#মিটুঃ আনন্দবাজার পত্রিকার চিফ রিপোর্টার দেবদূত ঘোষঠাকুর দিনের পর দিন আমায় যৌন হেনস্থা করেছেন, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ! উলটে আমাকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়
বাংলার সব থেকে প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় আমি ২০০৬ সালের মাঝ ফেব্রুয়ারিতে যোগ দিই। সে সময় আমি নিউজ ডেস্কে ছিলাম। পরে সেই বছরেরই ১ এপ্রিল থেকে আমি কাজ শুরু করি রিপোর্টিং বিভাগে। কাজ শুরুর প্রথম থেকেই চিফ রিপোর্টার দেবদূত ঘোষঠাকুর ছিলেন আমার বস।
সেই সময় আরও অনেক অল্প বয়সী মহিলাই আনন্দবাজারে যোগ দিয়েছিলেন, সবার বয়স ছিল ২২-২৩ বছরের মধ্যে। এই পেশায় দেবদূত ঘোষঠাকুর তখন অনেক দিন ধরে ছিলেন। শুরু থেকেই তিনি আমার কাঁধে পিঠে হাত দিতেন, অফিসের অন্যান্য মহিলাদের সাথেও তাঁর আচরণ ছিল একই রকম। তিনি আমাদের পোশা নিয়েও নানা ধরনের মন্তব্য করতেন, বিশেষত কোন পোশাকের কাট অ্যান্ড ডেপথ কেমন, সে সবের দিকে তাঁর বিশেষ নজর থাকতো। নানা অছিলায় মেয়েদের কাঁধে হাত রাখতেন, যাতে তাঁদের অন্তর্বাস ছুঁতে পারেন।
এবং বিভাগের সব মহিলার সঙ্গেই তিনি এমন ভাষায় কথা বলতেন, ‘তোর পিছনটা বড় হয়ে যাচ্ছে’, ‘কী অশ্লীল জামা পরেছিস, ইত্যাদি।’ মহিলা সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে মোটামুটি এরকম ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্থ ছিলেন তিনি। আমি অবাক হতাম এসব দেখে, আর ভাবতাম, ‘এসব কি যৌন হেনস্থা নয়?’ পাশাপাশি গান, হাসি ঠাট্টার জন্য অফিসে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতা কম ও সকলেই প্রায় নতুন ছিলাম, তাই একটি সংবাদপত্রের অফিসে কীভাবে কাজ হয় তা জানতাম না। কিন্তু কর্মক্ষেত্রেই পরিবেশ কি এমনটা হওয়া কাম্য?
এরপর আরও ঘটনা ঘটতে থাকল। আমার বিয়ের পর, যদি উনি আমায় কখনও অফিসে হাই তুলতে দেখতেন, বলতেন, ‘কেন তুই হাই তুলছিস? ওহ! নিশ্চই কাল সারা রাত জেগে ওই সব করছিলি?’ অন্যান্য নারী-পুরুষ সহকর্মীদের সাথেও উনি এই একই ভাষাতেই কথা বলতেন। অশ্রাব্য ভাষায় অশ্লীল জোকস বলতেও উনি দক্ষ ছিলেন। বলতেন, কর্মচারী হিসাবে মহিলারা ভালো না, কারণ তাঁরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নেয় এবং বিয়ের পরেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে।
আমার কর্মরত অবস্থাতেই বারাসাতে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল। দিদির শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হতে হয়েছিল এক যুবককে। সেই সন্ধ্যেতেই আমি অফিসের পুরুষ রিপোর্টারদের এই আলোচনা করতে শুনি যে, ‘এটা খুবই স্বাভাবিক। ছেলেরা, মেয়েদের ছোঁবে, তাদের শরীরের উষ্ণতা নেবে, ইত্যাদি।’ একদিন সন্ধ্যেবেলায় আমি আর দেবদূত ঘোষঠাকুর বাড়ি ফেরার জন্য অফিস থেকে দেওয়া একই গাড়িতে উঠি। আমরা দুজনেই দক্ষিণ কলকাতার দিকে থাকতাম। সেদিন আমি গাড়িতে উঠে বসতে যাওয়ার সময় ওনি আমার পিছনে চিমটি কাটেন। গোটা ঘটনায় আমি কার্যত বাকরুদ্ধ ও হকচকিয়ে যাই। আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার সিদ্ধান্ত নিই।
পরদিন সকালেই আমি গোটা বিষয়টা তাঁর বস এবং তৎকালীন নিউজ এডিটরকে জানাই। বিষয়টি শোনার পরই, তিনি প্রথমে জোরে হেসে ওঠেন। আমি যখন তাঁকে প্রশ্ন করি, তিনি কেন হাসছেন! তখন তিনি হাসি থামিয়ে জানান, তিনি বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থাই তার পরে নেওয়া হয়নি।
এরপর একদিন সকালে একটি স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার অ্যাসাইনমেন্ট কভার করার জন্য আমায় সকাল সকাল অফিস যেতে হয়। সে সময় কোনও মহিলা কর্মীকে সকালে অফিসে যেতে হলে, তিনি আতঙ্কে থাকতেন, ঘোষ ঠাকুর কী বলবেন, কী করবেন তা নিয়ে। দেবদূত ঘোষঠাকুর সকাল ১০.৩০ টার মধ্যে অফিসে চলে যেতেন। ওই দিন আমি যখন অ্যাসাইনমেন্টে বেরনোর জন্য গাড়ির রিক্যুইজিশন স্লিপে সই করছি, সে সময় তিনি এসে আমায় পিছন থেকে জাপটে ধরেন। পুরো ঘটনায় আমি চমকে যাই। আমি চিৎকার করে ওনাকে বলি, এরকম ব্যবহার কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। উনি প্রথমে হাসেন, তারপর বলেন উনি মজা করছিলেন। অফিসে কাজের এহেন পরিবেশ নিয়ে কেউ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আমিও ভাবছিলাম, আমায় এখানে মানিয়ে নিতে হবে, কারণ আমি সত্যি আমার কাজ এনজয় করছিলাম। তাই আমি বিশেষ কিছু করতে পারছিলাম না। মাস গেলে ওই টাকাগুলোরও আমার প্রয়োজন ছিল। তাই চাকরিটা ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অভিযোগ জানানোর পরেও যদি অভিযুক্তের বিরদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় কর্তৃপক্ষ, তবে আমি আর কী করতে পারতাম?
এরপর ২০১৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন, আমি সকাল ৯ টা থেকেই অফিসে ছিলাম। দুপুর সাড়ে ১২ টা নাগাদ আমি বিরতি নিয়ে কিছু খাবার কথা ভাবছি, সে সময় ঘোষঠাকুর আবার পিছন থেকে এসে আমার পেছনে জোরে থাপ্পড় মারেন। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, আমি চিৎকার করে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সে সময় অফিসে বেশি লোক ছিলেন না, কিন্তু যাঁরা ছিলেন তাঁরাও এই ঘটনার কোনও প্রতিবাদ করেননি। আমি নিউজ এডিটরকে বিষয়টা জানাই। উনি আমায় বিষয়টা বিভাগের সিনিয়র এক সাংবাদিককে জানাতে বলেন। ওই সিনিয়ার সাংবাদিককে বিষয়টি জানানোর পর, উনি ক্ষোভের সঙ্গে আমার কাছে পালটা জানতে চান, দেবদূত শুধু তোমার সাথেই এরকম করে কেন?
এরপর আমি এইচ আর বিভাগের আধিকারিক শিউলি বিশ্বাসকে বিষয়টা জানাই। তিনি সব শুনে বলেন, তিনি আগেও দেবদূত ঘোষঠাকুরের বিষয়ে এরকম কথা শুনেছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই উনি আমায় ডেকে পাঠিয়ে বলেন, এবিপি গ্রুপের ট্যাবলয়েড এবেলাতে আমাকে ট্রান্সফার করা হয়েছে। এই ঘটনায় আমি চমকে গিয়েছিলাম। আমি এবেলার হয়ে কাজ করতে চাই না, শিউলি বিশ্বাসকে তা পরিষ্কার জানাই। এবেলা এবিপি গ্রুপের প্রধান সংবাদপত্র না। আনন্দবাজারে কাজ করা আর এবেলায় কাজ করা দুটো আমার কাছে এক বিষয় ছিল না। আমি শিউলি বিশ্বাসকে জানাই, এটা তো আমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এবেলা বা টেলিগ্রাফে আমাকে পাঠানো শাস্তি দেওয়ারই সমান ছিল। কিন্তু তিনি আমার কোনও কথাই শুনতে চাননি। বলেন, আনন্দবাজারের প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের নির্দেশেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাকে তিন দিন ছুটি নিয়ে তারপর এবেলায় যোগ দিতে বলা হয়।
এতে আমি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। আনন্দবাজারে আমার কাজ নিয়ে আমি খুশি ছিলাম। নতুন নতুন স্টোরি, চ্যালেঞ্জিং সব অ্যাসাইনমেন্ট করছিলাম। কিন্তু শুধু মাত্র যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনায় আমাকে অন্যত্র ট্রান্সফার করে দেওয়া হল। এটা কী ধরনের বিচার? অভিযোগ জানানোর পর শিউলি বিশ্বাস বা অভীক সরকার কেউ আমায় ডেকে বিষয়টা জানতে চাইলেন না। এরপর এক মাসের মধ্যে আমি এবিপি ছেড়ে ‘এই সময়’ পত্রিকায় যোগ দিই।
কিন্তু আমি অফিস ছাড়ার পর দেবদূত ঘোষঠাকুর কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এবিপি’তে চিফ রিপোর্টার হিসাবেই কর্মরত ছিলেন। পরে তাঁর এক্সটেশনও হয়।
(দ্য বেঙ্গল স্টোরির পক্ষ থেকে দেবদূত ঘোষঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে, বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দেন। শিউলি বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে তিনি বলেন, ‘যে ঘটনা পরম্পরায় আপনি অভিযোগের কথা বলছেন তা আমি মনে করতে পারছি না।’ তাছাড়া তিনি যে আর এইচ আর বিভাগের সঙ্গে যুক্ত নন তাও জানান শিউলি বিশ্বাস। তবে বলেন, অভিযোগ করা হয়ে থাকলে তা অফিসের ইন্টারনাল রিপোর্টে থাকতে পারে। বর্তমান এইচ আর প্রধান সুমন ব্যানার্জির সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তাঁকে ই-মেলও করা হয়, তাঁর বক্তব্য জানার জন্য। তিনি ই-মেলের জবাব দিলেই তাঁর বক্তব্য আমরা প্রকাশ করব।)
Comments are closed.