স্বপ্ন এবং কঠোর পরিশ্রম একজনকে শূন্য থেকে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। দিল্লির ব্যবসায়ী মলয় দেবনাথের উত্থানের গল্প যেন তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মায়ের দেওয়া মাত্র ১০০ টাকা সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিল্লিতে পাড়ি দিয়েছিলেন ১৯ বছরের মলয় দেবনাথ। আর আজ তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাজার মূল্য আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা।
১৯৮৮ সাল। উচ্চ্ মাধ্যমিক পাশ করে মায়ের দেওয়া ১০০ টাকা সম্বল করে দেশের রাজধানীতে এসে পৌঁছন এক ১৯ বছর যুবক। পরবর্তী কালে নিজের দীর্ঘ এই যাত্রা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, দিল্লিতে টিকে থাকা মোটেও সহজ ছিল না। আমাদের গ্রামের অনেককেই দেখেছি কিছু দিন থেকে ফায়ার যেতে। কিন্তু আমি নিজেকে বলতাম, পরিস্থিতি যাই আসুক। আমায় কঠিন পরিশ্রম করে যেতে হবে। এই একটা জিনিসই আমায় সাফল্য এনে দিতে পারে। আমাকে আমার পরিবারের পাশেও থাকতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শহরে তাঁর সম্পত্তি রয়েছে। কয়েকটি চা বাগানেরও মালিক তিনি। এছাড়াও তাঁর রয়েছে ক্যাটারিং বিজসেন, এবং ৬ টি দূরপাল্লার ট্রেনে সমস্ত খাওয়ার পরিবেশন করে তাঁর সংস্থা।
১৯৩৫ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে কোচবিহারে চলে আসেন মলয় দেবনাথের পরিবার। কোচবিহারের তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। সেই সঙ্গে বেশ কিছু জমিরও মালিক ছিলেন তাঁরা। গ্রামে স্কুল তৈরিতে তাঁর দাদু সে সময় জমি দান করেছিলেন। সব মিলিয়ে শুরুর দিকে তাঁর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বচ্ছল ছিল। এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, মলয় দেবনাথের যখন বয়েস ৬ বছর। সে সময় কোচবিহারে রাজনৈতিক অশান্তি শুরু হয়। আর সেই গন্ডগোলের মধ্যেই তাঁদের পারিবারিক কারখানাটায় কেউ বা করা আগুন লাগিয়ে দেয়। ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই একটা ঘটনাই গোটা পরিবারকে চরম সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। পুনরায় তাঁরা ব্যবসা শুরু করলেও সেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ আর ফিরে আসে না।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মলয় দেবনাথ তাঁর পরিবারের চায়ের দোকানে কাজ করতেন। দুটো ছোট ভাই এবং এক বোনকে নিয়ে তীব্র আর্থিক কষ্টের কারণে উচ্চ্ মাধ্যমিক পাশ করেই মায়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে দিল্লি পাড়ি দেন তিনি।
দিল্লিতে শুরুতে একটি ক্যাটারারের কাছে কাজ করতে শুরু করেন। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সে সময় আমার কাজের যে সময়, তার থেকেও অতিরিক্ত সময় কাজ করতাম। বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে টেবিল মোছা। কখনও কাজ নিয়ে অভিযোগ করিনি। আমার কাজে খুশি হয়ে এক বছরের মধ্যে আমার বেতন ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন তখনকার মালিক। কখনও কখনও আমি দিনে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতাম। যা বেতন পেতাম পুরোটাই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম। ওভার টাইমের টাকাটা রাখতাম নিজের খাওয়া থাকার খরচের জন্য।
এসবের ফাঁকেই একটি হোটেল ম্যানেজম্যান্টের কোর্সও করেন তিনি। তার পর এক হোটেল ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই একটি চাকরিই তাঁর জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটি বড় বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ করতো। খাওয়ার দেওয়া থেকে শুরু করে একটি বড় অনুষ্ঠানে কী কী কাজ করতে হয় তা কার্যত সে সময়ে হাতে কলমে শিখেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে এই ধরণের বড় বড় অনুষ্ঠানে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় করার সুযোগ পাচ্ছিলেন। এঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন ভারতীয় সেনায় কর্মরত কর্নেল বাগচী। যিনি পরে সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হন। এই কর্নেল বাগচীই মলয় দেবনাথকে নিজের ক্যাটারিং বিজনেস শুরু করতে উৎসাহ দেন। এবং কর্নেলর সাহায্যেই সেনাবাহিনীর মেসের জন্য ক্যাটারিংয়ের দায়িত্বে পায় তাঁর সংস্থা। এর পাশাপাশি সেনা বাহিনীর একাধিক উচ্চ পদস্থ আধিকারিকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও অর্ডার পেতে শুরু করে তাঁর সংস্থা।
এরপর থেকে গল্প শুধুই সাফল্যের। বর্তমানে দেবনাথ ক্যাটারার্স এবং ডক্টরেটর্স ৩৫ টি আর্মি মেসে খাওয়ার পরিবেশনের দায়িত্ব আছে। এছাড়াও উত্তরবঙ্গে চা বাগান রয়েছে তাঁর। তবে সাফল্যেই এই শিখরে ছুঁয়েও এখনও সাধারণ জীবন যাপনই করেন মলয় দেবনাথ। যদিও তাঁর এই দীর্ঘ যাত্রা অনেকেই অনুপ্রাণিত করে।
Comments are closed.