Lockdown London: মমতা ব্যানার্জির কার্যপদ্ধতি এখানে তুলে ধরা গেলে হয়তো এই মৃত্যুমিছিল দেখতে হত না! রোজ ভাবি কবে দেশে ফিরব
২০০৮ সাল থেকে আমি লন্ডনে আসছি। কাজের সূত্রেই যেতে হয়েছে বহু দেশে। কিন্তু কখনও ভাবিনি নিজের জন্ম শহর কলকাতাকে ছেড়ে একদিন এই বিলেতেই পাড়ি দিতে হবে। গত তিন বছর ধরে এই লন্ডনেই আমার বসবাস। থাকি পূর্ব লন্ডনে রেইনহ্যাম নামের একটা জায়গায়। আসলে কাজের জন্য এসে কিছুদিনের মধ্যে ফিরে যাওয়া আর পাকাপাকিভাবে থাকা, এই দুটোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা বিশাল ফারাক আছে। সেটা নিয়েই মোটামুটি মানিয়ে গুছিয়ে চলা শুরু করেছিলাম। ধাক্কাটা খেলাম এই করোনাভাইরাসের গুঁতোয়।
শুনেছিলাম, উপমহাদেশ থেকে এসে ব্রিটেন বা আমেরিকায় থাকলে প্রত্যাশার পরিমাণটা রোজ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিমি দুনিয়ার সভ্যতা, পরিবেশ এবং সর্বোপরি সামাজিক শিক্ষা, এটার সঙ্গে আমাদের বেড়ে ওঠাটা খাপ খায় না কোনওভাবেই। আর লন্ডনে থাকাকালীন আমারও সেটাই হয়েছে। তাই এটাই বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বিলেতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল পরিচালক ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেস বা NHS-এর চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই উন্নত যে এরা কাউকে মরতে দেবে না।
কিন্তু যে দৃশ্যটা আজকের লন্ডনে বসে দেখছি, তা এককথায় ভয়াবহ। পুরো চিড় ধরিয়েছে আমার যাবতীয় কনফিডেন্সকে। আমার এই লেখার সময় অবধি সরকারি হিসেবে ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে শুধুমাত্র হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা ১৬,৫০৯। আর দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১,২৪,৭৪৩। হাসপাতালের বাইরে, অর্থাৎ কেয়ার হোম বা নিজ বাসভবনে মৃতের সংখ্যা কিন্তু সরকারি তরফে এখনও আমরা কেউ জানি না। ডাক্তারি মহলে যা শোনা যাচ্ছে তাতে ওই সংখ্যাটা হাসপাতালে মৃতের সংখ্যার থেকে খুব একটা কম হবে না। এই বিলেতকে তো এইভাবে দেখব বলে স্বপ্নেও ভাবিনি।
মহামারি শব্দটা ছোটবেলা থেকে ইতিহাসের বইয়েই পড়েছিলাম। জীবদ্দশায় দেখে যাব তাও আবার খোদ এই লন্ডন শহরে বসে, এটা ভাবতে পারিনি। আসলে ইউরোপের কোনও দেশই এই ভাইরাসটাকে শুরুতে পাত্তা দেয়নি। এখন সেটার মাশুল দিতে হচ্ছে। যখন পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন ব্রিটেনে আগামী ৭ মে অবধি লকডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে লকডাউন জুন অবধি বিভিন্ন খাতে চলতে পারে। তবে এটা বলতেই হবে যে লকডাউনটা আক্ষরিক অর্থে এখানে সবাই খুব মেনে চলছেন। শিক্ষিত দেশ বলেই হয়তো প্রশাসনকে এটা নিয়ে বেগ পেতে হয়নি। রাস্তায় লোকজন প্রায় দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। কিন্তু এর মধ্যেও চলছে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের বেশ কিছু ট্রেন, রাস্তায় চলছে বাস, চলছে দূরপাল্লার ট্রেনও। লকডাউনে এটা কি দরকার ছিল? ভারতের মতো ১৩০ কোটির দেশে যদি জল-স্থল-অন্তরীক্ষের পরিবহণ ব্যবস্থাটাকে বন্ধ করে দেওয়া যায় তো ব্রিটেনে কেন সম্ভব না? এর উত্তর তো আমার কাছে নেই। মজার বিষয় হল, রোজ এত মৃত্যুমিছিলের খবর বেরোনো সত্ত্বেও রাস্তায় কাউকে মাস্ক পরে বেরোতে দেখিনি।
বিলেতে ঘরবন্দি আছি বলেই হয়তো বেশি করে মনে হচ্ছে আমাদের ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ অনেক নিরাপদ স্থান। স্থানীয় ব্রিটিশ চ্যানেলেগুলোর খবরেও দেখলাম আজ থেকে কেরালা ৭ টা জেলায় লকডাউন শিথিল করছে। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। এমনকী আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েও কার্যপদ্ধতিকে এখানে কোনওভাবে তুলে ধরা যেত তাহলে হয়তো এই মৃত্যুমিছিল দেখতে হত না। রাতারাতি একটা স্টেডিয়ামকে হাসপাতালে বদলে ফেলা বা আস্ত একটা সরকারি হাসপাতালকে শুধুমাত্র করোনার জন্য নিয়োজিত করা কিংবা নিজের সংক্রমিত হওয়ার ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সব জায়গায় সরেজমিনে তদারকি করা, তার উপরে রোজ সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত আশ্বস্ত করা, তাঁদের সাহস জোগানো এটা নিঃসন্দেহে অভাবনীয়। আমার মনে হয় ভারতের থেকে শুধু হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ নেওয়া নয়, “ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’-টাও পশ্চিমি দুনিয়ার শেখা উচিত।
লন্ডনকে এখন আক্ষরিক অর্থেই ‘ঘোস্ট টাউন’ বলা হচ্ছে। অধিকাংশ হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর। নেই PPE কিট। এখানকার NHS (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) ডাক্তার আর নার্সের সংকুলানে ভুগছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় লন্ডনে বড় সংখ্যক এশিয়ান বা বিশেষ করে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মানুষ মারা যাচ্ছেন। যাঁদের বয়স কিন্তু বেশি না। ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। স্থান সংকুলানে দেওয়া হচ্ছে গণকবর। এক অবস্থা বার্মিংহ্যাম, ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, লীডস-এর মতো শহরগুলোতেও।
আমার ফ্ল্যাটটা রেইনহ্যাম রোডের উপরেই। ঘরবন্দি হয়ে আছি গত তিন সপ্তাহ থেকেই। বাইরেটা পুরো শুনশান। অথচ এই সময় লন্ডনে রোজ রোদ ঝলমলে দিন। এই দেশে রোদ দেখতে পাওয়াটা বলা বাহুল্য ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু কিছু তো করার নেই। ঘরেই থাকতে হবে। কাজ ছাড়া বাইরে বেরোলে ন্যূনতম ৬০ পাউন্ড থেকে শুরু করে ৬৫০ পাউন্ড অবধি জরিমানা কিংবা হাজতবাস দুইই হতে পারে। তাই আইন অমান্য করার সাহস কেউ এখানে দেখায় না। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে যাওয়ার ব্যাপারে বিধি নিষেধ নেই। তাই ক’দিন গিয়েছিলাম কাছের সুপার মার্কেটে। খুব ভয়ে ভয়ে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, দোকানে লোকে সোশ্যাল ডিস্টেনসিং মানলেও কারও মুখে মাস্ক নেই। হাইজিন ব্যাপারটা তো সাহেবরাই শিখিয়েছে বলে জানতাম। সেখানে এরাই এটা মানছে না দেখে হিসেবটা মেলাতে পারি না। ব্রিটিশ গ্রোসারি ব্র্যান্ডগুলো দাম না বাড়ালেও দেশিয় দোকানগুলো মাঝে প্রচুর দাম বাড়িয়েছিল। পরে সরকারের হস্তক্ষেপে সেটা নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে প্যানিক বায়িংটা বিশালভাবে বেড়ে গিয়েছিলো মাঝখানে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আগামী সপ্তাহ থেকে এই ভাইরাসের টিকা নাকি মানবদেহে পরীক্ষা করবেন। শিম্পাজিদের উপর দিয়ে সেটা হয়ে গিয়েছে। আশা করছি এটা আমাদের শরীরেও কাজ দেবে। রোজ রাতে শুতে যাওয়ার সময় ভাবি কবে দেশে ফিরতে পারব। ব্রিটেনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি যে কবে আসবে তা বোধহয় এখন কলকাতার জ্যোতিষীরাও বলতে পারবেন না। এটা হয়তো তাঁদেরও সিলেবাসের বাইরে!
Comments are closed.