নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১: কীভাবে থানার ওসিকে খুনের ছক কষেছিল মাওবাদীরা

রাত প্রায় ন’টা। থানায় খবর এলো, এলাকার অন্তর্গত এক আউট পোস্টে বিক্ষোভ দেখাতে এসেছেন কিছু স্থানীয় বাসিন্দা। এক’দেড়শো হবে। একদম স্থানীয় কিছু ইস্যু এবং সেই আউট পোস্টে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে নিরীহ এই বিক্ষোভের একমাত্র দাবি, থানার ওসিকে সেখানে আসতে হবে এবং বাসিন্দাদের দাবিদাওয়া শুনে তার বিহিত করতে হবে। আউট পোস্ট থেকে খবর দেওয়া হল থানায়। ওসি সব কিছু শুনলেন। আউট পোস্টের অফিসারকে বললেন, তিনি খোঁজ নিচ্ছেন ব্যাপারটা। ভাবলেন, এতো রাতে কোথায় একটা ছোট্ট বিক্ষোভ হয়েছে, দুম করে বেরিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। মিনিট কুড়ি-আধ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই আবার আউট পোস্ট থেকে ফোন। এবার আউট পোস্টের অফিসারের গলায় যথেষ্ট উদ্বেগ, ‘স্যার, এখানে উত্তেজনা বাড়ছে। লোকজনও বেড়ে গেছে অনেক। আপনি না এলে বিক্ষোভ উঠবে না বলছে। আউট পোস্ট ভাঙচুরও করতে পারে। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আপনি পাঁচ মিনিটের জন্য একবার আসলে ভালো হয়।’ এই ঘটনা ২০০৯ সালের মাঝামাঝির।

মানে কী? কী এমন ঘটল হঠাৎ যে, এই রাতে লোকজন এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল? আউট পোস্টে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন থানার ওসি। রাত প্রায় পৌনে দশটা, থানা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা দিলেন। আউট পোস্টের দূরত্ব থানা থেকে বড়জোর আধ ঘণ্টা-পয়ত্রিশ মিনিটের। মিনিট পনেরো-কুড়ি গিয়েছেন, রাস্তা চারিদিকে অন্ধকার, হঠাৎ ওসির মোবাইলে সেই জেলার পুলিশ সুপারের ফোন।
‘স্যার…’
‘তুমি কি কোথাও যাচ্ছ? থানা থেকে বেরিয়েছ?’
‘হ্যাঁ স্যার। কেন?’
‘কোথায় যাচ্ছ?’
জায়গায় নাম বললেন ওসি। ‘ওখানে আউট পোস্টে স্থানীয় লোকজন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, বলছে আমাকে যেতে হবে। ডেপুটেশন দেবে।’
‘এক্ষুনি থেমে যাও। আর যেও না। গাড়ি থামাও। গাড়ি ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে যাও ওখানেই।’
‘কেন স্যার। আউট পোস্ট থেকে বারবার ফোন আসছে।’
‘ আসুক। ওখানেই ওয়েট কর। আর এগিও না।’
এরপর ওসি যেখানে পৌঁছেছিলেন, সেখানেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন। আউট পোস্ট থেকে প্রায় চার কিলোমিটার আগে।
মিনিট পনেরো পর, রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ওসির কাছে ফোন এল আউট পোস্ট থেকে। ‘স্যার, আপনি কোথায়? অবরোধ উঠে গেছে। আপনাকে আর আসতে হবে না। লোকজন সব চলে যাচ্ছে।’
ওসি সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ উঠে যাওয়ার খবর জানালেন পুলিশ সুপারকে। এসপি তাঁকে বললেন থানায় ফিরে যেতে।
পরদিন সকালে এসপি ফোন করে নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন ওসিকে। ওসি সেখানে পৌঁছতে, তাঁকে নিজের অ্যন্টিচেম্বারে নিয়ে গেলেন এসপি। তারপর চালু করলেন টেলিফোন রেকর্ডিং।
‘সব ঠিক আছে তো? সবাই রেডি?’
‘হ্যাঁ, রেডি আছি।
‘বরকর্তা বেরোল মিস্টি নিয়ে। একটু পরেই পৌঁছে যাবে।’
‘ঠিক আছে। ‘
প্রথম কথোপকথন। তার ঠিক দু’তিন মিনিট বাদে একই জায়গা এবং নম্বর থেকে অন্য একজনকে ফোন করা হল।
‘কোনও ভুল যেন না হয়, ওসিবাবুকে আজ ছাড়া যাবে না…’
‘সব ঠিক আছে এখানে। আমরা রেডি আছি।’
আগের দিন রাত পৌনে দশটায় এই কথোপকথন হয়, ঠিক যে সময় ওসি থানা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে আউট পোস্টের দিকে রওনা দিয়েছিলেন তখন। সেই সময় রেকর্ড করা টেলিফোনের এই কথোপকথন এসপির অ্যন্টিচেম্বারে শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ওসির। তাঁর থানা এলাকায় নির্দিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে কয়েক মাস ধরেই ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছিল পুলিশ। কিন্তু তার জন্য তাঁকে যে একেবারে খুন করার টার্গেট করা হয়েছে, এতটা বুঝতে পারেননি তিনি। বুঝতে পারেননি আগের রাতে তাদের ট্র্যাপে কীভাবে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। আর দু’তিন কিলোমিটার গাড়ি নিয়ে এগোলেই রাস্তায় কার্বাইন হাতে অপেক্ষা করছিল দুষ্কৃতীরা। ৩-৪ জন।
ওসির গাড়ি ঘিরে তাঁকে গুলি করে খুন করাই ছিল উদ্দেশ্যে। তারা যখন জানতে পারে ওসির গাড়ি থেমে গিয়েছে, আর এগোচ্ছে না, তখন বুঝতে পারে কোনও গণ্ডগোল হয়ে গেছে। প্ল্যান আর কার্যকর করা যাবে না। এর পর তারা আউট পোস্ট থেকে বিক্ষোভ উঠিয়ে নেয়। কারণ ওসিকে রাতে সেখানে ডেকে পাঠিয়ে ট্র্যাপ করার জন্যই ওই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল।
এই ঘটনা মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগঢ় বা নিদেনপক্ষে এরাজ্যের লালগড়, বেলপাহাড়ির মতো মাওবাদী অধ্যুষিত কোনও এলাকার নয়। যেখানে পুলিশকে ট্র্যাপ করে খুন করার উদাহরণ রয়েছে। এই ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামের।

 

থানা নন্দীগ্রাম
আউটপোস্ট সোনাচুড়া 

ওসিকে খুনের পরিকল্পনা করেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির একটা অতি বাম অংশ, যাদের সঙ্গে সেই সময় ঘরে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বাইরে সিপিআইএমের লড়াই চলছে সর্বাত্মক। তখন এমনই এক ভয়ঙ্কর জায়গার নাম নন্দীগ্রাম, যেখানে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তো বটেই, থানার ওসির প্রাণও সরু সুতোর উপর ঝুলছে সব সময়।
কীভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার টেলিফোনের এই কথোপকথন জানতে পেরেছিলেন, তা বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া পুলিশ প্রশাসনের সমস্ত গোপন কার্যকলাপ এবং তদন্ত পদ্ধতি প্রকাশ করাও উচিত নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম কাণ্ড শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই সেখানকার বেশ কিছু সন্দেহজনক ফোনের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল রাজ্য প্রশাসন। ২০০৮ সালের শেষ দিকে লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর, নন্দীগ্রামের সন্দেহজনক কিছু ফোন নম্বরের উপর নজরদারি শুরু করেছিল দক্ষিণবঙ্গের মাওবাদী অধ্যুষিত একটা জেলার পুলিশও। যদি দুই জায়গার মধ্যে কোনও যোগসূত্র থাকে সেই কারণে। সেই জেলার পুলিশ লাইনে কয়েকজন অফিসারের ওপর দেওয়া ছিল এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এটা যেদিনের ঘটনা সেদিন ওই কন্ট্রোল রুমের অফিসাররা টেলিফোন রেকর্ডিংয়ে হঠাৎই শোনেন ‘ওসিবাবু’ শব্দটি। চমকে ওঠেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে মনযোগ দেন কথোপকথনে। বুঝতে পারেন, বরকর্তা হচ্ছে ওসির সাঙ্কেতিক নাম। মানে থানার বড়বাবু। মিষ্টি নিয়ে বেরিয়েছেন মানে, পুলিশ নিয়ে বেরিয়েছেন থানা থেকে। এরপরই ‘ওসিবাবু’ শুনে অফিসারদের সন্দেহ হয়, নন্দীগ্রামের ওসিকে টার্গেট করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল রুমের অফিসাররা বিষয়টা জানান এক সিনিয়র অফিসারকে। মুহূর্তের মধ্যে ওই সিনিয়র অফিসার তা জানিয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে। সময় নষ্ট না করে এসপি ফোন করেন নন্দীগ্রাম থানার ওসি প্রসেনজিৎ ব্যানার্জিকে। তখন ওসি প্রসেনজিৎ ব্যানার্জি গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ের কাছাকাছি। এসপির ফোন পেয়ে সেখানেই থেমে যান তিনি। সেখান থেকে বিক্ষোভস্থল সোনাচুড়া মাত্র কয়েক কিলোমিটার, যেখানে কার্বাইন হাতে অপেক্ষা করছিল মাওয়িস্টরা। বেঁচে যান সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে!

 

লেখার প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজনীয়তা 

২১ জুন ১৯৭৭, রাজ্যে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হল সিপিআইএমের নেতৃত্বে। তার আগে এরাজ্যে বামপন্থীদের দুটো স্বল্পকালীন সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। দশ বছর আগে ২ রা মার্চ ১৯৬৭,পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস বিরোধী কয়েকটা দল জোটবদ্ধ হয়ে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। ন’মাসের কম মেয়াদ ছিল সেই সরকারের। এরপর ১৯৬৯, দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। মেয়াদ ১৩ মাস।
১৯৭২ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের মোট আসন ১৪। নির্বাচনের দিন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মাত্রাছাড়া সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বিধানসভা বয়কট করে বামেরা। তারপর দেশে জরুরি অবস্থা। শুরু হল জয়প্রকাপ নারায়ণের নেতৃত্বে ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী আন্দোলন। দেশজুড়ে খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। প্রবল কংগ্রেস বিরোধী হাওয়ার মুনাফা ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এরাজ্যে পুরোমাত্রায় ঘরে তুলল বামেরা। বামফ্রন্ট পেল ২৩১ আসন, কংগ্রেস জিতল মাত্র ২০ টি আসনে। সিপিআইএম একাই ১৭৭।
১৯৬২ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ২৫২ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে সিপিআই পেয়েছিল ৫০ টি আসন। ভোট পেয়েছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। ১৯৬৪ সালে তৈরি হল সিপিআইএম। মতাদর্শগত ভাঙন কমিউনিস্ট পার্টিতে। তৈরি হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদী। সিপিআইএম। ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে সিপিআইএম পেল ৪৩ টি আসন, ১৮ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট। অন্যদিকে, সিপিআই পেল মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ ভোট। সিপিআইএম এবং সিপিআই মিলে মোট ২৫ শতাংশ ভোটই পেল, যা ঠিক পাঁচ বছর আগে সিপিআই একাই পেয়েছিল। অর্থাৎ, কমিউনিস্টদের ভোট পাঁচ বছরের ব্যবধানে একই থেকে গেল, কিন্তু রাজ্যে মূল বিরোধী শক্তি হয়ে উঠে এল সিপিআইএম, চলতি কথায় সিপিএম। এমনকী ১৯৭৭ সালে যেখানে সিপিআইএম একাই জিতল ১৭৭ আসনে, সিপিআই পেল মাত্র ২ টি আসন।
এই লেখা সিপিআইএম এবং সিপিআইকে নিয়ে ইতিহাস চর্চা নয়। তাদের শক্তি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনাও নয়। আসলে এই কয়েক বাক্যের গৌরচন্দ্রিকার প্রধান এবং একমাত্র কারণ, পশ্চিমবঙ্গে একটা বাম সরকার ১৯৭৭ সালে গড়ে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু দিনে দিনে তা হয়ে উঠেছিল সিপিআইএম সরকার। দিন দিন রাজ্যে যতটা সংহত হয়েছে সিপিআইএমের শক্তি, ঠিক ততটাই হীনবল হয়েছে শরিক দল সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি। জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায়, সিপিআইএম নির্বাচনী লড়াইয়ে ধারাবাহিকভাবে শরিক দলগুলির সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি নজর দিয়েছে নিজস্ব শক্তিবৃদ্ধিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কীই বা করার ছিল ক্রমশ সিপিআইএমের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠা শরিক দলগুলোর পক্ষে! তাই এই লেখায় আমি প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাম সরকারের পরিবর্তে সিপিআইএম সরকার কথাটাই ব্যবহার করব। এবং তা সচেতনভাবেই।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২০১১ সালে রাজ্যে সিপিআইএম সরকারের পতন হয়েছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যের মুকুট এবং ব্যর্থতার গ্লানি, অধিকাংশই রাখা আছে রাজ্য সিপিআইএমের সদর দফতর ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মুজফফর আহমেদ ভবনে।
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ এবং নজিরবিহীন ৩৪ বছরের সিপিআইএম সরকারের মূল্যায়ন কিংবা ময়নাতদন্ত, কোনওটাই এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। এই লেখার সময়কাল মূলত ২০০৬ সালের ১৮ মে থেকে ২০১১ সালের ২০ মে।
১৮ মে ২০০৬, রাজভবনে নিয়ন্ত্রিত, সাজানো গোছানো, আবেগহীন এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। গঠিত হয়েছিল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। রাজভবনের আমন্ত্রণ বয়কট করে ৩০ বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একা এবং নিঃসঙ্গ। পাঁচ বছর বাদে ২০ মে ২০১১, রাজভবনে আবার একটা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। আবার নতুন সরকার গঠন হবে। কিন্তু ‘সিপিআইএমের বিরুদ্ধে লড়াইটা যেমনভাবে চাই, ঠিক সেভাবে করতে পারছি না’, শুধুমাত্র এই এক বাক্যের মতাদর্শগত দলিলের ওপর দাঁড়িয়ে যে দলটার জন্ম, তার পক্ষে রাজ্যে সিপিআইএমকে উৎখাত করে সরকার গড়ার অনুষ্ঠানে স্বাভাবিকভাবেই আবেগ নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাখা কঠিন। তারও মধ্যে সেদিন মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চের নীচে ঘুরে ঘুরে তদারকিতে ব্যস্ত সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখতে। একবার দেখছেন নতুন মন্ত্রীরা ধুতি, পাঞ্জাবি ঠিকমতো পরেছেন কিনা, একবার দেখছেন সমস্ত আমন্ত্রিত এসেছেন তো! অতিথি-অভ্যাগতদের আসনের কাছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরছেন রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী। মুখে পরিচিতি হাসি, সঙ্গে একহাতে মোবাইল ফোন ধরে ট্রেডমার্ক জোড় হাতে নমস্কার। তাঁর পিছনে-পিছনে ঘুরছে কয়কজন আমলার ছোট্ট জটলা। শপথবাক্য পাঠের মিনিট দশেকও বাকি নেই, যে কোনও সময় মঞ্চে চলে আসবেন রাজ্যপাল, বারবার বাঁ হাতের কব্জি উলটে ঘড়ি দেখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখে যেন সামান্য একটা উদ্বেগ। যেন নয়, নিশ্চিত উদ্বেগ। কিছু একটা বাকি আছে, নিখুঁত আয়োজনে সামান্য কিছু একটা ত্রুটি আছে। ভাবী মুখ্যমন্ত্রী শুধু একবার আমার দিকে তাকান, এমন একটা মুখ করে মঞ্চের নীচে পরপর সোফা, চেয়ারে বসা কয়েকশো অতিথি তখন তাকিয়ে তাঁর দিকে। কিন্তু তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাইকে দেখছেন, কিন্তু অস্থির চোখে খুঁজছেন কাউকে। পাচ্ছেন না। দু’একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ্যসচিব, পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে নীচু স্বরে কিছু একটা কথা বললেন। আসলে বললেন না, একটা কিছুর খোঁজ নিলেন। মুখ্যসচিবই তো নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র পাঠানোর দায়িত্বে। সব ঠিকঠাক আছে তো?
আরও দু’এক মিনিট কাটল। এক একটা মিনিট তো নয়, যেন এক একটা ঘন্টা! মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মাথা নীচু করে কিছু একটা বললেন এক উচ্চপদস্থ আমলা। কেটে গেল মেঘ। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। অস্থির অপেক্ষার ইতি। একদম প্রথম সারির সোফায় এসে বসলেন, এক সপ্তাহ আগে এই রাজভবনে এসে পদত্যাগ পত্র দিয়ে যাওয়া প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পাশে সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এবং রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। দ্রুত পায়ে সেই সোফার সামনে এগিয়ে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামান্য একটু ঝুঁকে সেই ট্রেডমার্ক জোড় হাতে নমস্কার। সোজা হয় বসে নমস্কার ফেরালেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সাকুল্যে ৮-১০ সেকেন্ড। রাজ্য রাজনীতির চিরকালীন ফটো ফ্রেমে স্থায়ী জায়গা করে নিল এই নমস্কার এবং প্রতি নমস্কারের ছবি।
ব্যাস, আর কিছু বাকি নেই। তরতরিয়ে মঞ্চে উঠে পড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতিথি, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, আমলা এবং সমবেত জনতার এই ফটো ফ্রেমের রেশ কাটাতে না কাটাতেই বেজে উঠল ব্যান্ড। এসে গিয়েছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
‘আমি মমতা ব্যানার্জি, ঈশ্বরের নামে শপথ…
৩৪ বছর বাদে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হল অ-সিপিআইএম যুগ। আর এই যুগ যে কেমন দেখতে, কেমন তার চরিত্র, কতটা তার উচ্চতা, গায়ের রং, চেহারার গড়ন কিছুই জানা নেই রাজ্যের কোটি কোটি মানুষের। কিন্তু এই লেখার বিষয় রাজ্যে সিপিআইএম পরবর্তী যুগ নয়। এই লেখার বিষয় রাজ্যে অ-সিপিআইএম যুগ শুরুর অন্যতম কারণের ময়নাতদন্ত।
নির্দিষ্ট করে বললে, এই লেখার বিষয়, নন্দীগ্রাম। যেখানে শিল্পায়নের ভাবনা, জমি অধিগ্রহণ বিতর্ক। সেখানকার সশস্ত্র প্রতিরোধ, কখনও কখনও তা রাষ্ট্রের ভাষায় অগণতান্ত্রিকও। সেখানে শাসক দল সিপিআইএমের এলাকা হারানো এবং তা দখলের লড়াই। আর এই গোটা কর্মকাণ্ডে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসন, মুজফফর আহমেদ ভবন এবং অবশ্যই বিরোধী নেতা-নেত্রীদের ভূমিকা। নন্দীগ্রামের সূত্র ধরে এই লেখায় আবশ্যিকভাবে এসেছে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ। রাজ্যে জমি অধিগ্রহণের আর এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। যাকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গণতান্ত্রিক আন্দলন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনশন।

নন্দীগ্রাম 

২০০২ সালের ১ জানুয়ারি, অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ভেঙে তৈরি হল পূর্ব মেদিনীপুর। ৪১৫১.৬৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই জেলার দক্ষিণদিকে বঙ্গোপসাগর। উত্তরদিকে ঘাটাল। পূর্বে হুগলি-রূপনারায়ণ নদী এবং পশ্চিমদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা গঠিত হল ২৫ টি ব্লক নিয়ে, বিধানসভা কেন্দ্র ১৬ টি। লোকসভা আসন ২, কাঁথি এবং তমলুক। তমলুক জেলা সদর।
মাথাপিছু গড় আয় ও সাক্ষরতার হার, উন্নয়নের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সূচকে গোটা রাজ্যের গড়ের তুলনায় জন্মলগ্ন থেকেই অনেকটা এগিয়ে ছিল পূর্ব মেদিনীপুর।
মাথাপিছু গড় আয় ২০০২-০৩ বছরে গোটা রাজ্যে ছিল ১৭৫৬৭.৩৭ টাকা। ওই সময়ে ২০০২-০৩ বছরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মাথাপিছু গড় আয় ২১৪৪১.৯১ টাকা।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গোটা পূর্ব মেদিনীপুর এবং রাজ্য উত্তাল হয়ে ওঠে ২০০৭ সালের একদম গোড়ায়।
তার ঠিক প্রক্কালে ২০০৬-০৭ সালে গোটা রাজ্যে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২১৭৫২.৭৯ টাকা।
সেই সময় ২০০৬-০৭ বছরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মাথা পিছু গড় আয় ২৬৩৫৬.৯৪ টাকা।
গোটা রাজ্যের মধ্যে তুলনামূলক উন্নত জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ব্লক নন্দীগ্রাম ১। নানান মাপকাঠিতে। চাষবাস, মাথাপিছু গড় আয়, সাক্ষরতার হার, নিকাশি ব্যবস্থা, স্কুল, কলেজ, প্রায় সমস্ত মাপকাঠিতে অনেক পিছিয়ে ছিল নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক। ২০০৭ সালে সিপিআইএম এবং রাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর।
হলদি নদীর একপারে হলদিয়া, অন্যপারে নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক। এই ১ নম্বর ব্লকের মানুষ সন্ধে নামলেই নদীর একপার থেকে দেখতেন অন্যপারে লক্ষ ওয়াটের আলো। কিন্তু তাদের নিজেদের ব্লকে কেমন ছিল বিদ্যুতের বন্দোবস্ত?
বৈদ্যুতিকরণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ২৫ টি ব্লকের মধ্যে সবার শেষে নন্দীগ্রাম ১। এক নম্বরে নন্দকুমার ব্লক, বৈদ্যুতিকরণ হয়েছে ১০০ শতাংশ মৌজায়। তমলুক ব্লকে ৯৯.১ শতাংশ, পাঁশকুড়া ১ নম্বর ব্লকে ৯৪.৭ শতাংশ, শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকে ৯৩.১ শতাংশ, ময়না ব্লকে ৯২.৯ শতাংশ মৌজায় বৈদ্যুতিকরণ হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় যোট ৯টি ব্লকে ৯০ শতাংশের বেশি মৌজায় বৈদ্যুতিকরণ হয়েছে। বাকি সমস্ত ব্লকের ন্যূনতম ৭০ শতাংশ মৌজায় বৈদ্যুতিকরণ হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম নন্দীগ্রাম ১। সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল মাত্র ৫৮.৬ শতাংশ মৌজায়।
কেন উন্নয়নের সমস্ত মাপকাঠিতেই পিছিয়ে ছিল নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক, আমার জানা ছিল না। বহুবার নন্দীগ্রাম ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় গিয়েও বুঝতে পারিনি এর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ। কেন এত পিছিয়ে ছিল নন্দীগ্রাম, প্রশ্ন করেছিলাম সিপিআইএম পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রকে। ২০১৫ সালে, বিধানসভায় তাঁর ঘরে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এই রাজ্যে সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পরের বছর ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত ভোট এবং সেই ভোটে জেলা পরিষদ আসনে জিতে সূর্যকান্ত মিশ্র অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সভাধিপতি হয়েছিলেন।
‘আমি নন্দীগ্রাম প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৭৯ সালে। তখন চন্ডিপুর দিয়ে নন্দীগ্রামে যাওয়ার কোনও রাস্তা ছিল না। যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল নদী পেরিয়ে। মহিষাদল থেকে নৌকো করে যেতে হোত নন্দীগ্রামের তেরাপেখিয়া ঘাটে। তারপর তেরাপেখিয়া ঘাট থেকে একটা সরু রাস্তা ছিল খোদামবাড়ি হয়ে নন্দীগ্রাম বাজার পর্যন্ত। আমি সেই রাস্তা দিয়েই গেছিলাম ‘ ৭৯ সালে। নন্দীগ্রাম বাজারের পর আরও কোনও রাস্তা ছিল না। নন্দীগ্রামের উন্নয়নের সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। নন্দীগ্রাম ছিল একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। পাশের খেজুরিতে কিন্ত সেই সমস্যা ছিল না। ঐতিহাসিকভাবেই খেজুরি ছিল অনেক উন্নত জায়গা। পর্তুগীজরা খেজুরিতে পোস্ট অফিস করেছিল। খেজুরিতে ছোট বন্দরও ছিল। রাস্তাও ছিল সেই সময়, যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো ছিল, যা নন্দীগ্রামে ছিল না।’ বলেছিলেন সরকার পরিবর্তনের পর রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র।
এই পিছয়ে পড়া নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে ১০ হাজার একরের বেশি জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিল সিপিআইএম সরকার। পাশের খেজুরিরও কিছু জমি মিলে মোট সাড়ে ১২ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের কর্মসূচি ছিল। আর এই উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় মানুষের থেকে বাধা এল সর্বাত্মক। এই বাধা, তার মোকাবিলা, লড়াই, টানাপোড়েন সব কিছু মিলিয়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলন। সেখানকার গ্রামবাসীদের গড়ে তোলা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি এবং জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রাখা লড়াই। আন্দোলনের মোকাবিলায় সশস্ত্র সিপিআইএম বাহিনীর নন্দীগ্রাম আক্রমণ। এবং সশস্ত্র প্রতিরোধও। এ সবই এই লেখার বিষয়বস্তু।
কিন্ত সর্বজনবিদিত এই নন্দীগ্রাম আন্দোলন, তার পটভূমিকা, গতিপ্রকৃতি, পরিণতি নিয়ে এত বছর বাদে লেখার দরকার পড়ল কেন?
মানব জীবনের যে কোনও জটিল বিষয়ের মতো নন্দীগ্রাম এপিসোডও বহুমাত্রিক। এই বিভিন্ন দিক, সমস্ত পক্ষ, চিন্তা, প্রতিচিন্তা সবটাই যতটা দেখেছি, শুনেছি, জেনেছি, লেখার চেষ্টা করেছি।
আমি বিশ্বাস করি, ২০১১ সালে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের একাধিক কারণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক ছিল রাজ্যে সিপিআইএম বিরোধী আন্দোলনের এপিসেন্টার। শুধু তাই নয়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসনকে বেআব্রু করে দিয়েছিল নন্দীগ্রাম। অথচ এই নন্দীগ্রাম নিয়ে কোনও সিরিয়াস মূল্যায়নই করেনি সিপিআইএম। যতটুকু যা মূল্যায়ন করেছে, সবটাই দায়সারাভাবে। নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পর ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৫ সালে (এই লেখা পর্যন্ত) সিপিআইএমের তিনটে রাজ্য সম্মেলন হয়েছে। তিনটে পার্টি কংগ্রেস হয়েছে। কিন্তু কোথাও নন্দীগ্রাম নিয়ে কাটাছেঁড়া না করে, পার্টির ত্রুটি, বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা না করে রাজ্য সম্পাদকের সাংগঠনিক প্রতিবেদনে তিন-চার বাক্য উল্লেখ করেই দায় সারা হয়েছে। সরকার চলে যাওয়ার পর ২০১১ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি মুজফফর আহমেদ ভবনে সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির এক বৈঠকে নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ উঠেছিল এবং কমিটির কয়েকজন সদস্য তমলুকের প্রাক্তন সংসদ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নেতা লক্ষণ শেঠকে অভিযুক্ত করেছিলেন গোটা কর্মকাণ্ডের জন্য। সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন লক্ষণ শেঠ এবং সমস্ত অভিযোগ শুনে তিনিও তার জবাব দেওয়ার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কাছে। তারপর মিনিট পনেরো ধরে লক্ষণ শেঠ রাজ্য কমিটির সদস্যদের কাছে তাঁর মতো করে ব্যাখ্যা করেছিলেন নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ। যে ব্যাখ্যার প্রধান বিষয় ছিল, নন্দীগ্রামে যা যা ঘটেছে সব রাজ্য নেতারা জানতেন। সমস্ত কিছু। শুধু শুধু তাঁকে কেন একা দায়ী করা হচ্ছে? লক্ষণ শেঠের এই বক্তব্য শুনে সেদিন রাজ্য কমিটির অধিকাংশ সদস্যই স্তম্ভিত হয়ে যান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিমান বসু সঙ্গে সঙ্গে হস্তক্ষেপ করেন এবং লক্ষণ শেঠকে বলেন, তাঁর বক্তব্য রাজ্য নেতৃত্বের কাছে লিখিতভাবে জমা দিতে। আশ্বাস দেন, বিষয়টি নিয়ে পরে রাজ্য কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তারপর কয়েক বছর পেরিয়ে গিয়েছে, সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক বদল হয়েছে, ২০১২ রাজ্য সম্মেলনে লক্ষণ শেঠ রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। কিন্ত নন্দীগ্রাম নিয়ে লক্ষণ শেঠের জমা দেওয়া রিপোর্ট আর কোনও দিনই আলোচনায় ওঠেনি। নন্দীগ্রামের কিংবা রাজ্যের মানুষ তো দূরের কথা, কী আছে সেই রিপোর্টে, জানতে পারেননি সিপিআইএমের অধিকাংশ নেতাও। দলের রাজ্য সম্পাদকের কাছে লক্ষণ শেঠের পেশ করা এই রিপোর্টের প্রায় পুরোটাই আমি জানতে পারি রাজ্য কমিটির ওই মিটিংয়ের প্রায় দু’বছর বাদে। এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিই, নন্দীগ্রামের এই অজানা কাহিনী সাধারণ মানুষ এবং সিপিআইএম নেতা, কর্মীদের জানা জরুরি। সেই জায়গা থেকেই এই বই লেখার ভাবনার সূত্রপাত।
স্টার আনন্দ (পরবর্তীকালে এবিপি আনন্দ) চ্যানেলের হয়ে অ্যাসাইনমেন্টে এক সময় ধারাবাহিকভাবে নন্দীগ্রামে গিয়েছি। নিজেই যে প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে বহুদিন ঘুরেছি নন্দীগ্রামে, তার অনেক জবাব পেয়েছি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে জমা পড়া সেই গোপন রিপোর্টে। তারপরেও যে প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত ছিল তার জন্য পরে কথা বলেছি আরও একাধিক মানুষের সঙ্গে।

চলবে

Comments are closed.