লকডাউনে মদ না পাওয়াটা আমার মতো লোকের পক্ষে বেশ বিড়ম্বনার কারণ। এতটা মাতাল নই যে, প্রায় দু’মাসের মদ স্টক করে রাখবো। এত কম মাতালও নই যে, দু’মাস খেলাম না, বয়েই গেল! এমন কথা বলে আত্মতৃপ্তি পাবো। সপ্তাহের শেষে একটু গ্লাস সাজিয়ে গান শুনবো, বই পড়বো, সাতপাঁচ ভাববো, তবে না প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত!
সাংবাদিকদের একটা সুবিধা আছে। অকারণে বহু লোককে চেনে এবং না চাইতেই সুবিধা পায়। দিল্লিতে আসা ইস্তক অকারণ যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করেছি বটে, কিন্তু তা এখনও সেই পর্যায়ে যায়নি যে পরিচিত পুলিশ অফিসারকে ফোন করবো, আর তার খোচর বাড়ি বয়ে বোতল এনে দিয়ে যাবে। আরও অনেক অসৎ সাংবাদিকের মতো আমিও প্রকাশ্যে এ সাহায্যের কথা হয়তো স্বীকার করতাম না, তবে লকডাউনের বাজারে একটা বোতল প্রাপ্তির সুযোগ থাকলে, হলফ করে বলতে পারি, যোগাযোগ কাজে লাগাতাম। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
অগত্যা উপায়? সপ্তাহে সপ্তাহে খাওয়ার জল দিয়ে যায় যে ছেলেটি, মনে আশার সঞ্চার ঘটালো সে। রান্না ঘরে লেবেল সাঁটা বাহারি খালি বোতল দেখেই নিশ্চয় আন্দাজ করেছিল। আমতা আমতা করে জিগ্যেসই করে ফেলল একদিন, ‘স্যরজি, কুছ চাইয়ে ক্যা?’
দেবদূত ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে মনে হল। মানে যাকে বলে মেঘ না চাইতেই জল। কিন্তু এই ছোঁড়া বোতল পাবে কোথায়? শেষে জাল মাল খাইয়ে মারার ব্যবস্থা করবে না তো? কিছুদিন আগে রাজধানীর অদূরে এমনই এক জাল মদের কারবারের খবর করেছিলাম যে! মধ্যবিত্ত সাংবাদিকের স্বভাব যায় না মলে। যেচে কেউ সাহায্য করতে চাইছে, তবু সন্দেহ।
‘স্যরজি, জাদা পয়সে নেহি লুঙ্গা। বাস, আপ খুশ হোকে দে দে না কুছ।’ ছোঁড়ার বক্তব্য, হরিয়ানা বর্ডার থেকে ব্ল্যাকে মদ তুলছে ওরা, তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে। তারপর লুকিয়ে তা নিয়ে আসছে এলাকায়। শ’দুশো টাকা বকশিশে পৌঁছে দিচ্ছে লকডাউনে দমবদ্ধ মধ্যবিত্ত ড্রয়িংরুমে।
দিলাম আনতে। লাগুক একটু বেশি দাম। খাওয়া তো যাবে একদিন রাজার মতো। হাতে টাকা গুঁজে দিলাম ছেলেটির। কথা দিল, ঘণ্টা চারেকের মধ্যে বোতল পৌঁছবে ঘরে। চার ঘণ্টা তো দূরঅস্ত, রাত ১২ টা পর্যন্ত ফোন করেও যখন সাড়া পেলাম না ছেলেটির, এক রাশ আক্ষেপ, বিরক্তি নিয়ে শুতে গেলাম। মনে মনে খিস্তি করলাম ‘ছোটলোক’ গুলোকে। এরা এমনই হয়। এদের বিশ্বাস করতে নেই। নইলে এভাবে মেরে দিল টাকাটা? বাছাই খিস্তির মন্ত্রপাঠ চলতে চলতেই এক সময় ঘুম এলো। পরদিন সকালেও ফোন করেছিলাম বার কয়েক। এ বার সুইচড অফ। কেয়ার টেকারকে বলে, সে দিনই নতুন জলের ছেলের নম্বর নিলাম।
রাত ন’টার পরে আচমকাই বেল বাজলো বাসার। খুলে দেখি হাতে প্যাকেট ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। এক রাশ ভয় নিয়ে মুখে। আমি কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ল। সামান্য খোঁড়াচ্ছে। প্যাকেট থেকে বার করলো একটা অর্ধেক ফাঁকা মদের বোতল।
এটা কী? ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো ছেলেটি। ‘স্যরজি মাফ কর দে না, কাল পুলিস পাকর লিয়া থা।’ পুলিশ পয়সা চেয়েছিল ওর কাছে। অনেক খুঁজেও এক নোয়া পয়সা বার করতে পারেনি। আমার বোতলটা স্কুটারের সিটের তলা থেকে উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু একটা বোতল যথেষ্ট জরিমানা নয়। তাই সারা রাত পালা করে পেটানো হয়েছে ওকে। যে বোতলটা নিয়ে এসেছে, সেটা ওর বাড়িতে রাখা ছিল। দাদা-ভাই মিলে কোনও কোনও রাতে সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতো দুপাত্তর সাক্ষী রেখে। আজ আমার জন্য নিয়ে এসেছে সেটাই। প্রায়শ্চিত্য
খেলাম। দু’জনে মিলেই খেলাম। আর শুনলাম গল্প। প্রতি ২০ লিটার জলের জার ফেরিতে মালিক দেয় ১০ টাকা। বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে যা রোজগার হয় তাতে হাত খরচ বাঁচিয়ে কেবল বাড়ির বাজারটুকু হয়। বাবা অথর্ব। বাকি সংসার চলে দাদার টাকায়। সিকিওরিটি গার্ড। লকডাউনেও সাইকেল চালিয়ে কাজে যাচ্ছে রোজ। কিন্তু বেতন হয়নি। মালিক বলেছে, সব খুললে অল্প অল্প করে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করবে। না পোশালে ছেড়ে দিতে পারে।
পোশায় না। দু’পেগ সস্তা হুইস্কি পেটে ঢেলে দু’চোখ লাল হয়েছে ছেলের। জিভে জড়তা এসেছে, খুলেছে মনের লাগাম। দাদা বলেছে সামনের মাসটাও এমন চললে সুইসাইড করবে। তাই ব্ল্যাকে মদ তোলার কাজ শুরু করেছে আমার জলবাবু। এ কাজে ঝক্কি আছে। পুলিশ হয়রান করছে। কিন্তু সফল ভাবে একটা বোতল পাচার করলে শ’দু’শো বকশিশ মিলছে। সপ্তাহে পাঁচশো হলে, কড়াইয়ে তেল দিয়ে রান্না। নইলে সেদ্ধ। বাড়িওয়ালা দু’মাসের ছাড় দিয়েছে ভাড়ায়। পরে সুদসহ সে টাকা ভরে দিতে হবে। বেরনোর আগে আমাকেও ছেলে আশ্বস্ত করে গেল, আগামী ছ’মাসে বোতলবাবদ যে টাকা দিয়েছিলাম, ফেরত দিয়ে দেবে। অকপট তাকিয়ে থাকলাম ওর মুখের দিকে। দু’পাত্র সস্তা হুইস্কির নেশা শব্দ জোগানে লকগেট ফেলল।
মধ্যবিত্ত তো। নেশা এবং গতরাতের দুর্বলতার খোয়ারি কাটতে সময় লেগেছে এক রাতের ঘুম। পর দিন হ্যাংওভারের বিরক্তি নিয়েই ফের বোতল সন্ধানের চেষ্টা শুরু হল। এক বন্ধু মারফত যোগাযোগ হল ন’কিলোমিটার দূরে আরেকটি ছেলের সঙ্গে। বাড়ির দালালের শাগরেদি করে চার পয়সা রোজগার। লকডাউনে ব্রোকারি অফিসে তালা ঝুলেছে। পেটেও। তার মধ্যে দু’মাস আগে বিয়ে করেছে একটি বাঙালি মেয়েকে। এটা শুনে কেন যেন, একটু বেশিই উৎসাহ পেলাম। দেওয়া গেল নতুন অর্ডার। কথা দিল, রাতের মধ্যে বোতল পৌঁছে যাবে। রাত আটটা, ভাঙা বাংলায় যে ফোনটা এলো, তাতে নারীকণ্ঠ। পুলিশের চারটে নাকা বন্দি পেরিয়ে নেব সরাইয়ে ঢুকে সে জানতে চাইছে, আর কত দূর আসতে হবে। দেওয়া গেল ডিরেকশন। মিনিট দশেকে স্কুটার এসে থামলো বাড়ির দুয়ারে। বাজারের ব্যাগে গাদাখানেক রেশনের আড়ালে আমার বোতল। আজ প্রথম ডেলিভারি দিল মেয়েটি। বরকে পুলিশ ধরেছিল ক’দিন আগে। তারপর ঠিক হয়েছে, বর শুধু গুদাম থেকে ব্ল্যাকে মাল নিয়ে আসবে, ডেলিভারি দেবে বউ। মেয়ে দেখলে পুলিশ সন্দেহ করবে না।
”একটু জল দেবেন ভাইয়া। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে”। তিন গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে মেয়েটি বলল, এই ব্যবসা করতে হবে ভাবিনি। লকডাউনের পরে দু’জনে ঠিক করলাম, সবজি বেচবো। শুরুও করেছি। কিন্তু আমাদের মতো সকলেই তো একই কাজ করছে। সবাই সবজি নিয়ে বসে পড়েছে। ফলে ওই রোজগারেও সংসার টানতে পারছি না। অগত্যা।
অগত্যা দু’শো টাকা বেশিই দিলাম বছর পঁচিশের মেয়েটির হাতে। কথা আদায় করে নিলাম, বাড়ি ফিরে একবার যেন জানায়। যাওয়ার আগে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করেছিলাম ওকে, তোমাদের করোনার ভয় নেই? হাসতে হাসতে ও উত্তর দিয়েছিল, ”ভাইয়া বাড়ি চিনে গেলাম তো! এরপর মদ লাগলেই বোলো। আরও তাড়াতাড়ি দিয়ে যাবো। করোনায় ভয় পেলে হবে? পেটে খিদে আছে যে!” দু’শো টাকা বকশিশ দিয়ে পেটের খিদে যে কেনা যায় না, সে কথাটুকু বোঝার আগেই হেলমেট লাগিয়ে ছুট দিলো লাল রঙের স্কুটি।
সম্পাদক মশাই যখন এ লেখার বরাত দিয়েছিলেন, ভেবেছিলাম কোনও এক সপ্তাহান্তে দু’পাত্র চড়িয়ে দিল্লির পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে লিখব। এই বাজারে ওঁদের দুর্দশা বাজার খাচ্ছে ভালো। পারলাম না লিখতে, মাপ করবেন।
Comments are closed.