১৯৮৯ সালে জ্যোতিবাবু বাংলায় নির্বাচনকে কেন্দ্র বিরোধী জাতীয় চেহারা দিয়েছিলেন, আজ রাজ্যে মমতাও ঠিক সেটাই করছেন
ভোটটা তো লোকসভার। তাহলে অনেক আঞ্চলিক ইস্যু এবার এত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে কেন? হয়ে ওঠার কারণ একটাই, জাতীয় ইস্যুগুলি আর টেনে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় বিষয় বলতে ওঠে কাশ্মীর সমস্যা বা রাফাল। কিংবা নোটবন্দি অথবা জিএসটি। সবগুলোই বহুচর্চিত বিষয়। মূলত গত পাঁচ বছরে মোদী সরকারের রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুতির বিষয়। কাশ্মীর সমস্যা আর বায়ুসেনার দাপট এক জিনিস নয়। যেভাবে নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীর সমস্যাকে পরিচালনা করতে চেয়েছেন, সেটা হল অতি রাষ্ট্রবাদ। সামরিক শক্তি দিয়ে কাবু করতে চেয়েছেন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে। পেলেট গান দিয়ে অন্ধ করলেই যাঁরা পাথর ছুঁড়ছিলেন তাঁদের মন থেকে ক্রোধকে দূর করা যায় না। তার জন্য এক অন্য শুশ্রূষাও প্রয়োজন। দরকার রাজনৈতিকভাবে সমস্যার মোকাবিলা করা। কিন্তু আমাদের কথা মানতে হবে বলা ছাড়া বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য কোনও উচ্চারণ নেই।
রাম মন্দির বহু পুরনো ইস্যু। বস্তুত তা সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির এক আদি বিষয়। তা নিয়ে আর জলঘোলা করার কী আছে? কিন্তু সেটা তো তালিকায় রাখতেই হবে, নয়ত জাত থাকবে না। তাই রাখা আর কী। মোদী তাঁর বিভিন্ন রাজ্য সফরে গিয়ে সেই রাজ্যের বিষয় নিয়ে দু’চার কথা বলেন। আমরা আশা করতেই পারি, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই আমাদের রাজ্যে এসেও আমাদের ব্যাপারে কিছু বলবেন। রাজ্যের মানুষ জানতে পারবেন কীভাবে এরাজ্যে বিজেপি সফল হলে আমরা নতুন কিছু পাব। এযাবত মোদী যে কটা সভা করলেন তা শুধুই নিজের ঢাক পেটানো আর রাজ্য সরকারের মামুলি সমালোচনা। এই সমালোচনাগুলি তো সবাই করে থাকেন। বামেরা দীর্ঘদিন ধরেই এই লাইনে চলছেন। সারদা-নারদা নিয়ে অনেক হল। বেশ কয়েকজন তো জেল-টেল খাটলেন। তদন্তও চলছে। কোনও দিন শেষ হওয়ার নয়। সাধারণ মানুষের কাছে ওই ইস্যুগুলি আর তেমন উত্তেজক নয়। এহ বাহ্য।
এরাজ্যের তৃণমূল বিরোধী জনতা বিরোধী রাজনীতির কাণ্ডারিদের কাছে শুনতে চান নতুন কিছু। মমতা বিরোধিতার ধারাপাত একরকম হয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে রাজ্য সরকারের একই রকম বিরোধিতা করছেন। অবশ্যই তার কিছু রকমফের আছে। অধীর চৌধুরী মহাশয় বা জনাব মহম্মদ সেলিম যে ভাষাটা ব্যবহার করতে জানেন, তাই করছেন। তার সঙ্গে এরাজ্যের তৃণমূল বিরোধী জনতা অনেক দিন ধরে পরিচিত। শুধু তাই নয়, অধীরবাবু বা সেলিম সাহেব গত পাঁচ বছর ধরেই পার্লামেন্ট এক নাগাড়ে প্রশ্নগুলি তুলে রাজ্য সরকারকে বিদ্ধ করেছেন। এই বিষয়ে তাঁদের একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, যা অন্য কারুর নেই। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও তাঁরা নিরলসভাবে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের ভুলগুলিকে গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এরাজ্যের তৃনমূল বিরোধী জনতা তাঁদের কথা শুনতে চায়।
কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণে প্রধান বিরোধী হয়ে ওঠা বিজেপির নেতারা কী বলছেন? এমনকী নরেন্দ্র মোদী? সেই বায়ু সেনার কৃতিত্বকে নিয়ে জলঘোলা করা ছাড়া অন্য কোনও নতুন বিষয় নেই। এরাজ্যের মানুষ তো জানতে চাইতেই পারেন, যদি এখানে বিজেপি খুব শক্তিশালী হয় তবে তৃণমূলকে টাইট দেওয়া ছাড়া আর কী কী হবে। কীভাবে বেকারদের হাতে কাজের সুযোগ বাড়বে, অথবা শিল্প আসবে। কীভাবেই বা গোর্খাল্যান্ড সমস্যার স্থায়ী সমাধান সুত্র বেরোবে। বক্তব্যে শুধু তীব্রতা থাকলেই তো চলবে না, প্রয়োজন বিষয়ের গভীরতা। দরকার নতুন বিষয় তুলে ধরে জনচিত্তকে প্রভাবিত করা। রাফাল নিয়ে আজকের সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যের পর মোদী কীভাবে তার মোকাবিলা করেন, জনসাধারণের সেদিকেও নজর থাকবে।
১৯৮৯ সালে যখন বামফ্রন্ট সরকারের বয়স বারো বছর, জ্যোতিবাবুর কাছে ডাক এসেছিল সর্বভারতীয় স্তর থেকে। জ্যোতিবাবু, অটলবিহারী বাজপেয়ী, ভি পি সিংহ তখন একত্রে যে সভা করেছিলেন, তাতে মতাদর্শগত কিছু বিভাজন থাকলেও কংগ্রেস বিরোধী জনতার কাছে ওই ঐক্য গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। মানুষ সর্বদাই একটি ভরসার জায়গা খুঁজে পেতে চায়। আপনি যখনই এককণ্ঠ হয়ে যাবেন, বুঝতে হবে আপনার ভরসার জায়গাটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানুষের সামনে যৌথ চিন্তা যত কার্যকরী হতে পারে, শুধু নিজের ঢাক পেটানো ততটা নয়। বলতে হবে নতুন আশার কথাও। মানুষের চিন্তাকে ঘুরিয়ে দিতে হবে পুরনো বিষয়গুলি থেকে। এটা জ্যোতিবাবু পেরেছিলেন ১৯৮৯ এ। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক রাজনীতি নয়। সর্বভারতীয় স্তরে ছাপ রাখার অভিপ্রায়টি এরাজ্যের সাধারণ মানুষ অনুভব করতে পেরেছিলেন। বিশ্বাস করেছিলেন যে, জ্যোতিবাবু পারবেন রাজীব গান্ধীর সরকারকে উৎখাত করতে। পেরেছিলেনও।
এবছরের সংসদীয় নির্বাচনের আগে যে মোদী বিরোধী প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা কংগ্রেস নেয়নি। নতুন বিষয় তুলে আনেনি। নতুন স্বপ্নও মানুষকে দেখায়নি। শুধু নেতিবাচক প্রচার দিয়ে হয় না। ইতিবাচক কর্মসূচি লাগে। ১৯ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে মোদী বিরোধী যে সমাবেশ হয়েছিল তা অবশ্যই আশাবাদী। এর সাথে অন্তত সময়ের প্রয়োজনে এদেশের বামপন্থীরা যদি যুক্ত হতেন কিছুটা, তবে বড়ই ভাল হত। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই তো আছেই। তার জন্য সোচ্চার হওয়ার ক্ষেত্রগুলি সঙ্কুচিত নয় মোটেই। বামেদের ব্রিগেড যথেষ্ট আশাবাদী। কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নতুন দাবি তোলারও অবকাশ থাকা উচিত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন সর্বভারতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পরিচয়ের গণ্ডিও অনেক বৃহৎ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মুহূর্তে এরাজ্যের বাম বা বিজেপিতে এমন কোনও নেতা নেই, যাঁকে সামগ্রিকভাবে দেশের সমস্ত দলের নেতারা চেনেন। এই দুর্বলতার জন্য অবাঙালি নেতাদের উপর নির্ভর করতে হয়। মমতা এই জায়গাতেই অনেকটা এগিয়ে আছেন। তাছাড়া দল তাঁর নিজের বক্তব্যের বাইরে যাবে না। এটাও একটা সুবিধা। তাই অতি সহজেই মমতা এই নির্বাচনকে সর্বভারতীয় রূপ দিতে পারছেন। এমন অনেক ইস্যু তুলে ধরছেন, যা নতুন এবং সরাসরি কেন্দ্রীয় অবস্থানকে চিনিয়ে দিচ্ছে। মানুষের কাছে ক্রমশই তুলে ধরছেন সারা দেশের বিষয়গুলি। যেমন, কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে অবস্থান। তার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন। এরাজ্যের তৃণমূল সমর্থকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে যে, কেন্দ্রে সরকার হলে এই বিষয়গুলি গুরুত্ব পাবে। এটাই মমতার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ, যা শুধু দিদি-মোদী গটআপ হয়েছে বলে প্রচার করলে মানুষ নাও শুনতে পারেন। রাজনীতি হল সাপ লুডোর খেলা, উত্থান পতন আছেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.