মুকুল রায় দৌড়চ্ছেন। আজ থেকে না, বহু বছর ধরেই।
সেই ন’য়ের দশকের শেষ। তৈরি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। জেলায় জেলায় সংগঠন গড়ে তোলা। ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট, লোকসভা ভোট। পরের বছর আবার লোকসভা। তারপর ২০০১ সালের বিধানসভা। লাগাতার ভোট, লাগাতার দৌড় মুকুল রায়ের। কাঁচড়াপাড়া থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে ক্যানিং। ক্যানিং থেকে আজ তালডাংড়া তো কাল বালুরঘাট।
দৌড় কিছুদিনের জন্য থামল ২০০১ বিধানসভা ভোটের পর। আবার ২০০৪ লোকসভা ভোটের আগে দৌড়ঝাঁপ বেড়েছিল, কিন্তু ফল বেরনোর পর, তা কিছুদিনে জন্য ফের বন্ধ।
২০০৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভা থেকে সাংসদ মুকুল রায়। সামনেই বিধানসভা ভোট। এবার মুকুল এক্কেবারে ম্যারাথন রানার। দিল্লি থেকে শিলিগুড়ি হয়ে সকালে নিজাম প্যালেস তো বিকেলে ভাঙড়। বিধানসভা ভোটে ৩০টা সিট, কিন্তু দৌড় থামেনি। কখনও সিঙ্গুর, কখনও নন্দীগ্রাম, কখনও ঝাড়গ্রাম। কাঁচড়াপাড়া, বীজপুরেই মুকুল তখন বহিরাগত।
মুকুল রায় দৌড়চ্ছেন। আজ থেকে না, বহু বছর ধরেই।
বাংলার রাজনীতিতে প্রায় বিশ বছর ধরে মাঠে-ময়দানে, পাহাড়ে, দিল্লিতে, ঝাড়গ্রামে, নন্দীগ্রামে টানা দৌড়ে ক্লান্ত না হওয়া মুকুল রায় শেষমেশ ম্যারাথন থামালেন, ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে এসে।
৩০ নভেম্বর, ২০১৪। ধর্মতলায় অমিত শাহর সমাবেশে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা বললেন, ‘ভাগ মুকুল ভাগ’।
কী যে হল! থেমে গেলেন মুকুল রায়। ক্লান্তিহীন দৌড়ে অভ্যস্ত মুকুল রায়ের প্যাশন ক্রিকেট। ঘরে বসে আলোচনায় বারবার টেনে আনেন ক্রিকেট প্রসঙ্গ। তো সেই ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ শোনার পরই দৌড় বন্ধ করে মুকুল রায় ফিরে গেলেন তাঁর কম বয়সের ভালবাসা ক্রিকেটে। তখন তাঁর মুখে শুধু একটাই কথা। ‘ধৈর্য ধরে ক্রিজে পড়ে থাকলে রান আসবে’।
২৯ জানুয়ারি, ২০১৫। পরদিন মানে, ৩০ তারিখ, সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে হাজিরা। সারদা কেস। সেদিন সন্ধ্যায় নিজাম প্যালেসে বসে মুকুল রায় বললেন, ‘সিবিআই যাঁকে-তাঁকে ডাকতেই পারে। তদন্তে সবারই সহযোগিতা করা উচিত। আমি চাই না আমার সিবিআই অফিসে যাওয়া নিয়ে কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটুক’।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে স্পষ্ট বার্তা, তাঁর হাজিরা নিয়ে কেউ যেন সিবিআই দফতরে বিক্ষোভ-টিক্ষোভ না দেখায়। তখনও মুকুল রায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
৩০ জানুয়ারি সিজিও কমপ্লেসে সিবিআইয়ের জেরা থেকে বেরিয়ে মুকুল রায়ের দৌড় অবশ্য পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেল। তখন মুকুল রায় অধিকাংশ সময়ই দিল্লিতে। রাজ্যসভার সাংসদ, তাই নানান কমিটির মিটিং নিয়ে ব্যস্ত।
৩০ জানুয়ারি সিবিআই জেরার কয়েকদিন বাদেই হল বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচন। দৌড় বন্ধ মুকুল রায়ের। এই বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই মুকুলের হোম গ্রাউন্ড কল্যানী বিধানসভা। তাও মাঠে নামলেন না তিনি।
এরপর সে বছরের মাঝামাঝি থেকেই রাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেসের জোটের সলতে পাকানো শুরু হল। দৌড় বন্ধ মুকুল রায়ের।
দৌড়ের কথা ভাবলেই মুকুলের তখন শুধু মনে পড়ে যায়, ৩০ নভেম্বর ধর্মতলার সমাবেশ থেকে বিজেপি নেতাদের সেই সতর্কবার্তা, যা আসলে তাঁর কাছে হুঁশিয়ারি, ‘ভাগ মুকুল ভাগ’।
আর এই সতর্কবার্তাতেই কিনা কে জানে, ২০১৬ বিধানসভা ভোটেও বেশি দৌড়ঝাঁপ করা হল না মুকুল রায়ের। শেষমেশ চাকা ঘুরল ২০১৭ সালে এসে। সেই ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকেই যে জল্পনা শুরু হয়েছিল মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠমহলে, তাই সত্যি হল। বিজেপিতেই যোগ দিলেন মুকুল।
এ’রাজ্যে না, দিল্লিতে। আবার একটা দৌড়ের প্রস্তুতি। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত, ২০১৯ সালে লোকসভা, আর ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট।
পরপর এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, অলিম্পিকস।
বছরের পর বছর রাজ্যজুড়ে দৌড়ে বাড়ানো মুকুল রায় আবার স্টার্টিং লাইনে। গোটা রাজ্য হাতের তালুর মতো চেনা, বুথে বুথে চেনা মুখ। সঙ্গে আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষী। আর সবচেয়ে বড় কথা, গায়ে দেশের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের জার্সি।
দৌড় সেভাবে শুরু হতে না হতেই পরপর সবং, নোয়াপাড়া বিধানসভা এবং উলুবেড়িয়া লোকসভা ভোট। কিন্তু তিনি মুকুল রায়। রাজ্যজুড়ে দৌড়ানো নেতা। অপেক্ষা করছেন পঞ্চায়েত ভোটের জন্য। আর ঘনিষ্ঠমহলে বলছেন, ‘দিকে দিকে তৃণমূলে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। এই সুবিধেটা সুদে-আসলে তুলতে হবে’।
স্পিড বাড়াচ্ছেন মুকুল, হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাত। দিল্লি থেকে গ্রেফতার শ্যালক সৃজন রায়। আর্থিক প্রতারণার মামলা। একই কেসে অভিযুক্ত তিনি নিজেও। পঞ্চায়েতের ময়দান ছেড়ে মুকুল রায় সোজা কলকাতা হাইকোর্টে।
এবার তৃণমূল নেতারা হুঙ্কার ছাড়ছেন, ‘মুকুল রায় অ্যারেস্ট হবে, আজ না হয় কাল।’
মুকুল রায়ের কানে কি আবার বাজছে, ‘ভাগ মুকুল ভাগ’? কী করবেন মুকুল রায় এবার? দৌড় চলবে, না থামবে? গ্যালারি ভর্তি লোক দেখার অপেক্ষায়। সামনে এশিয়ান গেমস, তারপর কমনওয়েলথ। আর শেষে অলিম্পিকস!