প্রথম যখন করোনাভাইরাসের কথা শুনলাম, সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মতোই আমিও ভেবেছিলাম, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরা এর ওষুধ বা ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা পদ্ধতি খুব দ্রুত আবিষ্কার করে ফেলবেন। দূর কল্পনাতেও ভাবিনি, এরকম ভয়াবহ আকার ধারণ করবে পরিস্থিতি।
আজ দু’সপ্তাহের ওপর লকডাউন অবস্থায় রয়েছি। চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন, ডিম ও অন্যান্য কিছু অত্যাবশ্যক সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু লকডাউন শেষ হওয়া পর্যন্ত সে ভাঁড়ার চলবে না। তাই অগত্যা ফের দোকানে যেতে হল। পাড়ার দোকানে প্রথম দিকে ভিড় উপচে পড়ছিল, প্যানিক বাইং চলছিল, ইদানীং সেটা কিছু কমেছে দেখছি। ক্রেতারা দূরত্ব বজায় রেখে সারি দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, বেশিরভাগই মুখে মাস্ক পড়ে। কেনাকাটার পরে খুচরো পয়সাটা কী করবেন, কোথায় রাখবেন, এক ভদ্রলোক অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষমেশ পকেটেই রাখলেন।
অনলাইন শপিং করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ডেলিভারি স্লট পেতে ব্যর্থ হলাম। আমরা কসবায় থাকি, এদিকে এখনও ঠেলা গাড়ি নিয়ে, মুখে মাস্ক পরে সবজি বিক্রি করতে আসেন কয়েকজন। তাঁরাই ভরসা। কখনও ভাবিনি এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। বরাবর ভেবেছি, ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় তো করা দরকার, ভেবে অনেক ইচ্ছে ত্যাগ করেছি। কত জায়গা দেখা হয়নি। আজকে দাঁড়িয়ে এটাই মনে হচ্ছে, সুযোগ তো বারবার আসে না, তাই যখন আসে, তার সদ্ব্যবহার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জানি না, সেই সুযোগগুলো আবার আসবে কিনা কোনওদিন! মনে পড়ছে, জন লেননের কথা, “life is what happens to you, when you are busy making other plans”…..
কোনওদিন খাবার নিয়ে বা জীবনধারণের ন্যূনতম জিনিসগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে ভাবিনি। তবে এটা ঠিক, আমি ও আমার পরিবার, আমরা খুবই ফ্লেক্সিবল। এবং যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিতে পারবো, এই বিশ্বাস রাখি। কষ্ট হয় যখন দেখি দিনমজুরদের অবস্থা…… আমার এটাও মাঝে মাঝে মনে হয়, এই অবস্থায় তো আমরাও পড়তে পারি কোনওদিন, যদি দ্রুত এই পরিস্থিতির নিষ্পত্তি না হয়! জীবনহানির মতোই হাহাকার তৈরি করতে পারে আর্থিক মন্দা। সারা বিশ্বে।
আসলে এরকম সময়েই বোধ হয় বোঝা যায়, টাকা পয়সা, সামাজিক অবস্থান, এসব ব্যক্তিগত জায়গায় কতটা অর্থহীন। এখন পরিস্থিতি আবার আগের মত হয়ে গেলে আমরা কতটা এই কথাটা মনে রাখতে পারি সেটাই দেখার। একটা ভালো ব্যাপার হয়েছে, আজকাল প্রত্যেকদিন বিকেলবেলায় আমরা ছাদে যাই। গাছগুলোতে জল দিই, সূর্যাস্ত দেখি, পাখিদের ঘরে ফেরা দেখি। পাড়ার আরও অনেকে সেই সময়ে ছাদে ওঠেন। গল্প হয় একসাথে। আমাদের ছোটবেলায়, বছরের এরকম সময়ে বিকেলবেলায় ছাদে বসতাম, গাছে জল দিতাম, সূর্যাস্ত দেখতাম, আর অবাক হয়ে দেখতাম পাখিদের ঘরে ফেরা। ফুরফুরে হওয়া দিত, নীল আকাশ হত। বসন্তকালকে আবার অনুভব করতে শুরু করেছি এখন নতুন করে। ছোটবেলা ফিরে পেলাম যেন। লম্বা নিঃশ্বাস নিলে এখন আর ভারী লাগে না, বাতাসে দূষণের পরিমাণ যে কমে গিয়েছে তা আর বলে দিতে হয় না। রাতের আকাশে আবার তারা দেখতে পাই, ঠিক যেমন আগে দেখতাম।
পরিচারিকাকে ছুটি দিয়েছি আগেই। মাঝে একদিন ফোন করে খবর নিলাম, সবাই কেমন আছেন বাড়িতে। শুনে অবাক লাগে, এমন মানুষও আছেন, যাঁরা এই সময়ে পরিচারিকার বেতন কাটেন।
সাধারণ সময়ে ছুটির দিনগুলিকে স্পেশাল ডে বলে মনে হয়। সব সময় যদি ঘরে থাকতে হয়, তখনই বোঝা যায়, কাজ থাকলেই ছুটির মজা, নয়ত কিছুই নয়! তবুও চেষ্টা করছি এই সময়টা যতটা সম্ভব প্রোডাক্টিভভাবে কাটাতে। দু’জন মিলে ঘর গুছিয়ে রান্না করে, বাসন মেজে, কাপড় কেচে যেটুকু সময় থাকে, সেই সময়টা গান শুনছি, ছবি আঁকছি, নাচ প্র্যাকটিস করছি। তার সাথে অফিসের কাজ তো আছেই। কালকে একটা কঠিন কাজ সেরেছি, আলমারিটা গুছিয়ে ফেলেছি। ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের নেশা কাটানোর চেষ্টা করছি। তার সঙ্গে হু হু করে ভরে উঠছে মোবাইল ফোনের স্টোরেজ, যার বেশিরভাগটাই করোনাভাইরাস বিষয়ক সতর্কবার্তা, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, কিছু ভুয়ো খবর, আর কিছু ওষুধের প্রেসক্রিপশন। বলাই বাহুল্য সেগুলো আসছে এমন কিছু বন্ধুর থেকে যাঁরা ডাক্তার নন! অযথা বিভ্রান্তি বাড়িয়ে কী লাভ কে জানে।
তাছাড়া এরকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি, যাতে সারা বিশ্বের এত মানুষ মারা যাচ্ছেন, কত লোক জীবিকা হারিয়েছেন। আরও কতজন কত রকমের বিপদে পড়েছেন। এরকম একটা পরিস্থিতি নিয়ে কী করে কিছু মানুষ ঠাট্টা, ইয়ার্কি করেন, সেটা ভাবতে অবাক লাগে। অবাক লাগে ভাবতে, মানুষ এতটা স্বার্থপর। যতক্ষণ না কোনও বিপদ আমাদের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, ততক্ষণ সে বিপদ অন্যের, আর তা নিয়ে তামাশা করার অধিকার আছে? এটাই কি তবে আমরা ঠিক বলে জানি, আর এটাই কি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাই?
ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটারস স্ক্যোয়ারে একাকী পোপের ছবিটা দেখে খারাপ লেগেছিল। সমগ্র মানব জাতির অসহায় প্রার্থনার প্রতীকী ছবি যেন। লকডাউন আমাদের প্রচুর অসুবিধের মধ্যে ফেলেছে, আবার অনেক কিছু শিখেওছি আমরা। লকডাউন শেষ হয়ে গেলে, পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলে, আমরা সেই শিক্ষাগুলো কাজে আর বিশ্বাসে লাগাতে পারি কিনা, সেটাই জানার। অবশ্য পরিস্থিতি ঠিক কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় আমরা সবাই। সমগ্র বিশ্ব। অবাক লাগে শুধু এটা ভেবে, এত বিশাল কর্মকাণ্ডে আমিও তো স্থান পেয়েছিলাম…… শুধুমাত্র আর একটা সুযোগ পেলে, এই জীবন ব্যর্থ হতে দেব না। একথা আজ মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।
(রিখিয়া বসু একটি প্রখ্যাত হোটেলের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের মুখ্য আধিকারিক, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী)
Comments are closed.