চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরতের নাম থেকে যে দেশের নাম ‘ভারত’ তা এখনও আন্তর্জাতিক মহলে ‘ইন্ডিয়া’ বলেই পরিচিত। বলা বাহুল্য, এই রাষ্ট্র গত পাঁচ বছরে কন্ডাক্টরের মর্জি মেনে শুধু পিছন দিকেই এগিয়ে গিয়েছে। সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া বর্তমান শাসকের ধাতে নেই। ২০১৯-এ লোকসভার ভোট যেহেতু সামনে, তাই পিছিয়ে পড়ার গতি বেড়েই চলেছে ক্রমশ।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে রাজ করেন আদিত্যনাথ যোগী। তিনি সেই রাজ্যের একটি ঐতিহাসিক শহর ইলাহাবাদের নাম পালটে রেখেছেন প্রয়াগরাজ। কেন? ‘ইলাহ’ হল আরবি শব্দ, তার মানে উপাস্য—ফলে এমন নাম হিন্দুস্তানের ঐতিহ্যের পরিপন্থী। গোরখনাথ মঠের নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী আদিত্যনাথ যোগী নিশ্চয় জানেন, পৌরাণিকরা সম্ভব ও ঐতিহ্য নামের দুটি অতিরিক্ত প্রমাণ মানেন। সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী, মনু ও শতরূপার কন্যা ইলা (তাঁর পুরুষ নাম ‘ইল’ এবং তিনি লিঙ্গ পরিবর্তন করতেন), মতান্তরে, কর্দমপ্রজাপতির পুত্র ইল মহাদেব ও উমার ইচ্ছেয় নর ও নারীরূপে বিরাজ করতেন। পুরুষ ইলের পুত্র শশবিন্দু আর স্ত্রী ইলার বিবাহ হয় চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে। বুধ ও ইলার পুত্র হলেন পুরূরবা। চন্দ্রবংশীয় রাজা পুরূরবা হলেন পৌরব ও যাদবদের আদিপিতা। তিনি যে স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন, তাঁর নামকরণ করেন নিজের মা ইলার নামে—ইলাবাস। পরে সেটি লোকমুখে ইলাহবাস ও ইলাহবাদে পর্যবসিত হয়। যোগী আদিত্যনাথের নামবদলের কোপে পড়ে পুরাণের সেই উপাখ্যান খসে পড়ল শহরের গা থেকে।
শোনা যাচ্ছে, অবধের প্রথম নবাব প্রথম সাদাত আলি খান বাহাদুরের রাজধানী ফৈজাবাদের নতুন নাম হবে অযোধ্যা। নদীর দুই পাশে দুই যমজ শহরের নাম অযোধ্যা ও ফৈজাবাদ এখন একটি নামেই পরিচিত হবে। যোগী যদি পিছু হাঁটেন, তাহলে তিনি সংস্কৃত গ্রন্থে দেখতে পাবেন, অযোধ্যার পবিত্র পূর্বনাম ‘সাকেত’ যার অর্থ স্বর্গ। ১৯৯৬ সালে মুম্বাদেবীর নাম অনুযায়ী বোম্বাই শহরের নাম হয় ‘মুম্বাই। কয়েক দিন আগে মুঘলসরাই স্টেশনের নাম কেটে লেখা হল দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন। কানে আসছে, গুজরাতের আহমেদাবাদ হতে চলেছে কর্ণাবতী। একাদশ শতাব্দীতে চালুক্য রাজা কর্ণ ‘আশাপল্লী’ আক্রমণ করে তার দখল নেন এবং আশাপল্লীর নতুন নাম দেন কর্ণাবতী। ১৪১১ সালে আহমেদ শাহ এই শহর সাজিয়ে তুলে নাম দিয়েছিলেন ‘আহমেদাবাদ’। পিছু যদি হাঁটতে হয়, তাহলে কর্ণাবতী কেন, কেন আশাপল্লী নয়? নাকি পরের শাসকের জন্য রেখে দেওয়া হচ্ছে নতুন নাম বদলের সুযোগ। যে দেশের একটা বড় অংশ মানুষ খেতে পান না, রাস্তায় ঘুমোন, যত্রতত্র মলত্যাগ করতে বাধ্য হন—সেই দেশের উন্নতি করার চেয়ে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে এমন নাম বদলের আশ্রয় নেওয়া সুবিধাজনক। এর মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ঘৃণা উৎপাদন করে ভোট আদায় করা সহজ।
উত্তর ভারতের ঢেউ আছড়ে পড়ছে দক্ষিণে। তেলেঙ্গানার বিজেপি নেতারা বলছেন, হায়দরাবাদ কেটে হবে ভাগ্যনগর, অতএব আমাদের ভোট দিন। ষোড়শ শতাব্দীতে ভাগ্যিস কুতুবশাহী নবাবরা শহরের নাম করেছিলেন ‘হায়দরাবাদ’, নইলে বিজেপি কী বলে ভোট ভিক্ষা করতো! সেকেন্দ্রাবাদ, করিমনগরেও গিয়ে বলা হচ্ছে, নাম বদল হবে, ভোট দিন! যেন আর কোনও কাজ নেই শাসকের! ঔরঙ্গাবাদকে করা হবে শম্ভুজিনগর, ভোপাল হবে ভোজপাল, আর শিমলা শ্যামলা! ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ না ভেঙে নেতারা নাম বদলে ‘রাম জন্মভূমি’ করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত।
এ তো গেল বর্তমান শাসকদের আনুভূমিক পিছু হাঁটার কায়দাকানুন। এখানেই শেষ নয়। বিজেপির উল্লম্ব লম্ফনও বেশ ভয়ঙ্কর। সম্প্রতি স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৮৩ মিটার একটি মূর্তি ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে গুজরাতের নর্মদা জেলায় স্থাপিত করা হয়েছে। যে টাকায় অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো সমস্যা মেটানোর কথা, সেই অনুদানের অর্থে এমন মূর্তি বানিয়ে গিনেস বুকে নাম তুলে দেশ উল্লম্বভাবে কতটা লাফ দিল, তা বোঝা কঠিন নয় মোটেও। ওদিকে পেট্রোপণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া, টাকার দাম পড়ছে দ্রুত। মূর্তির আশেপাশের ৭৩টি গ্রামের লোক বলছেন, ওটা স্মারক না আমাদের কবর। ফসলের দাম নেই, চাষের জল নেই, আর এ কোন তামাশা! বিজেপির স্ট্যাচু অব ইউনিটি বানানোর পেছনে রয়েছে ইতিহাস বিকৃত করে ধর্মনিরপেক্ষ প্যাটেলকে তাঁদের হিন্দুত্বে স্থান দেওয়া! দেশের ঐতিহ্যে নইলে কীভাবে অংশ নেবে সাভারকর ও গোওয়ালকরের ভাবশিষ্যরা! মোদীর এই মূর্তি বানানোতে চেগে উঠেছেন যোগী। তিনি অযোধ্যায় এর চেয়েও বড় শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তি বানাবেন, শ্রীদশরথের নামে মেডিকেল কলেজ খুলবেন। কিন্তু যদ্দুর জানা যায়, লক্ষ্মণের জন্য বিশল্যকরণীর প্রেসক্রিপশন করেছিলেন জাম্বুবান, তাঁর নামেই বা কেন হবে না মেডিকেল কলেজ?
রাম মন্দিরের জিগির পুনরায় উঠেছে। ভোট এলেই তা ওঠে। কেননা, নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে তাঁরা এই এক কুমীরছানা দেখিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। আইন করে রামমন্দির বানিয়ে নিলেই তো ভক্তরা খুশি হতেন। কিন্তু সেটি হবার জো নেই। আবার অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, রামমন্দির হলে সেখানে নারী ও শূদ্র শম্বূকরা প্রবেশাধিকার পাবে তো? সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও শবরীমালা মন্দিরে বিজেপি ঋতুযোগ্যা নারীদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। আসলে বিজেপি বুঝে গিয়েছে, এমন নোংরা খেলা ছাড়া তারা কিছুতেই ভোট পাবে না। নোট বাতিলের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে দেখা যাচ্ছে, কী মারাত্মক ভুল ছিল ওই সিদ্ধান্ত! প্রত্যেক ভারতবাসীর জীবন নরক করে তুলেছিল ওই ডিমনিটাইজেশন। দেশটি এই ক’বছরে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে—ঠিক কর্ণাবতী, ভাগ্যনগরের সময়ের মতো। ভুল অর্থনীতির খেসারত দিতে দিতে এখন সাধারণ জনগণের রক্তজল করা ব্যাঙ্কের টাকায় থাবা বসানোর তাল ঠুকছে শাসক। জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের বাইরে। ওদিকে বাঙালি খুন হচ্ছে অসমে। হত্যা করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। খুনিরা পাচ্ছে বীরের মর্যাদা। আর সেসব করছে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্তারা। তারা কি হিন্দু দর্শনের মূল কথাই বিস্মৃত হয়েছে—জীবের মধ্যেই থাকে শিব, যারা জীবকে অত্যাচার করে তারা আবার কীসের ধার্মিক!
যে শক্তি দিয়ে দেশের মানুষকে সুন্দর জীবন দেওয়া যেত, সেই ক্ষমতা দিয়ে শাসক সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছেন, আর মাঝেমধ্যে বলছেন, হিন্দু খঁতরে মে হ্যায়! যে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব শীর্ষ পদে হিন্দুরা রয়েছেন, দেশের দণ্ডমুণ্ডকর্তারা সহিংস হিন্দুত্বের জোরে ক্ষমতায় এসেছেন, সেই দেশেও যদি হিন্দু বিপদের মধ্যে থাকে, তাহলে বলতে হবে দেশটা পিছিয়ে গেছে বহু শতাব্দী পিছনে! শহরগুলোর নতুন নামও সেই ইঙ্গিত বহন করে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.