরঙের ফানুস গঙ্গার দু’পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। মেটিয়াবুরুজের ১১ নম্বর বাংলোতে স্থান হয়েছিল নবাবের, মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে। যা কিনা বর্ধমানের রাজার সম্পত্তি ছিল।
কলকাতার রাঁধুনিদের খাবার মোটেই পছন্দ ছিল না ওয়াজেদের। নবাব সম্পর্কে বলা হত, ‘খানে অইর খিলানেকা শকিন’। আর তাই তো সদূর লখনউ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল নবাবের খাস রাঁধুনিদের। এদের রান্নার জাদুতেই এ শহর কলকাতা প্রথমবারের মতো বিরিয়ানির গন্ধ পেল। সময় তো আর থেমে থাকে না তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লখনউ বিরিয়ানির সঙ্গে কলকাতার বিরিয়ানির এক মেলবদ্ধন হয়ে উঠল। যেখানে নতুন রূপ পেল আমাদের কলকাতা শহরের বিরিয়ানি।
লখনউ অথবা আওয়াধি বিরিয়ানির সঙ্গে কলকাতার বিরিয়ানির কিন্তু কিছুটা হলেও পার্থক্য পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্য ওয়াজেদ আলি শাহ-এর কিছুটা হলেও অবদান ছিল। তিনিই নাকি তার রাঁধুনিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আওয়াধি বিরিয়ানির থেকে কম মশলা সহযোগে বিরিয়ানি তৈরি করতে। নবাবের আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা রাঁধুনির হয়ে ওঠেনি। আর তাই হয়তো মশলার ক্ষেত্রে একটু কৃপণতা রয়ে গেছে।
কৃপণতা বিষয় না হয় বোঝা গেল, তবে কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু ব্যবহারের রহস্যটা ঠিক কী? ভারতের কোথাও তো বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় না। তাহলে? আরে মশাই এর পশ্চাতেও যুক্তি রয়েছে। নবাব যখন কলকাতায় এলেন, আর্থিক দিক দিয়ে তাঁর অবস্থা খুবই সংকটজনক ছিল। মাংস ছাড়া বিরিয়ানি হয় না, আর তার পাশাপাশি মাংসের দামও একটা ব্যাপার। তাই বলে কি নবাবের অন্দরমহলে বিরিয়ানি তৈরি বন্ধ হয়ে যাবে? না, সেটাও আবার সম্ভব ছিল না। সেইজন্যই তো নবাব বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার প্রচলন করলেন। যার ফলে বিরিয়ানির স্বাদও মিটল এবং আর্থিক সাশ্রয়ও হল।
যেটা নবাব শুরু করে গিয়েছিলেন সেই ট্র্যাডিশান আজও চলে আসছে। নবাবের মৃত্যুর পর তার অনেক রাঁধুনির কাছ থেকে কলকাতার রাঁধুনিরা শিখে নিয়েছিল বিরিয়ানি তৈরি করার রেসিপি। আবার অনেকেই খুলে বসেছিলেন গোটা একখানি দোকান। শেষমেষ অবশ্য বলা যেতে পারে, এখন বিরিয়ানির পাতে আলু না থাকলে কিন্তু কলকাতাবাসীর মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে।
Comments are closed.