পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের শুরু। মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে দেওয়া হয় তর্পণ। কেন এই তর্পণ দেওয়ার পদ্ধতি? ঠিক কোন উদ্দেশে? দেবতর্পণ, মনুষ্যতর্পণ, ঋষিতর্পণ, দিব্যপিতৃ তর্পণ, যম তর্পণ, পিতৃতর্পণ প্রভৃতি মন্ত্রে তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু কী কারণে মহালয়াকে দুর্গাপূজার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়?
অভিধান অনুযায়ী, ‘মহালয়’ হল মহৎ আলয় বা আশ্রম বা তীর্থ। মহালয়কে পরমাত্মাও বলা যায়। কালিক বিচারে, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ব কৃষ্ণপক্ষ বা অপরপক্ষ। মনে রাখতে হবে, মহালয়া অপরপক্ষ। আশ্বিনী অমাবস্যা। এ হল পিতৃপুরুষের উৎসবের আলয়। দেবতর্পণ, ঋষিতর্পণের মধ্যে সে সবের সূত্র মেলে। মানুষ যে বেঁচে থাকে, নানা সম্পদ পায় নানা উৎস থেকে, সে যেমন জড় বস্তু হতে পারে কিংবা ভাববস্তু, সে সবের জন্য সে ঋণী, তার পূর্বপুরুষের কাছে, আচার্যের কাছে, নদী, বায়ু, সব ভূতের নিকট। তার শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতাও এক ধরনের তর্পণ।
মহালয়াকে কেন নারীশক্তির বিজয় বলে ধরা হয়? কী তার কারণ? এখানে তো নারীর কোনও উল্লেখ নেই সেই বিশেষ অর্থে। যা আছে, তা হল—অপরপক্ষ। আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ব কৃষ্ণপক্ষ। এই কালো পক্ষর মধ্যে কি লুকিয়ে আছে শুক্লপক্ষ বা বিজয়ের ভাবনা? সে সব কথা পাওয়া যেতে পারে নানা শাস্ত্রে। যদি আমরা দুর্গাপূজাকে রাজা সুরথের কিংবা বৈশ্য সমাধির পূজা বলে ধরে নিই, যা হয়েছিল মেধা মুনির আশ্রমে কাছে নদীর তীরে, তার নিয়মনীতি কিংবা কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণে বর্ণিত পূজাপ্রণালী এক ও অভিন্ন নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত, দেবীভাগবত পূরাণের মধ্যেও পূজার যজ্ঞের তফাত রয়েছে। সুরথ রাজাকে প্রজারা তাড়িয়ে দিলেও তিনি তাদের ভালমন্দের জন্য কাতর ছিলেন, সমাধিও চিন্তিত ছিলেন অকৃতজ্ঞ পরিবারের সদস্যদের জন্য। তাই তাঁরা মহামায়ার সাধনা করেন। আশ্বিনী অমাবস্যায় সেই সাধনার শুরু ছিল না, তা ছিল বাসন্তী পূজা। শারদীয়া দুর্গাপূজা অকাল বোধন। তবে কী হবে মহালয়ার? তাকে কী ভাবে সংযুক্ত করা যাবে এই পূজার সঙ্গে?
জয়ের জন্য দেবী দুর্গা পেলেন অনেক অস্ত্র। কে দিল সেই সব হাতিয়ার? অস্ত্রপূজার অস্ত্রগুলো হল ত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, বাণ, শক্তি, ঢাল, ধনুক, ঘন্টা, পরশু, নাগপাশ ইত্যাদি। মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু এবং বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘন্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দিলেন রশ্মি, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশু, হিমালয় দিলেন সিংহ। সবই দেবতাদের দান। শুধু শরীর হল দেবীর।
এই বার আসা যাক, মহালয়ায়। পিতৃতর্পণ, দেবতর্পণে। আসলে এই সব পুরুষপ্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্রে ভূষিত দেবীর বিজয়ই নারীশক্তির জয়। মহামতি আকবরের সময়কালে রাজশাহীর তাহিরপুরে রাজা কংসনারায়ণ যে দুর্গাপূজা করেন, যার পুরোহিত ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী কিংবা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রাচীন দুর্গাপূজার সঙ্গে মহালয়ার সে রকম সখ্য ছিল না। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে এর উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ আছে, দেবী দুর্গার যুদ্ধের আহ্বান শুনে মহিষাসুর লালসা প্রকাশ করে। সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে আকন্ঠ আসবপানে উন্মত্তা দেবী ওই অসুরকে হত্যা করেন। এর মূলে জয়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল না, ছিল অপমানের বদলা নেওয়ার বাসনা। আজ নারীদের উপর অত্যাচার, অপমান ও ধর্ষণে সেই কথা সকলের মনে পড়ুক। মহিষাসুরই কি সত্যিই অপরপক্ষ? নাকি তাকে ফাঁসানো হয়েছে? সেই আলোচনাও উঠে আসুক।
মহাভারতে দেখা যায়, পাণ্ডবরা যখন অজ্ঞাতবাসে, সে সময় যুধিষ্ঠির মনে মনে দুর্গার স্তুতি করছেন। ওই স্তুতিতে বলা হচ্ছে, দুর্গাদেবী যশোদাগর্ভসম্ভূতা ও নন্দগোপকূল-জাতা। তিনি কংসকর্ত্তৃক শিলাতলে বিনিক্ষিপ্তা হয়ে আকাশে অন্তর্হিতা (বিরাট পর্ব, ষষ্ঠ অধ্যায়)। মহালয় বা পরমাত্মা বড় হতে লাগলেন যশোদার কোলে। অভিধান অনুযায়ী, ‘মহালয়’ হল মহৎ আলয় বা আশ্রম বা তীর্থ। মহালয়কে পরমাত্মাও বলা হয়।
তাহলে সেই পুরনো জায়গায় ফেরত যেতে হয়। যদি দুর্গার উৎপত্তি, মহাভারত অনুযায়ী মেনে নিতে নিতে হয়, তবে রামচন্দ্র রামায়ণে অকালবোধন করলেন কার?
মহালয়া আসলে পিতৃপুরুষের উৎসবের আলয়। অভিধানকারের এই উক্তি শিরোধার্য।
Comments are closed.