Lockdown: করোনা আমার এতকালের লালিত জীবনবোধ তছনছ করে দিয়েছে, আত্মকেন্দ্রিক জীবনবোধের মূলেই যেন আঘাত হেনেছে
আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মোড়কে আত্মকেন্দ্রিকতার এই বীজমন্ত্র জীবনে অনুশীলনের নামই সভ্যতা-আধুনিকতা! একমাত্র মুনাফা অর্জনই মানব জগতের অভীষ্ট হওয়া উচিত, এটাই পুঁজিবাদের শিক্ষা। কার্ল মার্ক্সের পর্যবেক্ষণ। শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপের সেই বীক্ষাই আমাদের মতো সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা পুঁজির বিকাশশীল দেশেও শিকড় চাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ‘…স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ..’ ইত্যাদি জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা বা ভাব সম্প্রসারণ লিখলেও, জীবনের বেড়ে ওঠার অনুশীলনে তার কোনও জায়গা ছিল না। শিশু শিক্ষা থেকে কর্মজীবনের প্রতিপদে একই অনুশাসন-গোপালের অতি সুবোধ বালক হওয়ার পথে অপরকে ল্যাং মেরে আমায় পরের সিঁড়ি দখলের দুর্মর সাধনা। মুনাফা নির্ভর সভ্যতার অভিজ্ঞান।
মুখে সমাজ বদলের বুলি আওড়ে ব্যষ্টি ছেড়ে ব্যক্তির কেন্দ্রে নিজেকে নিয়ে নিজের পরিবারের পরিসরে মগ্ন থেকেছি। ডুব দিয়েছি ব্যক্তিগত লাভালাভের কৌশল অন্বেষণে।
করোনা তথা কোভিড-19 আমার এতকালের লালিত জীবনবোধ তছনছ করে দিয়েছে। এই নিরঙ্কুশ আত্মকেন্দ্রিক জীবনবোধের মূলেই যেন আঘাত হেনেছে।
তিন দশক ধরে নানা ঘাটের জল খেয়ে সংবাদকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেছি। স্বাভাবিকভাবেই সমাজকে কিছুটা খণ্ডিত হলেও পর্যবেক্ষণের সুবিধা পেয়েছি। সুযোগ পেলেই সামাজিক সুস্থিতি, ঐক্য, সংহতির পক্ষে সওয়াল করেছি। বিশ্বায়ন উত্তর কালে বাজার না মানুষ, কার প্রতি দায়বদ্ধ থাকাটা সমীচীন তা নিয়ে দ্বন্দ্বেও ভুগেছি। শেষ পর্যন্ত নিজের মাথা বাঁচাতে কালে কালে বুঝে ফেলেছি, বাজারই ‘…কেবল সত্য / আর তো সবই ভুষি’। তাই দিনান্তে ঘরে ফিরে নিজের পরিবারের কেন্দ্রে নিজেকে সপেছি উটপাখির মত। সতত সজাগ আমি, বহির্জগতের কোনও অস্থিরতা যেন আমার বিবেকের ফুসলানিতে ইন্ধন না যোগায়।
আজ লকডাউনের আবহে এই গৃহবন্দি দশা যেন আমাকেই ব্যঙ্গ করছে। জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, আমার স্ত্রী ও কন্যা কলকাতা থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে দেশের অন্যতম করোনাগ্রাসী রাজ্য মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে। ঘরবন্দি তাঁরাও। এই পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা আমার নবলব্ধ উপলব্ধির অনুঘটকের কাজ করেছে। এই ব্যক্তিগত বিপন্নতা বোধ আমায় কান ধরে শেখাচ্ছে – একা বেঁচে থাকার আজীবন লালিত নানা ফন্দি ফিকির কতটা ঠুনকো। কতটা অসহায় ব্যক্তি আমি। তাই দিনে বারংবার ফোনে ওদের খোঁজ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজর চালাচ্ছি দুনিয়ার করোনা সংক্রমণের। হাল হকিকত বুঝতে চাইছি দেশের, সর্বশেষ বাংলার। এই করোনা মহামারীর যেহেতু কোনো শ্রেণি বিভাজন নেই, নেই কোনও ধর্ম-বর্ণ, সাদা-কালো রঙের বৈষম্য, তাই এতদিনের চর্চিত সমাজনীতি, রাজনীতির ফর্মুলায় এই সংকট থেকে নিস্তারে অধরা। স্পষ্টতর হচ্ছে সেই ধারণা, করোনা পর্ব কাটার পর সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
মালুম পাচ্ছি, সংশয় কাটছে লড়াইটা আর আমার পারিবারিক বৃত্তে আবদ্ধ নয় ।
এসবই তো রাজনীতির বয়ান হয়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় একদল দেখছি সরব, ‘এখন রাজনীতির সময় নয়’ বলে জ্ঞান বিতরণে ব্যস্ত। আমার এই গৃহবন্দি দশায় উল্টোটাই মনে হচ্ছে। আমাদের চেনা ছকের রাজনীতির পরিসর বদলাতে হবে। যে রাজনীতি নির্মাণ আমাদের আশু কর্তব্য। এই যে আমি স্ত্রী ও কন্যার জন্য উদ্বেগে অস্থির তার নিরসনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ থেকে নিজের ঘরে ফিরতে চাওয়া হাজার হাজার প্রবাসী দিনমজুরের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নতুন রাজনীতিতে মানব সমাজের সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্প। এই চাহিদাটা রাজনীতির বাইরে নয়। সামাজিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে সেই রাজনীতি। শুধু আমার পরিবারের সুরক্ষা বৃহত্তর সমাজকে এড়িয়ে সম্ভব নয়। সমগ্র সমাজের আজ-কাল-পরশুর সার্বিক সুরক্ষার গ্যারান্টি হতে পারে নতুন রাজনীতি। সেই সার্বিক সুরক্ষার আওতায় শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, আম জনতার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য রক্ষায় নিশ্চয়তা জরুরি।
করোনা পর্বে উদ্ভূত সংকটের বীজ রয়েছে নয় উদারবাদী বিশ্বায়নের মধ্যে। পুঁজির অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ তুলে এমনই দাবি করেছেন নবতিপর মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী নোম চমস্কি। তিনি বলছেন, ২০০৩ সালে তাঁর দেশে সার্স প্রাদুর্ভাবের সময় স্বল্প খরচে ভেন্টিলেটর তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল মার্কিন স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু নয়া উদারবাদ নির্ভর অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা তাতে বাঁধ সাধল। কেননা ওই লগ্নিতে মুনাফা মোটেই তাদের পক্ষে উৎসাহব্যঞ্জক নয়। প্রকল্পটি খারিজ করে মার্কিন প্রশাসন। বতর্মানে ধনীতম মার্কিন মুলুকের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কেমন বে-আব্রু করে দিয়েছে করোনা। পুঁজিবাদের পীঠভূমি বেসামাল। গোটা ইউরোপও তাই। পরিস্থিতি সামাল দিতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমাজিকীকরণের রাস্তা ধরছে ,যা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনেতিক বীক্ষায় ঘোরতর পাপ। স্পেন এই সঙ্কট থেকে উতরে যেতে দেশের সবকটি বেসরকারি হাসপাতালকে রাষ্ট্রীয়করণ করছে। বাজার অর্থনীতির অগ্রাধিকারে জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত। আমার দেশেও হাজার হাজার কোটি ব্যয়ে মনো রেল বা স্ট্যাচু তৈরি অগ্রাধিকার পায়। করোনা পরীক্ষার কিট অমিল। সেখানে বেসরকারি লগ্নি দূর অস্ত, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও অপ্রতুল। মনে রাখতে হবে, অর্থনীতির এই অগ্রাধিকার বোধটাও নির্দিষ্ট রাজনীতির অঙ্গ। এখন বিপাকে পড়ে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশও বেসরকারি ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে বাধ্য হয়েছে, যে কাজ এতকাল সমাজতন্ত্রের ভূত বলে চিহ্নিত হত। করোনা বিপন্ন এই লকডাউন কি এতই শিক্ষা দিল? প্রশ্নটা রাজনৈতিক। ঘরের দরজা এঁটে থাকলেও আমার নতুন উপলব্ধি-জীবনবোধের অভিমুখ ব্যক্তি নয় সমষ্টি। সেই সমগ্রের ভবিতব্যের সঙ্গে এক সূতোয় বাঁধা পড়েছি আমি ও আমার প্রবাসী পরিবার।
Comments are closed.